বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

নীল চাষ, নীল বিদ্রোহ, নীলদর্পণ নাটক ও রেভারেন্ট জেমস্ লঙ

মোঃ জোবায়ের আলী জুয়েল : ভারতীয় উপমহাদেশে কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। ১৮৫৯-৬০ সালে সারা বাংলায় নীল-প্রধান এলাকায় নীলকরদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। অবিভক্ত বাংলায় নীল চাষের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকরাই এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নীলচাষের বিরুদ্ধে সারা বাংলার কৃষক মজদুর সংগ্রামী জনতা সংঘবদ্ধভাবে এটার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন। এর আগে বারাসতের কৃষকগণ তিতুমীরের নেতৃত্বে ১৮২৭ থেকে ১৮৩১ সালের মধ্যে এবং পূর্ববঙ্গের কৃষকগণ দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ১৮৩৮ সাল থেকে জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। তাই সময়ানুক্রমে তীতুমীরের বিদ্রোহ, ফরায়েজী আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহ ও নীল বিদ্রোহ পর্যায়ক্রমে বাংলার কৃষকদের মধ্যে যে জাগরণ ও সচেতনতার উন্মেষ ঘঠিয়েছিল পরবর্তীকালে তাই সম্প্রসারিত কৃষক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়।
নীল এক প্রকার চারাগাছ, যা থেকে রঙ সংগ্রহ করা হতো। যশোর, ফরিদপুর, ঢাকা, রাজশাহী, পাবনা, খুলনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় এবং ভারতের বারাসত, মালদহ, নদীয়া প্রভৃতি স্থানে নীল চাষ হতো বলে জানা যায়। বাংলাদেশ থেকে অতীতে প্রচুর নীল ইউরোপের বাজারে রপ্তানী হতো। নীলকররা নীল উৎপাদিত অঞ্চলে কুঠি স্থাপন করতো। প্রত্যেক কুঠিতে কয়েদখানা ছিলো। নীলকরদের নিজস্ব বেসামরিক বাহিনী ছিলো। লাঠিয়াল, পাইক-পেয়াদা ও বরকন্দাজ নিয়ে গঠিত হতো নীলকরদের বেসামরিক বাহিনী। নীলকররা কৃষকের উৎকৃষ্ট জমিতে দাগ দিয়ে নীলচাষে তাদের বাধ্য করতো। নীল বিদ্রোহ ও নীল চাষের কথা বলতে গেলে আমাদের অবিভক্ত বাংলায় অতীতের দিকে অবশ্যই দৃষ্টি ফেরাতে হবে। বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্রায় এক শতাব্দীর মতো সময় ধরে নীলচাষ প্রচলিত ছিল। অনেকের মতে প্রাচীনকালে একমাত্র ভারতবর্ষেই সর্বপ্রথম নীল প্রস্তুত করা হতো এবং নানা দেশে তা রপ্তানী করা হতো। বহুকাল পূর্ব থেকেই সে ভারতবর্ষে নীলচাষ করা হতো প্রাচীন পুস্তকাদিতেও তার সমর্থন রয়েছে। মধ্যযুগেও ভারতবর্ষ নীলের জন্য বিখ্যাত ছিল তার প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। আবুল ফজলের “আইন-ই-আকবরী” থেকে জানা যায় যে, আগ্রার নিকট বিয়ানা ও গুজরাটের অন্তর্গত আহ্মেদাবাদে উৎকৃষ্ট নীলরঙ প্রস্তুত হতো এবং তার দাম ছিল প্রতি মণ ১০ থেকে ১২ টাকা।
নীলগাছ সাধারণত: তিনফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি উদ্ভিদ, এর ছড়িগুলি মানুষের বৃদ্ধাঙ্গুলির সমান লম্বা হতো এবং ফুল ছিলো “হার্টস ইজ” ফুলের মতো। নভেম্বর মাসের দিকে এর বীচি পাকতো। একবার জন্মাবার পর নীলগাছ তিন বছর বাঁচতো। এ সময়ের মধ্যে তিনটা ফসল সংগ্রহ করা হতো। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিক থেকে শুরু করে অক্টোবরের শেষনাগাদ বীজ বোনা চলতো, ফসল কাটা হলে নীলগাছগুলি বেঁধে কুঠিতে নিয়ে যাওয়া হতো। নীলরঙ তৈরির জন্য প্রাথমিক প্রয়োজন ছিল প্রচুর পরিমাণ স্বচ্ছ পানির এবং সে কারণেই নীল কারখানাগুলো সবসময়ই নদীর তীরে প্রতিষ্ঠিত হতো। নদীর পানি হস্তচালিত পাম্পের সাহায্যে প্রথমে একটি জলাধারে আনা হতো। তারপর সেই পানি নেওয়া হতো নিরেটভাবে তৈরি সারি দেয়া জোড়া জোড়া চৌবাচ্চায়। প্রতিটি নীলকুঠিতে পাথরের তৈরি বড় বড় অনেকগুলি হাউজ বা চৌবাচ্চা থাকতো। সদ্য কাটা নীলগাছ উপরের চৌবাচ্চায় সারিবদ্ধভাবে রাখা হতো। নীলগাছগুলো সম্পূর্ণরূপে পানিতে নিমজ্জিত রাখা হতো। পরবর্তীতে ৯/১০ ঘন্টা পানিতে রাখার পর এর রঙ সাদা পরে ধুসর, নীল এবং সর্বশেষে গাঢ়নীল রঙ ধারণ করতো।
