রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

লিলিপুট

মাহমুদ শরীফ : বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে সাইফ। এবার অষ্টম  শ্রেণীতে পড়ছে সে। জেএসসি পরীক্ষার্থী। কিন্তু ওর শারীরিক গঠন দেখলে কেউই বিশ্বাস করতে চাইবে না এই লিলিপুট মার্কা ছেলেটির বয়স পনেরো বছর। কারণ- সাইফের উচ্চতা ওজন আর স্বাস্থ্য পনেরো বছরের একজন কিশোরের সাথে কিছুতেই বিন্দুমাত্র মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। অপরিচিত কেউ প্রথম দেখাতেই বলবে- ছেলেটির বয়স আর  কত হবে! সর্বোচ্চ ছয় কিংবা সাত বছর হতে পারে। এর কারণ, ছয় সাত বছর বয়োসী কিশোরদের গঠন, আকৃতি এবং স্বাস্থ্যের সাথে সাইফের গড়নে মিল করা যাবে বৈকি!
ওর বাবা একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। মাঠে দুই/ চার বিঘা আবাদী জমিও রয়েছে। গ্রামে বসবাস তাদের। বেশ সুখেই চলছে ওদের চার সদস্যের সংসার। সাইফের বড় বোন সুমাইয়া সিমু গত বছর এসএসসি পরীক্ষায় জোতমোড়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে অংশ নিয়ে যশোর বোর্ডের মধ্যে মেধা তালিকায় তৃতীয় হয়েছে। স্কুল এবং বাবা মায়ের আশা পূরণ করেছে সিমু। এই ভালো ফলাফলের জন্য দরবেশপুর গ্রামের এই ছোট পরিবারকে আশপাশের ৫/১০ গ্রামের মানুষ নতুন করে চিনেছে। বিভিন্ন মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে সিমুর বোর্ড স্ট্যান্ড করার খবরটি। মহেন্দ্রপুরে নতুন প্রতিষ্ঠিত আইডিয়াল কলেজের শিক্ষকরা তো সিমুকে অনেকটা জোর করেই তাদের কলেজে ভর্তি করিয়েছে। পিতামাতার আপত্তি সত্বেও শিক্ষকবৃন্দ তার পড়ালেখার যাবতীয় খরচ কলেজ বহন করবে বলে দিয়েছে ঘোষণা।
সাইফের লিলিপুট  মার্কা তালপাতার সিপাই শরীরে যে রোগ-বালাই বাসা বেঁধেছে তা কিন্তু প্রমাণিত নয়। পুষ্টিহীনতার জন্য ওর পরিবার দায়ী সেটাও বলা যাবে না। অবশ্য সাইফের একটিই সমস্যা ও খেতে চায় না। খাওয়ার প্রতি সাইফের রুচি কিংবা কোন আগ্রহ একদম নেই। খাবার সময় হলেই নানান ঢং, বিভিন্ন অজুহাত। এই পনেরো বছর বয়সে ছেলেকে রাতদিনে নিয়মিত কমপক্ষে তিনবার ভাত মেখে মুখে তুলে দিতে হয় মা শবনম খানমকে। এতে সাইফের মায়ের বিরোক্তিও কম নয়। মাঝেমাঝে তিনি ছেলের মুখের মধ্যে জোর করেই ভাত ঢুকিয়ে দেন। আদরের সুরে রাগ করেও বলেন-“এত বড় ছেলে, আজ প্রর্যন্ত নিজের হাতে খাওয়া শিখলোনা। আর কতদিন মুখে তুলে খাওয়াবো তোকে!” বড় বোন সিমুও বহুবার খাওয়াতে যেয়ে হয়েছে ব্যর্থ। বাবা শাজাহান আলী রাগ করেন মাঝে মাঝেই। রাগ করে বলেন-“থাক ওকে আর খাওয়া লাগবে না, খিদের জ্বালায় যখন পেট চো চো করবে, নাড়িতে টান লাগবে, তখন ঠিকই হাতে তুলে খাবে গপাগপ, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা....”।
ইতিপূর্বে  বাবা শাজাহান আলী ছেলেকে ২০/৩০ টাকা স্কুলে যাওয়ার সময় হাতে গুঁজেও দিয়েছে। এই ভেবে যে, বাড়িতে ভাত না খেলেও স্কুলের পাশের দোকান থেকে কিছু কিনে খাবে ইচ্ছেমত। কিন্তু এই টাকা দেওয়া থেরাপীতেও কোন কাজ হয়নি। সাইফ ঐ টাকা থেকে ২/৩ টাকার চকলেট বা চুইংগাম খেয়ে অবশিষ্ট টাকা আবার তার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল। তাছাড়া কোন আত্মীয়-স্বজন খুশি মনে সাইফকে টাকা দিলে সে সব টাকা মায়ের কাছে জমা করে রেখেছে।
