শনিবার ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি

আকিব শিকদার 

জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে উদযাপিত হতে যাচ্ছে শিশু চিত্রশিল্পীদের নিয়ে আন্তজেলা চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা। আর্ট স্কুলগুলো তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে, পুরস্কার নিজেদের ঝুলিতে ভরে তারপর খ্যান্ত হবে। 

রংতুলি কিন্ডারগার্ডেনের ছাত্র চমক। চমকের উপর সারদের আস্থা আছে। অসুখ বিসুখ কিছু একটা না হয়ে গেলে সাফল্য নিশ্চিত। যত সমস্যার গুড়া হল অসুখ-বিসুখ। গতবছর প্রতিযোগিতার দুই দিন আগে হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়ল চমক। ডাক্তার জানালেন ডেঙ্গু। মশারির বাইরে যাওয়াই নিষেধ। চিত্রাঙ্কনে অংশগ্রহণ মাটি। পুরস্কার জিতে নিল হাতেখড়ি শিল্পনিকেতনের ছাত্রী অর্পিতা কুন্ডু। এই বছর যেন সেই অনাকাক্সিক্ষত দশা না ঘটে, সেদিকে সোচ্চার থাকবে চমক। 

অবশেষে গত রবিবার আর্ট ক্লাসে সাব্বির মোর্শেদ স্যার প্রতিযোগীদের হাতে এডমিট কার্ড তুলে দিলেন। সারের মুখেই জানা গেল আগামী দুসরা ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার শিল্পকলা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে প্রতিযোগিতা। সকাল দশটা থেকে শুরু হবে অংকন কর্ম।

যেদিন প্রবেশপত্রটা হাতের মুঠোয় পেল, সেদিন থেকেই চমকের বই-পত্র আলমারিতে সাজানো। খাতা-কলম নিয়ে অংক করতে বসে, কিন্তু অংকের পরিবর্তে খাতার পাতায় ফুল পাখির ছবি আঁকা হয়ে যায়। প্রাইভেট মাস্টারের হাতে কানমলা খায় ঠিকই, তবে ছবি আঁকার আনন্দও কম পায় না। 

বাবা বললেন- “চমক, তুমি কিন্তু আর্ট এর নাম ধরে লেখাপড়ার মাথা খাচ্ছো। এভাবে ফাঁকি দিলে পরীক্ষার খাতায় ঘোরার ডিম ছাড়া কিছু আর পাবে না।”

বাবার মেজাজ শুনে চমক মাথা নত করে থাকে। চমকের মা তার বাবার কানের পাশে মুখ নিয়ে চুপি চুপি বলে- “থাক; ওকে আর ধমক দিও না। প্রতিযোগিতাটা যাক, দেখবে ও ঠিকই আবার লেখাপড়ায় মন দেবে।” 

চমক মনেমনে একটা শক্ত প্রস্তুতি নেয়। এবারের প্রতিযোগিতায় তাকে প্রথম হতেই হবে। বাবাকে তাক লাগিয়ে দিয়ে তবেই শান্ত হবে সে। 

প্রতিযোগিতার আগের রাতে ঘড়ির কাটায় সবেমাত্র এগারোটা বেজেছে। বাবা মা ঘুমে অচেতন। চমক ভাবলো প্রস্তুতিটা আরেকটু চাঙ্গা করে নিলে মন্দ হয় না। এই মাঝরাতে ছেলে ছবি আঁকছে, বাবা যদি তা টের পায় তবে আর রক্ষে নেই। তাই চমক প্রায় বিড়ালের মতো নিঃশব্দে হেঁটে বাবা-মার শুবার ঘর পেড়িয়ে পড়ার ঘরে ঢুকে ভালো করে দরজা জানালা এঁটে নিলো। টেবিল ল্যাম্পের আবছা আলোয় আর্ট খাতাটা মেলিয়ে ধরে ছবি আঁকা শুরু হলো তার। গত পরশু ইংরেজি ক্লাসে স্যার যে পাখাওয়ালা মেয়ে মানুষটার কথা বলেছিল তাকেই থাকবে বলে মনস্থির করল সে। পেন্সিল দিয়ে মানুষ আঁকা শেষ এবং সেই বড় বড় ডানা দুটাও আঁকা হয়ে গেছে। এখন কেবল রং মেশানো বাকি। কী বিরম্বনা! পরীর ডানার পালকের রঙ কেমন হয় তা তো তার জানা নেই! এখন কী করা! ঠিক করল প্রজাপতির ডানার মতো শতরঙ্গা করে আঁকলে মন্দ হয় না। ডানা দুটাতে প্রথমে দিলো হলুদ রং, তারপর কমলা রং, তারপর লাল রং, নীল রং। তারপর সবুজ, আসমানী, বেগুনি, বাদামী, সোনালী একে একে সব কয়টা। পরীর ডান হাতে তারা মার্কা আশ্চর্য জাদুর লাঠি। মাথায় সোনার মুকুট তো আছেই। সাব্বির স্যার ক্লাস নেবার সময় বলেছিলেন- “খুদে চিত্রকরেরা, শুনো তোমরা, যে প্রাণী আঁকতে যাও না কেন, তার চোখ আঁকবে সবার শেষে।” স্যারের কথা মতো চমক পরীর চোখ দুটো আকল আঁকা-ঝুঁকি প্রায় শেষ হয়ে গেলে। ছবিটা দেখে মনে হলো নীল নীল ডাগর চোখে পরীটা চমকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। চমক ছবিটা স্তূপিবদ্ধ বই-পত্রের মাঝে হেলান দিয়ে রেখে নিজেই অবাক হলো এবং বলল- “বাহ! অসম্ভব সুন্দর হয়েছে তো দেখতে!” 