নীচের পিপায় পানি সরিয়ে নেয়ার পরপরই দশজন লোক হাতল দিয়ে সে পানি পেটাতে শুরু করতো। দেড়ঘন্টা কাল পানি পেটানোর পর আস্তে আস্তে পিপার তলায় গাদ জমাট বাঁধতে শুরু করতো। গাদ জমাট বাঁধার ২/১ ঘন্টা পর আস্তে আস্তে পিপার পানি ছেড়ে দিয়ে তা নিষ্কাশন করা হতো। অপেক্ষাকৃত হালকা গাছগুলো একটি পাইপের মুখে তুলে দিয়ে তা আর একটি পিপায় গিয়ে জমা হতো। পিপার পাশেই একটি বয়লার বা চুল্লি থাকতো, চুল্লিতে উত্তাপ দিলে গাদের উপর তৈলাক্ত একটি জিনিস ভাসতো। তারপর এটাকে একটু আলাদা পিপায় নিয়ে মোটা পশমী কাপড়ের ভেতর দিয়ে দু’বার বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছেঁকে নেয়া হতো। পরদিন সকালে পরিশ্রুত নীল সংগ্রহ করে শক্ত থলিতে পুরে ব্যাগসহ চাপ দেয়া হতো। জমাটবেঁধে যাওয়া নীল এরপর বার সাবানের মতো আয়তক্ষেত্রকার বড় বড় পিণ্ডে পরিণত হতো। এই পিণ্ডগুলোকে পরে তিন থেকে সাড়ে তিন বর্গ ইঞ্চি মাপ কেটে নিলেই তৈরি হয়ে যেতো নীলের কেক। এই কেকের গায়ে কোম্পানির নামও তৈরির ছাপ মেরে দেয়া হতো। সবশেষে নীলের কেকগুলো বাক্সে পুরে নদী পথে কোলকাতায় পাঠানো হতো নিলামের জন্য। আট আউন্সের একটি নীল কেক তৈরির জন্য দু’হাজার বর্গফুট জমির প্রয়োজন হতো অর্থাৎ বিঘা প্রতি তৈরি হতো আটটি কেক।
ইংরেজরা এদেশ বিজয়ের পরে সম্ভবত বাংলায় নীলচাষ শুরু হয় এবং অচীরেই তা প্রায় সমগ্র বাংলাদেশ নীল চাষের প্রধান কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। অবিভক্ত বাংলায় নীল চাষের ইতিহাস যতটুকু জানা যায়, তাতে দেখা যায় ১৭৭৭ সালে “মাঁসিয়ে লুই বনার নামক জনৈক ফরাসী চন্দননগরের কাছে তালভাঙ্গা ও গোন্দলপাড়ায় সর্বপ্রথম নীলকুঠী স্থাপন করে প্রথম নীলচাষ শুরু করেন। নীল ব্যবসায় মাঁসিয়ে বনার প্রচুর ঐশ্বর্যের মালিক হন এবং আরো কয়েকটি স্থানে তিনি কুঠি স্থাপন করেন। সম্ভবত তারই দেখাদেখি “ক্যারল বুম” নামক জনৈক ইংরেজ এদেশে সর্বপ্রথম নীলকুঠি স্থাপন করেন। ১৭৭৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশে নিজেই নীলচাষ শুরু করেন, কিন্তু বহু টাকা লোকসান হওয়ায় পরবর্তীতে নীল চাষ বন্ধ করেছেন।
যশোর জেলার অর্থনৈতিক ইতিহাসে নীল এককালে বিশেষ স্থান দখল করেছিল। “ব্রন্ড” নামক একজন ইংরেজ বণিক ১৭৯৫ সালে এখানে সর্বপ্রথম নীল উৎপাদন শুরু করেন বলে জানা যায়। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ঢাকায় নীলের চাষ আরম্ভ হয়।
১৮২০ সালের দিকেই সারা বাংলা জুড়ে নতুন নতুন নীল Concern এদেশ ছেয়ে যায়। ১৮২৬ সালে নীল উৎপাদন সর্বোচ্চ পমিাণে পৌঁছায়। নীল ঈড়হপবৎহ গুলোর প্রতিনিধি হিসেবে ১৮২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় Union Bank of Calcutta.
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে অনেক ঐতিহাসিকের মতে ১৮৫৯-’৬০ সালে সারা বাংলায় নীল-প্রধান এলাকায় নীলকরদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, নীল চাষে কত কৃষককে যে বাপ-দাদার ভিটে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছিল, নীলকুঠির গুদামে অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে সকরুণ মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল তার কোনো ইয়ত্তা নাই। জোর করে নীল চাষে বাধ্য করার জন্য কৃষকদের শুধু যে গুদামে বন্দী করা হতো তাই নয় তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা যাতে এ হতভাগ্যদের কোনো খোঁজ-খবর করতে না পারে সেজন্য তাদের এক কুঠি থেকে অন্য কুঠিতে ঘুরানো হতো। প্রজাদেরকে নীলকররা তাই “চৌদ্দ কুঠির জল খাওয়ানোর” ভয় দেখাতো।
কেদারনাথ মজুমদার ময়মনসিংহের ইতিহাসে উল্লেখ করেছেন যে, ১৮৪৩ সালে বাগমারীর নীলকুঠির অধ্যক্ষ কিংসাহেব নীল বুনতে অস্বীকার করায় একজন প্রজার মাথা মুড়িয়ে তাতে কাদা মেখে নীলের বীজ বুনে দিয়েছিল। ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট “ডেলাতুর” তাঁর সাক্ষ্য প্রমাণে নীল কমিশনকে বলেছিলেন “এমন একটা নীলেরবাক্স ইংল্যান্ডে পৌঁছায় না যেটা মানুষের রক্তে রঞ্জিত নয়”। “ইন্ডিগো কমিশনের” মতে ১৮৫৯ সালে বাংলায় প্রায় ৫০০শত নীলকর মোট ১৪৩টি ইন্ডিগো কনসার্নে কাজ করতো। এই ফার্মগুলোতে পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট নীল উৎপাদন হতো এবং কোলকাতা থেকে রপ্তানীকৃত মোট নীলের ৬০ শতাংশ এরাই রপ্তানী করতো। আবার বাংলা উৎপাদিত নীলের অর্ধেক আসতো নদীয়া এবং যশোর জেলা থেকে। বাংলার যে যে অঞ্চলে নীলচাষ হতো এবং যেসব স্থানে কারখানা স্থাপিত হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, বারাসত, যশোর, খুলনা, বর্ধমান, বাকুড়া, মোদনীপুর, বীরভূম, হুগলী, হাওড়া, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, রংপুর, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ। এক এক বড় কোম্পানীর বিভিন্ন কারখানা বহুজেলা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। সবচেয়ে বেশি নীল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, মুর্শিদাবাদ, চব্বিশ পরগনা, যশোর, নদীয়া, পাবনা ও মালদহ জেলায়। মুর্শিদাবাদ জেলায় James Hill ছিলেন অন্যতম প্রধান নীলকর। ঢাকাও পার্শ্ববর্তী জেলা সমূহে যিনি নীলকর ছিলেন, তার নাম ছিল SP. Waise। তৎকালীন উত্তরবঙ্গ অর্থাৎ রাজশাহী বিভাগে ছিলেন Robert Watson Company। ইংরেজ নীলকর ছাড়াও Native দের কিছু ছোট ছোট নীল Concern ছিল। এমনই একজন Native নীলকর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।
নীলকরদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের মধ্যে ছিল নারীর অবমাননা, অপহরণ ও ধর্ষণের নানা জনশ্রুতি। বিষয়টি বিতর্কিত এবং এ বিষয়ে তখনো নানা মুনির নানামত ছিল। সমসাময়িক দারোগা ও সাহিত্যিক গিরিশচন্দ্র বসু নীল বিদ্রোহের সময় (১৮৫৩-১৮৬০ খ্রি.) নদীয়ার কোতওয়ালী থানার দারোগা ছিলেন। তিনি “নীলদর্পণে” উল্লেখিত অপরাধ খণ্ডনের চেষ্টা করেছিলেন। আরেকজন সতীশচন্দ্র মিত্র বলেছেন যে নীলকরদের মধ্যে এমন দুর্বৃত্ত ছিল যারা নিরীহ কৃষক-কন্যাদেরকে কুঠিতে ধরে এনে অপমান করতো। ১৮৪৭ সালে ফরিদপুরের ডেপুটি কালেক্টর ডেলাতুর তার ম্যাজিষ্ট্রেটের অভিজ্ঞতা থেকে সেই সময় আরো বলেছেন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বহু রাইয়তকে আমার কাছে পাঠাতে দেখেছি যাদের এপিঠ ওপিঠ বর্শাবিদ্ধ। অন্যদেরকেও বর্শা বিদ্ধ করে গুম করা হয়েছে। এরকম নীল পদ্ধতিকে আমি রক্তপাত পদ্ধতি মনে করি। ১৮৬০ সালে নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর হার্শেলের রিপোর্টে ১৮৫৫-১৮৬০ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে ৫৪টি ঘটনার মামলার উল্লেখ আছে। কত তুচ্ছ কারণে কি রকম কূট-কৌশলে নীলকররা অস্বীকৃত কৃষককে নীল চাষে বাধ্য করতেন “সমাচার দর্পন” এ তার একটা চমকপ্রদ বিবরণ তুলে ধরা হলোÑ“যে প্রজা নীলের দাদন না লয় তাহাদিগের প্রতি নীলকর সাহেবরা ক্রোধ করিয়া থাকেন ও খালাসী দিগকে কহিয়া রাখেন যে ঐ সকল প্রজার গরু নীলের নিকট আইলে সে গরু ধরিয়া কুঠিতে আনিবা” (সমাচার দর্পন ১৮ মে ১৮২২ খ্রিঃ) প্রকাশ্যে কৃষক একবার দাদন নিলে সারাজীবনেও তা শোধ হতো না। শুধু তাই নায় মৃত্যুর পর ঐ কৃষকের পুত্রদেরও সেই দাদনের দায়ভার বহন করতে হতো। ভালো ভালো ধানী জমিতে কায়িক পরিশ্রমে উৎপন্ন নীলের যে সামান্য মূল্য কৃষক পেতো তারও কিছু কিছু অংশ দিতে হতো কুঠির দেওয়ান খালাসী প্রভৃতি কর্মচারীদের। ফলে কৃষকের হাতে শেষ পর্যন্ত প্রায় কিছুই অবশিষ্ট থাকতো না।
নীল চাষ সম্পর্কিত সেকালের “সমাচার দর্পন” এর আর একটি বিবরণ এখানে তুলে ধরা হলো- “নীলের দাদন যে প্রজালয় তার মরণ পর্যন্ত খালাস নাই। যেহেতুক হিসাব রফা হয়না, প্রতি সনেই দাদন সময়ে বাকীদার কহিয়া ধরিয়া কয়েদ করিয়া রাখে। তাহাতে প্রজারা ভীত হইয়া হাল-বলদ বাকী লিখিয়া দিয়া দাদন লইয়া যায়। এই রূপ যাবৎ গোবৎসাদি থাকে তাবৎ ভিটায় থাকে তাহার অন্যথা হইলে স্থান ত্যাগ করে, যেহেতু দাদন থাকিতে অন্য শস্য আবাদ করিয়া নির্বাহ করিতে পারেনা। গরুকে এমত কয়েদ রাখে যে তৃণ ও জল দেখিতে পারেনা। ইহাতে প্রজা লোক নিতান্ত কাতর হইয়া কুঠিতে যায়। প্রথমে তাহাদিগকে দেখিয়া কেহ কথা কহেনা। পরে গরু অনাহারে যত শুষ্ক হয় ততই প্রজার দুঃখ হয়। ইহাতে সে প্রজা রোদনাদি করিয়া সরকার লোককে ঘুষ দিয়া নীলদাদন লইয়া গরু খালাস করিয়া গৃহে আইসে (সমাচার দর্পন ১৮ মে ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দ)