শুধু ভাত মাছ গোস্ত ডিমের প্রতি যে ছেলেটার অনাগ্র তা নয়, শাজাহান আলী কুমারখালী বাজার থেকে আপেল কমলা বেদানা আম কলা নিয়ে এসে বড়িতে রাখলেও ছেলে সাইফ সেদিকে ফিরেও তাকায় না। ফলগুলো টেবিলের উপর পচে নষ্ট হয়। ছোট বেলায় আপেল কমলা দিয়ে ফুটবল খেলার বহু ঘটনা রয়েছে ছেলেটির। একমাত্র ছেলের খাওয়ার প্রতি এমন অনাগ্রহ আর অরুচি দেখে বাবা শাজাহান আলী কতবার যে রাগ করেছেন তার হিসেব নেই। ছেলেকে খাওয়ানোর সময় মা কত যে বকুনি দেয় সেটাও কেউ গুণে রাখেনি।
একদিন মা ইচ্ছে করেই সাইফকে মুখে তুলে খাওয়ানো থেকে বিরত থাকে। তাতেও কোন কাজ হয়নি। সারাদিন ভুল করেও সাইফ “খিদে লেগেছে খাবো,  মা খেতে দাও” এমন বাক্য মুখেও উচ্চারণ করেনি। রাতে না খেয়েই ঘুমাতে যাচ্ছে দেখে মা শবনম খানম ছেলের চিবুক ধরে খিস্তি খেউর করতে করতে পটাপট কয়েক লোকমা ভাত মেখে জোর করে ওর মুখে ঢুকিয়ে দেয়। সাইফ তার সভাব ভঙ্গিতে বিরক্তির সাথে কয়েক লোকমা খেয়ে “আর খাবো না, খেতে ভালো লাগছে না, পেট ভরে গেছে” বলে এ্যাঁ এ্যাঁ —-সুরে কান্না জুড়ে দেয়।
 সেদিনের পর থেকে শবনম খানমের চিন্তা বহু গুণে বেড়ে গেছে। কী হলো ছেলেটার! খাওয়ার প্রতি এই অরুচি সাইফের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ করছে নাতো? তাহলে ওর ভবিষ্যৎ কি হবে?
ইদানীং আরো একটি সমস্যা এসে জুটেছে। এ যেনো  “মরার ওপর খাঁড়ার ঘা”। আর সেটা হচ্ছে সাইফের সব কিছুতেই ভুলে যাওয়া । ভুলে যাওয়ার কারণে ওর উল্টো পাল্টা কাজ-কর্ম বাবা মাকে নতুন করে ফেলেছে চিন্তায়। অবশ্য তারুণ্য চটপটে চঞ্চলতা স¦ভাবের কোন কমতি হয়নি সাইফের আচরণ-ব্যবহারে।  হৈ হুল্লোড় আর হৈ  চৈ করতে সে বেশ কাজের লোক! তবে ভুলে যাওয়ার ঘটনা খুব বেশী ঘটেছে গত দেড় মাসের মধ্যে।
সাইফের ভুলে যাবার ঘটনা অনেক। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ফুটবল খেলতে যেয়ে ভুল করে নিজেদের গোল পোস্টে বল পাঠিয়ে গো-ও-ও-ও-ল-ল বলে আনন্দে চিৎকার দিয়ে ওঠা। স্কুলে যাওয়ার সময় নিজের স্কুল ব্যাগ না নিয়ে বড় বোনের ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে ভোঁ দৌড় দেওয়া। যাওয়ার সময় এক পায়ে জুতা অন্য পায়ে স্যান্ডেল পরা। অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষার খাতায় নিজের নাম না লিখে খাতা জমা দেওয়া। বিকালে স্কুলের মাঠে খেলতে যেয়ে দেড় মাসের মধ্যে চার জোড়া স্যান্ডেল রেখে বাড়ি চলে আসা। শার্ট গায়ে দেওয়ার সময় উল্টা করে গায়ে দেওয়া কিংবা উপরের বোতাম নিচে লাগানো। সবশেষে গতকাল সাইফ স্কুলে নিজের ক্লাস অষ্টম শ্রেণীতে না যেয়ে সপ্তম শ্রেণীতে ঢুকে পড়ে। এজাতীয় অনেক ভুলভাল কাণ্ড ঘটিয়ে সে হাসির পাত্র হতে চলেছে।
এসব উল্টোপাল্টা কাণ্ড আর ভুলে যাওয়ার বিষয়টি বেশ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে স্কুল পাড়ায়। ২/৪ জন দুষ্টু ছেলেরা সাইফকে ইতোমধ্যেই “ভোলানাথ, ভুলু” উপনামে ডাকতে শুরু করেছে।  আলাউদ্দিন আহমেদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে ডানপিটে আর দুষ্টুর রাজা বলে খ্যাত বাটুল বাবলু জোয়াদ্দার সাইফকে আদর করে কাছে ডাকে। সহানুভুতির সুরে দরদ মাখা কণ্ঠে বলে- “এই ভোলা বাবু! তুই খবরটা পাস নি! এখনও স্কুলে ঘুরছিস?