টেবিল ল্যাম্পের অল্প আলোতে আর্টখাতার মাঝখান থেকে পরীর চিত্রটা যেন আলতোভাবে নড়েচড়ে উঠলো। চিত্র থেকে চাঁদের আলোর মতো রুপালি আলো ছড়িয়ে পড়ল টেবিলের বিপরীত পাশটায়। চমক দেখলো সেখানে একটা জলজ্যান্ত পরী লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। 

পরীটা চমকের উদ্দেশ্যে কোমল গলায় বলল- “কী এত ভাবনা করছো? চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা নিয়ে ভেবো না। তুমি তো ছবি ভালোই আঁকো। তুমি ফার্স্ট হবেই হবে।” 

চমক বললো- “তবুও ভাবনা হয় যদি পরীক্ষায় ভালো আঁকতে না পারি। তবে তো আর প্রথম হতে পারব না।”

“আঁকতে পারবে না কেন! তুমি তো সাধনা করছোই। কঠোর সাধনা আর একাগ্র চিত্তে কাজ করে গেলে সাফল্য কেউ ঠেকাতে পারে না। আশা অনুযায়ী কাজ করার উদ্যম আছে যার, আল্লাহ তার মনোবাসনা পূর্ণ করেন।” 

চমক হাত কচলাতে কচলাতে বলল- “কিন্তু ভয় হয়, যদি সময়ের কাজ সময়মতো করতে না পারি।”

“এই একটা খাঁটি কথা বলেছ। সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। সময়ের কাজ সময়েই করতে হয়। তবে মনে রাখবে, তাড়াহুড়ো ব্যর্থতা ডেকে আনে। তাই কখনো তাড়াহুড়ো করতে নেই। তোমার আঁকা ছবি যেন হয় সুস্থ, সাবলীল, দৃষ্টিনন্দন এবং ঐতিহ্যপূর্ণ।” 

চমক জানতে চাইলো- “আগামীকালের প্রতিযোগিতায় আমার কী ধরনের ছবি আঁকা উচিত? নির্দেশনা পেলে উপকৃত হতাম।” 

পরী তার হাতের তারা মার্কা জাদুর কাঠিটা এপাশ-ওপাশ ঘুরাতে ঘুরাতে জবাব দিলো- “এরকম একটা পরামর্শ তোমাকে দেবো বলে ভাবছিলাম। প্রতিযোগিতায় মানুষ চিরাচরিত বিষয়ে চায় না, নতুনত্ব চায়। দুঃখকে বুকের খাঁচায় পোষতে ভালোবাসে তারা। বাংলাদেশ দরিদ্র কবলিত দেশ। মনে কর একজন মা তার জীর্ণশীর্ণ শিশুটিকে কোলে নিয়ে একটা থালা হাতে ভিক্ষা করছে। পারবে না আঁকতে? পারবে না আঁকতে এমন ছবি? জয়নুল আবেদিন তো দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেই কালজয়ী হয়ে আছেন।”

চমক যখন গত গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে ঢাকা শহরে চিড়িয়াখানা দেখতে গিয়ে মামার বাসায় বেরিয়ে এগারোসিন্দুর ট্রেনে চড়ে বাড়ি ফিরছিল, তখন ভৈরব স্টেশনে ট্রেন থামতেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেছিল একজন দরিদ্র মহিলা ছেঁড়া কাপড় পরা অবস্থায় একটা উলঙ্গ শিশুকে কোলে করে আর অন্য হাতে একটা বিবর্ণ সিলভারের থালা নিয়ে ভিক্ষা করছে। পরীর মুখের কথা শোনা-মাত্র চমকের চোখে সেই দৃশ্য জলছাপের মতো ভেসে উঠলো। চমক বাম দিকে ঘাড়টা একটু নিচু করে বলল- “হ্যা, পারবো। নিশ্চয়ই পারবো।” 

পরী সাহস যোগালো- “তোমার আত্মবিশ্বাস দেখে খুশি হলাম। যারা নিজের উপর বিশ্বাস রাখে, তারা যে কোনো কাজ অনায়াসে করতে পারে। অনেক রাত হয়ে গেছে এবার শুয়ে পড়ো। পরীক্ষার আগের রাত জাগতে নেই।” 

চমক দেখলো পরীটা চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। যাবার বেলায় বলল- “ঠান্ডা মাথায় চিত্র আঁকবে। তাড়াহুড়ো করবে না। কোন দুশ্চিন্তা যেন মাথায় খেলা না করে। নিজের উপর বিশ্বাস রেখে সময় মতো মনোযোগ দিয়ে কাজ করলে তোমার জয় নিশ্চিত।” চমকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পরীটা চলে গেল। 

ঘুম থেকে জেগে ওঠে চমক শুনলো বাইরে কাক ডাকছে, রাস্তায় দু-একটা সাইকেল-রিক্সা বেল বাজিয়ে চলাচল করছে, আর খবরের কাগজওয়ালা পেপার পেপার বলে চেঁচাচ্ছে। টেবিলের উপর একটা চমৎকার ছবি বই-পত্রের স্তূপে হেলান দিয়ে রাখা। রাতে পরীর সাথে কথা হয়েছিল, সেটা তার মনে আছে, এমনকি চোখে স্পষ্ট ভাসছে। কিন্তু সেটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব বুঝতে পারল না। 

সকাল দশটার দিকে একগাদা রংপেন্সিল, স্কেল-কম্পাস আর ক্যানভাস হাতে চমক যখন বাংলাদেশের দরিদ্রতার স্বরূপ বিষয়ে চিত্র আঁকছিল; তখন তার মগজে পরীর বলে যাওয়া উপদেশগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল। এতগুলো চিত্রশিল্পীর মাঝে প্রথম তাকে হতেই হবে। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