অসহায় কৃষককুলের উপর নীলকররা আর বহুবিধ অত্যাচার করতো। সুন্দরী মেয়েদের তারা অনেক সময় লাঠিয়াল দিয়ে জোরপূর্বক কুঠিতে ধরে নিয়ে আসতো। নদীয়া জেলার কুলচিকাটা কুঠির সাহেব আর্চিবল্ড হিল্স এমনিভাবে সুন্দরী কৃষক-কন্যা হরমণিকে হরণ করে এনেছিল। নীলচাষ বিষয়ক যথার্থ প্রতিচ্ছবি দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকে এই হরমণিই ক্ষেতমণিতে সার্থকভাবে রূপান্তরিত হয়েছে। নদীয়ার বাজিমাজু গ্রামের মীরজান মন্ডল নামক জনৈক কৃষক নীল কমিশনের নিকট তার সাক্ষ্যে বলেছিলেন- নীলকর হচ্ছে একাধারে নীলকর, জমিদার ও মহাজন। আমার আর একটা অভিযোগ হচ্ছে এই যে, গত কার্তিক মাসে নীলকর আমার ৭০০ বাঁশ কেটে নিয়ে গেছে, তারজন্য সে এখনো কিছু দেয়নি। যদিও বা দেয় তাহলে দেবে ১০০ বাঁশের জন্য মাত্র ৪ আনা। এরূপ হাজারো প্রমাণ দেয়া যাবে তৎকালীন নীলচাষকৃত ইংরেজ বেনীয়াদের পাশবিক অত্যাচারের অমানবিক বিভৎস কাহিনীর। নীলচাষ এবং নীলকরদের বে-আইনি, অমানবিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে থেকেই নীলচাষীরা বিক্ষোভ, বিদ্রোহ করে আসছিলেন। বিদ্রোহ ও বিক্ষোভকে প্রতিহত করার জন্য বাংলা সরকার পুলিশ, সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করেছিলেন। ১৮৩২ সালে বাংলাদেশের ইষ্ট কোম্পানীর “বোর্ড অব ডিরেক্টরস”-এর সভার বিবরণীতে ও নীলকরদের নিন্দা ভাষণে সবাই মুখর হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত বাংলার রাজনৈতিক ও বিচার সংক্রান্ত কার্যবিবরণীতে নীলসমস্যা নিয়ে শতাধিক মন্তব্য, মতামত, প্রতিবেদন লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। বাংলা সরকারের ১৮৫৯-১৮৬০ সালের প্রশাসনিক বিবরণীতে দেখা যায় নীলকরদের বেপরোয়া গুণ্ডামী ও লুটতরাজের কাহিনী সেখানেও বর্ণিত হয়েছে। নদীয়ার ম্যাজিষ্ট্রেট হার্শেলের বিরুদ্ধে নীলকরদের অভিযোগে, ৩রা মে ১৮৬০ সালে নদীয়ার প্রজাদের সংগঠন সম্পর্কে উল্লেখ করা হয় যে প্রজারা সরকারের কাছে দরখাস্ত করার জন্য প্রত্যেককে আটআনা চাঁদা দিচ্ছে, মুসলমানরা আল্লাহর নামে এবং অন্যান্যরা বিভিন্ন দেবতার নামে শপথ করছে নীল চাষ বন্ধ করার জন্য। প্রতিদিন ঢোলের আওয়াজের মাধ্যমে একগ্রাম থেকে আরেক গ্রামে বার্তা পৌছে দিচ্ছে এবং বারো-চৌদ্দ মাইল দীর্ঘ বিশাল এলাকায় মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে লোকজনকে উত্তেজিত করা হচ্ছে। যশোরের কাঠগড়া কনসার্নে চৌগাছার বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে প্রথম নীল বিদ্রোহ হয় বলে সতীশচন্দ্র মিত্র দাবী করেছেন (যশোহর-খুলনার ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৭৭)। বারাসতের অ্যাশলে ইডেন এবং কৃষ্ণনগরের ম্যাজিষ্ট্রেট ডব্লজে, হাশেল নীলকব্ব, নীলচাষী সংঘাতে নিরন্ন এদেশের কৃষকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। সারা বাংলায় ১৮৬০ সালে নীলপ্রধান এলকায় এতদিনের চাপা ক্ষোভ ও বিদ্রোহের আগুন একত্রে জ্বলে উঠলো। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক (১৮৬০ খ্রিঃ) ঠিক এ সময়ই রচিত হয় ও সারা বাংলায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে এক গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং স্বতঃস্ফুর্তভাবে অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করে। দীনবন্ধ মিত্র ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা জেলার একটি অজ্ঞাত নামী ছাপাখানা থেকে নাম গোপন করে  নীলচাষের বিরুদ্ধে সর্ব্বপ্রথম সার্থক বাংলা নাটক নীলদর্পণ প্রকাশ করেন (১৮৬০ খ্রিঃ)। যেহেতু দীনবন্ধু মিত্র কর্মজীবনে বৃটিশের অধীনে সরকারী কর্মচারী ছিলেন, তাই নাম গোপন করেছিলেন। ১৮৬১ সালের ১২ জুন “হরকরা” পত্রিকায় ঢাকার সংবাদদাতা লিখেছিলেন- “Our native friends entertain them selves with occasional thearical performances and Neel Darpan was acted on one these occasion.” ঢাকার নাট্য ইতিহাসে এই বর্ণনা চিরকাল মানুষের মনিকোঠায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
নীলদর্পণ নাটকে উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রামবাংলার আপামর খেটে খাওয়া মানুষ, নীলচাষীগণ একত্রে কুঠিয়ালদের অত্যাচারে জোটবেঁধে প্রতিরোধ সংগ্রাম আরম্ভ করলে শ্বেতাঙ্গ কুঠিয়াল ও বিদ্রোহী প্রজার মধ্যে দারুণ সংঘাত ও হাঙ্গামা বেঁধে উঠে। অবস্থা এমন গুরুতর আকার ধারণ করে যে, তদানীন্তন বড়লাট ক্যানিং তার এক পত্রে লিখেন-
“I assure you that for about a week. It caused me more anxiety that I have had since that a short fixed in anger of fear by one foolish planter night put every factory in Lower Bengal.”