সাইফ জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে বাবলুর দিকে তাকায়। ভাবে এই তল্লাটে  জোয়াদ্দার বাবলুর দুষ্টুমির জুড়ি নেই। “কী খেয়েছিস”? জানতে চাইলে সে বমি করে দেখিয়ে দিয়েছিলো সেদিন। আর বলেছিলো- “কি কি খেয়েছি দেখে নাও, শোনার দরকার কি”? ইচ্ছে করে কেউ ওর ছায়া পর্যন্ত মাড়ায় না। এলাকার যাযাবর কুকুরগুলোও বাবলুকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে ডাকতে ছুটে পালায়। এরও কারণ আছে, বাবলু কুকুরের পিছনের ঠ্যাং ধরে মাথার  উপর  কয়েক চক্কর দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এজন্য কুকুরগুলো সব সময় নিরাপদ দূরত্বে ডাকতে ডাকতে পালায়। স্কুল ফাঁকি দিয়ে বন বাদাড়ে টই টই করে ঘুরে বেড়ানো কিংবা ঘুঘুর ডিম আর পাখির ছানা চুরি করায় বাবলুর জুড়ি নেই। পিতা তারিক জোয়াদ্দার এবং শিক্ষকবৃন্দ ওর জ্বালায় অতিষ্ঠ। শালিস করতে হয় প্রায় প্রতিদিন।
বাবলু আবার বলে-“ কিরে কথা বলছিস না কেনো? তুই কোন খবর টবর পাস নি, নাকি?
- কি খবর, জানতে চাই সাইফ।
 - কেনো তোর বাবা মার ছেলে পানিতে ডুবে মারা গেছে, তুই এই সংবাদ এখনও শুনিসনি?
কথাটি শুনেই সাইফের জানার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। উত্তেজনায় ছটফট করতে থাকে ও।
- কখন, কোথায় ডুবেছে? শুনেনি তো!
- আরে ভুলু! কিছুক্ষণ আগে গড়াই নদীতে ডুবে গেছে। তোর বাবা মা কত্ত কান্নাকাটি করছে আর তুই কিনা——-
- তাই নাকি! তাহলে আমি গেলাম। বলেই সাইফ স্কুলের ব্যাগ না নিয়ে তিড়িং বিড়িং করে হরিণের মতো দৌড় দেয়। আর দুষ্টু বাবলু  ওর দলবল নিয়ে হুল্লা দিয়ে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ে। আর বলে- “বোকারাম সাইফ তুই-ই তো তোর বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে হা হা হা হা——”
সাইফ এক দৌড়ে গড়াই নদীর তীরে এসে থামে। না  এখানে কেউ নেই। দুই সেকেন্ড ভেবে আবার ছোটে বাড়ির দিকে। বাড়িতে পৌঁছে মাকে ডাক দেয়। শবনম খানম ছেলের  হঠাৎ  আগমনে বিষ্মিত হয়। কিছু বলার আগেই সাইফ জিজ্ঞেস করে- মা তুমি নাকি কাঁদছো ?
- কেনো কাঁদবো?
- তোমার ছেলে নাকি পানিতে ডুবে মারা গেছে?
- কে বললো এসব কথা?
- বাবলু
এই বাবলু নামটি শুনে শবনম খানমের আর বুঝতে অসুবিধা হলো না তার ছেলের সাথে দুষ্টু বাবলু মজা করেছে। তিনি হাসি মুখে বললেন- আমার ছেলে কে বলোতো?
- কয়েক সেকেন্ড ভেবে সাইফ উত্তর দেয়- কেনো আমি, আমিই তো তোমার একমাত্র ছেলে।
- মা বললেন- তাহলে তুমি কি মারা গেছো?
সাইফ বললো- না।
- তাহলে আমি কাঁদবো কেনো?