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের চোট খাওয়া ইংরেজরা দারুণভাবে বিব্রতবোধ করতে শুরু করলো ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে নীলদর্পণ নাটক প্রকাশের জন্য। তখনকার মজলুম নীলচাষীদের মনে সিপাহী আন্দোলন দিয়ে গিয়েছিল এক নতুন প্রেরণা। শেতাঙ্গ নীলকুঠিয়ালদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার বজ্রকঠোর সংকল্প। এরপর নীলদর্পণ নাটক প্রকাশের মাধ্যমে শক্তিমদাসক্ত নীলকর সংঘবদ্ধ চাষীদের মধ্যে বেঁধে উঠলো নিদারুণ সংঘাত। পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ভাগীরথীর তীর হয়ে উঠলো নীলহাঙ্গামার বারুদের মতো উত্তেজিত দাবানল। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হবার পরেই নীলদর্পণ নাটকটি কলকাতার বিশিষ্ট ইংরেজ ধর্মযাজক লঙের হাতে এসে ছিল। নাটকটি পড়ে পাদ্রী লঙ দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেন এবং তিনি নিজেই সম্ভবত সেটি ইংরেজীতে অনুবাদ করার জন্য ত্বরিৎ চিন্তাভাবনা শুরু করেন। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে এ নাটকের ইংরেজী অনুবাদ Nill Darpan on the Indigo planting Mirror প্রকাশিত হলে নীলকরদের মধ্যে দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কে ছিলেন এই লঙ? রেভারেন্ড জেমস্ লঙ ছিলেন আয়ারল্যান্ডের যুবক যাজক প্রোটেসট্যান্ট চার্চ অব ইংল্যান্ডের প্রতিনিধি। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৮৪০ সালে কলকাতায় তার আগমন ঘটে। ধর্মপ্রচারক হিসেবে লঙ এদেশে এলেও তিনি ছিলেন একাধারে বহুভাষাবিদ, সমাজ গবেষক, সাংবাদিক, গ্রন্থাগার আন্দোলনের স্রষ্টা ও অনুবাদক।
২৬ বছর বয়সে লঙ ছিলেন কোলকাতার মিরজাপুরের চার্চ সোসাইটি স্কুলের প্রধান। চার্চের কাজ ও স্কুলের শিক্ষকতা এক সঙ্গে দু’টো দায়িত্ব লঙ দক্ষতার সাথে পালন করেছেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে নাটকের ইংরেজী অনুবাদ “Nill Darpan on the Indigo Planting Mirror” প্রকাশিত হলে নীলকরদের মধ্যে দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। দীনবন্ধুরও উদ্দেশ্য ছিল নাটকটি ইংরেজীতে অনুবাদ করে সম্ভ্রান্ত ইংরেজদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এ নাটকটি কলকাতার বুকে মঞ্চস্থ করা। নাটকটিতে অভিনয় করারও তিনি ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন বাঙ্গালী পাত্র-পাত্রীর দ্বারা। নাটকটি ইংরেজীতে মঞ্চস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে “নীলদর্পণের” পাণ্ডলিপি ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে এবং বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে সে সময় ব্যাপক তল্লাশী চালিয়ে ধর-পাকড় শুরু করেন। নাটকটির নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র ও পরিচালক গৌরসেন বসাক আত্মগোপন করে রইলেন। বইটিতে অনুবাদকারীর নাম ছাপা হয়েছিল “Translated from Bengali by a native” এই অনুবাদের জন্য মানহানির দায়ে মুদ্রাকর ম্যানুয়েলের জরিমানা হয়েছিল সাংঘাতিক রকমের। নীলদর্পণ নাটক মঞ্চস্থঃ হবার পরপরই এলাকার এতদিনকার ধূমায়িত অসন্তোষ একযোগে প্রচণ্ড বিষ্ফোরণ দাবানল আকার ধারণ করে। বিদ্রোহের আগুন সারা বাংলায় একত্রে জ্বলে উঠেছিল।
১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে এসব হাঙ্গামার জন্য নীলদর্পণ নাটকের তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে আবারও “ইনডিগো কমিশন” নিয়োজিত হলো। নীল হাঙ্গামায় নীলচাষীদের পক্ষ অবলম্বনের অভিযোগে গভর্ণর গ্রান্ট স্বজাতি কর্তৃক তিরস্কৃত হন। নীলদর্পণ নাটকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাম ইংরেজীতে অনুবাদক হিসেবে সন্দেহ হওয়ায় তিনিও ইংরজেদের নিকট তিরস্কৃত হন এবং শেষজীবনে তাকে সুপ্রিমকোর্টের চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছিলো। অর্থাগমের অনিশ্চয়তা দূর করবার জন্য তাকে ব্যারিষ্টারি চাকরি ছেড়ে গ্রহণ করতে হয়েছিলো মাসিক দেড়হাজার টাকা বেতনের প্রিভি কাউন্সিল আপীলের অনুবাদ বিভাগের পরীক্ষকের চাকরি।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের শেষজীবন অতিবাহিত হয় অত্যন্ত দুঃখ-দারিদ্রের মধ্য দিয়ে। ঋণের দায়ে অর্থাভাব, অসুস্থতা, চিকিৎসাহীনতা ইত্যাদি কারণে তাঁর জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ। শেষজীবনে তিনি উত্তরপাড়ার জমিদারদের লাইব্রেরী ঘরে বসবাস করতেন। স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃত্যুর ৩ দিন পরে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন বাংলার এই বিখ্যাত কবি জামাতা-পুত্র-কন্যা পরিবেষ্টিত কপর্দকহীন অবস্থায় কোলকাতার আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বাংলা সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত কবি ও নাট্যকার দারিদ্রের মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পিছনে রয়েছে নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজী অনুবাদ। নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশের সহায়তার জন্য বাংলা সরকারের সেক্রেটারী সিটনকারের পদোন্নতি ঘটে। তৎকালীন বারাসতের ম্যাজিষ্ট্রেট এ্যাশলি ইডেনের ইংরেজ উৎপীড়িত, নিপীড়িত নীলচাষীদের দুঃখ সম্বন্ধে তার স্পষ্টবাদিতার জন্য খ্যাতিলাভ করেন। ক্যানিং, ফারগুসন, প্রভৃতি অত্যাচারী শেতাঙ্গ বেনীয়াদের সঙ্গে উদারচেতা ইডেন, পাদ্রী লঙ, সিটনকার ও ম্যানুয়েল অমর হয়ে থাকবেন নীলদর্পণ নাটকের জন্য।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে কটি নাটক মানুষ ও নাট্যকলাকে প্রভাবিত করেছিল দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ তাদের মধ্যে অন্যতম। দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন মাটির কাছাকাছি মানুষ এবং সমাজকল্যাণে নিবেদিত একনিষ্ঠ শিল্পী। তিনি ছিলেন কৃত্রিমতার ঘোর বিরোধী এবং সত্যের অনুসন্ধানী। তীক্ষè সমাজদৃষ্টি, জীবন্ত চরিত্র সৃষ্টি এবং প্রচণ্ড মানবিক মূল্যবোধ ও সহানুভূতি তাঁর সৃষ্টিকে অমর করে রেখেছে। ১৮৭৩ সালের ১লা নভেম্বর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে এই নিবেদিত প্রাণ, একনিষ্ঠকর্মী, মানবদরদী দীনবন্ধু মিত্রের অকাল মৃত্যু হয়।
নীলকর সাহেবদের সীমাহীন অত্যাচার এবং নীলচাষীদের দূর্ভোগের লাঞ্চনা-গঞ্জনার কাহিনী তখন সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। নীলকরদের এই অকথ্য বর্বরচিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে লঙের মনে অনেক আগেই জন্মেছিল এক অব্যক্ত চাঁপা ক্ষোভ। নীলদর্পণ পড়ে স্বভাবতই মানবদরদী লঙ মুগ্ধ হন এবং নীল ব্যবসায়ীদের ওপর দারুণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। নীলদর্পণের অনুবাদ পাণ্ডুলিপিতে প্রকাশকের নাম ছাপা হয়েছিল পাদ্রী লঙ সাহেবের। তৎকালীন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জে, পি. গ্রান্ট ও বাংলা সরকারের সচীব ডব্লু, এস, সিটনকারের সঙ্গে লঙের ব্যাক্তিগত সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন এই দুই রাজ কর্মচারীকে নীলদর্পণের কাহিনী শুনিয়ে সরকারী উদ্যোগে নাটকটি ইংরেজী অনুবাদ, মুদ্রণ ও প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন স্বয়ং লঙ নিজে। কিন্তু ইংল্যান্ডে নীল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রভাবশালী মহল প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। কাজেই নীল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাংলাদেশের নীলচাষীদের সংঘর্ষ যে নিছক আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা ছিলনা। এটি হৃদয়ঙ্গম করেই নীলচাষ সম্পর্কে তদন্তের জন্য সরকার তাৎক্ষণিক কমিশন বসিয়েছিলেন। ইতিহাসে এই কমিশন “ইন্ডিগো কমিশন” নামে সমধিক পরিচিত ছিল। এই কমিশনের সভাপতি ছিলেন তৎকালীন বাংলা সরকারের সচীব ডব্লু, এস, সিটনকার, নীলদর্পণ নাটকটির প্রকাশের আগেই “ইন্ডিগো কমিশনের” কাজ শেষ হয়েছিল। “ইন্ডিগো কমিশন” সে সময়ে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব না দিতে পারলেও এসব নীলচাষের নামে যে বর্ব্বরচিত অত্যাচার করা হয়েছিল কমিশনের রিপোর্টে তার সুস্পষ্ট উল্লেখ দেখা যায়।
বাংলাদেশের চাষীদের দুর্দিন মোচনে নীলদর্পণ প্রকাশের আগেই লঙ তার পদ্ধতিতে কাজ শুরু করেছিলেন। গ্রান্ট ও সিটনকার যে নীল ব্যবসায়ীদের আচরণে অসন্তুষ্ট ক্ষুব্ধ লঙ তা জানতেন। তাই তাদের সবুজ সংকেত পেয়েই তিনি নীলদর্পণ প্রকাশ ও অনুবাদের কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করে তুলেন। সুতরাং নীলদর্পণ নাটকের অনুবাদ ও প্রকাশের জন্য সেই সময়ই লঙের মানসিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল। শুধু প্রকাশক এবং ভূমিকাকার হিসেবে নীলদর্পণের ইংরেজী অনুবাদে লঙের নাম থাকলেও অনুবাদক যে স্বয়ং লঙ নিজে এ কথার যথেষ্ট প্রমাণও কারণ রয়েছে। নীলদর্পণ অনুবাদক হিসেবে বঙ্কিম চন্দ্র এবং তার সমকালীন কেউ কেউ মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাম উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন মৌলিক নাটক এবং অনুবাদক দুটিই এদেশীয় স্বজাতিরই কাজ। সেই জন্যই তারা সুপ্রিমকোর্টের অনুবাদক দোভাষী হিসেবে মধূসূদন দত্তের নাম উল্লেখ করেছেন (মধুসূদন দত্ত তখন মাদ্রাজ সুপ্রিমকোর্টের দোভাষী অনুবাদক হিসেবে কাজ করতেন) এবং তিনি নিজেও একজন স্বনামধন্য নাট্যকার তাই যুক্তি সঙ্গত বিচারে নীলদর্পণ ইংরেজী অনুবাদক হিসেবে তার নাম এসেছে। এছাড়াও উচ্চতর আদালতে আর একজন ভাষাবিদ কর্মীর নাম পাওয়া যায় তিনি হলেন শ্যামাচরণ শর্মা। নীলদর্পণের ইংরেজী অনুবাদক হিসেবে আরেকজনের নাম একজন গবেষক উল্লেখ করেছেন তিনি হলেন লঙের সহকারী আলেক জাণ্ডার ডাফ। এছাড়া নদীয়া চার্চের রেভারেন্ড বোমওয়ে টচের নাম পাওয়া যায় নীলদর্পণের ইংরেজী নাটকের অনুবাদকারী হিসেবে। নীলদর্পণের ইংরেজী অনুবাদ যে বাঙালীর নয় বরং বিদেশীর সে প্রমাণ অনুবাদের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। নীলদর্পণ নাটকে “সড়কি” শব্দের অনুবাদ করা হয়েছে। Brick dust makers অর্থাৎ যে ইট গুড়ো করে। সুড়কি বানায়, এ রকম অনুবাদ বাঙালী মধুসূদন বা শ্যামাচরণের পক্ষে সম্ভব নয়। সড়কি যেমন সুড়কি প্রস্তুতকারক হয়েছে। তেমনি নাটকটির অনুবাদ আরও অনেক বিস্তর গলদ আছে। সুতরাং মধুসূদন শ্যামাচরণ বদলে এ ধরণের ভুলভ্রান্তি লঙ, ডাফ ও বোমওয়ে টচের কলম থেকেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশী বলেই প্রতীয়মান হয়।
খুব অল্প সময়ের বিচারে ১৮৬১ সালের ২৪ জুলাই, কোলকাতার সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি স্যার মর্ডান্ট ওয়েলস এর রায়ে রেভারেন্ট জেমস্ লঙের ১০০০ হাজার টাকা জরিমানা এবং একমাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রসহ কোলকাতার বহু খ্যাতিমান মানুষ সেদিন বিচারালয়ে উপস্থিত ছিলেন, বিজ্ঞ বিচারপতির রায় শুনে লঙের বদলে দীনবন্ধু মিত্র সেদিন কারাগারে যেতে চেয়েছিলেন। মহাভারতের অনুবাদক কালীপ্রসন্ন সিংহ জরিমানার ১০০০ হাজার টাকা তৎক্ষণাৎ আদালতে জমা দিয়েছিলেন। বিচারের রায় শুনে রেভারেন্ড জেমস্ লঙ নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ ও নিরপরাধ ঘোষণা করে বলেছিলেন যে, সাধারণ মানুষের জন্য তিনি যা করেছেন দরকার হলে সেরূপ কাজ আবারও করবেন। ভারতীয় কৃষকদের আর্থসামাজিক মুক্তি ছাড়া যে সমাজসংস্কারক, শিক্ষা ও সকল প্রকল্পের কাজ সিসি ফাসের” ন্যায় ব্যর্থ, উদ্দেশ্যহীন হয়ে যাবে নীলদর্পণ নাটকের ভূমিকাতেও লঙ সেকথারও সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। স্ত্রী ক্রিশ্চিয়ানাকে নিয়ে কোলকাতার প্রেসিডেন্সী জেলের দোতলার একটি সাধারণ কক্ষে লঙ একমাস অতিবাহিত করেন।
নীলদর্পণ মামলার বাদী “ল্যান্ড হোল্ডার্স অ্যান্ড কমার্শিয়াল অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া” আদালতে তাদের জয়ে প্রবল উল্লাসিত হয়ে তৎকালীন বাংলা সরকারের সচীব ডব্লু, এস, সিটনকারের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। অ্যাসেসিয়েশনের সম্পাদক ডব্লু, এফ, ফার্গুসন নীলদর্পণ মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও আদালতে লঙের শাস্তির বিবরণ উল্লেখ করে ইংল্যান্ডে যারা ইংরেজী নীলদর্পণ পেয়েছিলেন তাদের কাছে পত্র লিখেন। ফার্গুসনের এই চিঠি প্রাপ্তিতে তৎকালীন সুুপ্রিমকোর্টের প্রধানবিচারপতি স্যার বার্নেস পিক্ক গ্রান্ট ও সিটনকারের বিরুদ্ধে চরম দায়িত্বহীনতা এবং পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনেন, এতে তৎকালীন বাংলার গভর্নর গ্রান্ট, বাংলা সরকারের তৎকালীন সচীব সিটনকারকে জনগণের সম্মুখে দারুণভাবে নিন্দিত ও অপমানিত হতে হয়েছিল এবং অচিরেই সিটনকারকে বাংলার সচীব এবং আইনসভার সদস্যপদ ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছিলো। প্রধান বিচারপতি বার্নেস পিকক বাংলার গভর্নর জে, পি, গ্রান্টকে সুপ্রিমকোর্ট একটাকা জরিমানা করেছিলেন।
রেভারেন্স জেমস্ লঙের শাস্তিতে উৎসাহিত হয়ে নদীয়ার বিখ্যাত নীলব্যবসায়ী আর্চিবল্ড হিল্স ১০,০০০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে তৎকালীন “হিন্দু পেট্রিয়টের” সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যয়ের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা রুজু করেছিলেন। মামলা শেষ হওয়ার আগেই নিঃসঙ্গ, কপর্দকহীন হয়ে হরিশচন্দ্র নিদারুণ দারিদ্রের মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হরিশচন্দ্রের বিধবা স্ত্রীকে আদালত ১০০০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলো। ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা কেশব সেন সেই জরিমানার ১০০০ হাজার টাকা আদালতে জমা দিয়েছিলেন। সে সময়ে লঙের মুক্তির দাবীতে দেশবাসীর নিকট থেকে প্রায় ত্রিশ হাজার স্বাক্ষর সমেত একটি দাবীপত্র তৈরি করা হয়েছিল সরকারী কর্তৃপক্ষকে দেয়ার জন্য। কিন্তু লঙের নির্দেশে সেই দাবীপত্র আর দেয়া হয় নাই।
বিচার চলাকালীন সময়ে লঙ অনূধাবন করতে পেরেছিলেন স্বজাতির নিকট তাঁর শাস্তি অবধারিত রেহাই নেই। আত্মপক্ষ সমর্থন করে “লঙ” একটি বই লিখেন “ষ্ট্রাইক বাট হিয়ার” অর্থাৎ আঘাত করো কিন্তু আমার কথায় কান দাও। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে লঙের এই পুস্তকটি প্রকাশিত হয়। বইটির শেষে লঙ একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়েছিলেন প্রবচনটি হলো-
“Open the mouth, Judge right eously plead for the poor and needly” “দুস্থ অভাবী মানুষের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে তাদের ন্যায় সঙ্গত প্রশ্নগুলির সুমীমাংসা করতে হবে”। ১৮৭২ সালের ২০ শে মার্চ লঙ চিরকালের মতো ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ভারত ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে যান। তাকে বিদায় জানাতে কলকাতার জাহাজঘাটে এক বিশাল জনতার সমাবেশ হয়েছিল। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ২৩ মার্চ রেভারেন্ড জেমস্ লঙ নিজ দেশে ইংল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে, পরিচর্যায় সেকালে বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালী সমাজ আত্মসচেতন, সবাক ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তাদেরই অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক, মানবদরদী ছিলেন রেভারেন্ড জেমস্ লঙ। ধর্মপ্রচারক হিসেবে এদেশে এলেও তিনি ছিলেন মূলত নৃ ও পুরাতাত্ত্বিক, বহুভাষাবিদ, সমাজ গবেষক, সাংবাদিক, গ্রন্থাগার আন্দোলনের স্রষ্টা, শিক্ষাব্রতী ও উচ্চমার্গের মানুষ সর্বপোরি তার পরিচয় তিনি মানবতবাদী, ভারতপ্রেমী রেভারেন্ড জেমস্ লঙ। নীলদর্পণ নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার পরে (১৮৬৯ খ্রি.) তৎকালীন বাউল কবির একটি গানে বাঙ্গালী ও বাঙ্গালীর সামাজিক প্রেক্ষাপটের একটি করুণ চিত্র সে সময়ে আমরা দেখতে পাই যেখানে মানবদরদী লঙের নাম উঠে এসেছে-
“নীল বানরে সোনার বাংলা
করলে এবার ছারেখার,
অসময়ে হরিশ মলো,
লঙ এর হ’লো কারাগার।
প্রজা এবার প্রাণ বাঁচানো ভার ॥”
নীলদর্পণ গ্রন্থের জন্য পাদ্রী লঙ সাহেব কারারুদ্ধ হয়েছিলেন বলেই হোক অথবা এর কোনো বিশেষ গুণ থাকার নিমিত্তেই হোক, নীলদর্পণ ইউরোপের অনেক ভাষায় অনুবাদিত ও পঠিত হয়েছিল। এই সৌভাগ্য বাংলার আর কোনো গ্রন্থেরই ঘটে নাই। বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রথম শ্রেষ্ঠ সমাজ সচেতন নাটক “নীলদর্পণের” প্রকাশক ও সম্ভবত অনুবাদক হিসেবে লঙ চিরকাল বাঙ্গালীর মনিকোঠায় আজীবন বেঁচে থাকবেন। বাংলার নীল বিদ্রোহ বাঙ্গালী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরবর্তী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পূর্বসুরী আর কৃষকদের অনাগত দিনের বহু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের জনক।
আজ আর এদেশে নীলের চাষ নেই। প্রজারা আজ উৎপীড়িত হয়না নীলকরদের নিকট। তবুও প্রাচীন লোকেরা আজও নীলকরদের বর্বোরোচিত অত্যাচার ও জুলুমের কথা মনে করে শিহরিত হয়ে ওঠেন।
নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচারের কাহিনী গ্রাম বাংলার জীবনকে তখন ভয়াবহ ও দূর্বিসহ করে তুলেছিলো। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক সে সময় বাংলার অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো।
সমাজ চিন্তার মধ্যেই রাষ্ট্র চিন্তার খোরাক আছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সংযুক্তবোধ আমরা সর্বপ্রথম দেখতে পাই দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকে। দীনবন্ধু মিত্রকে বাংলার নাট্য আন্দোলনের ইতিহাসে বস্তুতান্ত্রিক শিল্পের একজন শ্রেষ্ঠ পথিকৃৎ হিসাবে গন্য করা যায়।
তথ্যসূত্র :
(১) ভারতবর্ষে নীল চাষ : হাফিজ উদ্দিন মুনশী, ভারত বিচিত্রা, দ্বাদশ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, আশ্বিন ১৩৯১ বঙ্গাব্দ।
(২) নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬১) : প্রবন্ধ, মফিজুল্লাহ কবীর।
(৩) যশোহর, খুলনার ইতিহাস (২য় খণ্ড) : সতীশচন্দ্র মিত্র।
লেখক : কলামিষ্ট, সাহিত্যিক, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