এতক্ষণে সাইফের কাছে সব কিছু পরিষ্কার হয়। যেনো হুঁশ ফেরে ওর। সে যে পিতামাতার একমাত্র ছেলে সেটাই সে ভুলে গেছে। -বাবলু তার সাথে গুল মেরেছে এটা এখন আর বুঝতে বাকি নেই সাইফের।
শবনম খানম পিচ্চি ছেলেকে কোলে নিয়ে বারান্দার চেয়ারে বসিয়ে বলেন- ওই হতচ্ছাড়া বাবলু তোমার সাথে মসকরা করেছে সেটাও বুঝতে পারোনি! তুমি এখানে বসো বাবা, আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।
খাবারের কথা শুনে সাইফের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। মা রান্না ঘরে ঢুকতেই সাইফ এক লাফে উঠানে, তারপর এক নিশ্বাসে  স্কুলের দিকে ছুটে পালায়। মা খাবার নিয়ে  ফিরে এসে দেখে সাইফ উধাও।
রাতে ছেলের আজকেরসহ গত দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা আর ভুলে যাওয়ার কথা সাইফের মা স্বামী শাজাহান আলীকে জানিয়ে বলেন- আমাদের একমাত্র ছেলের এই অস¦াভাবিক পরিস্থিতির একটা সমাধান করা জরুরী । চোখের সামনে আমার সোনার মানিকটা দিনদিন শেষ হতে চলেছে, ও কি পাগল হয়ে যাচ্ছে! আমি আর এটা সহ্য করতে পারছি না। তুমি এর একটা বিহিত কর—। বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন শবনম খানম।
শাজাহান আলী স্ত্রীকে শান্তনা দিতে দিতে বলেন- সাইফের মা কেঁদো না, ছেলের এই অস¦াভাবিকতা কী আমি লক্ষ্য করিনি ভাবছো! ব্যাপারটি নিয়ে আমিও  চিন্তিত। গত শুক্রবার থেকে সাইফের নিয়ে আমি বেশ হতাশায় ভুগছি। এই তিনদিন ওর কথা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আমি—।
শুক্রবারের কথা শুনে শবনম খানম স্বামীর কথা শেষ না হতেই জানতে চায়- কেনো? শুক্রবারে আবার কি হয়েছিলো? ওই দিন তো তুমি সাইফের নানা বাড়ি শিলাইদহে গিয়েছিলে ওকে সাথে করে। সেখানে কি—।
স্ত্রীর কথা শেষ না হতেই শাজাহান আলী বলেন- আরে সেটাই তো বলছি শোন।
শবনম খানম অবাক দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে হা করে চেয়ে থাকে। তার বুঝতে আর অসুবিধা হয় না, ছেলেটি নানা বাড়িতে নিশ্চয় কোন একটা অঘটন ঘটিয়েছে।
“কি করেছিলো সেখানে?” জানতে চায় মা।
শাজাহান আলী পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য হাসতে হাসতে বলেন- কি আর হবে! তোমার ছেলে নানা বাড়ি যেয়ে নানীকে জড়িয়ে ধরে সেই আগের মতো স¦ভাবসুলভ ভঙ্গিতে। কিন্তু এবার নানীর বাহুডোর থেকে নিজেকে মুক্ত করে এক অবান্তর প্রশ্ন ছুঁড়ে বসলো ।
স্বামীর কথায় সাইফের মায়ের উৎকণ্ঠা আর আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। উত্তেজনায় তিনি স্থির থাকতে পারেন না যেনো। বলেন- তারপর! তারপর কি হলো?
শাজাহান আলী বললেন- কি আর হবে, নানীকে বিজ্ঞজনের মতো প্রশ্ন করে বসলো- আচ্ছা নানী, তুমি আমার কি হও?
 তোমার ছেলের প্রশ্ন শুনে আম্মা তো হতবাগ। ওর নানী বলেছিলো- কেনো? আমি তোমার কি হই তুমি সেটা জানো না?
সাইফ নাছোড় বান্দা। নানীর কাছে প্রশ্নের উত্তর তার চাইই চাই।
- নানী, নানী গো- বলো না, তুমি আমার কী হও?
- নানী জয়তুন নেছা খানম দাঁত পড়া মুখে ফোকলা হাসতে হাসতে নাতীর হাত বুলিয়ে বলেন- আমি তোমার নানী হই। সে জন্যই তো তুমি আমাকে নানী বলে ডাকো। নানী তো নানীই হয়, নানী আবার কি হবে!
 এবার সাইফ অনেকটা খুশিমনে শান্ত ভঙ্গিতে মুখে আস্তে করে উচ্চারণ করে- ওহ তাই, আমি ভাবছি অন্য কিছু হতেও পারো।
 সেই দিনের এই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি নিয়ে শাজাহান আলী বারবার ভেবেছে। কিন্তু সঠিক উত্তর খুঁজে পাননি। অফিসের সব চেয়ে কাছের মানুষ সোহাগ খানকেও বিষয়টি জানিয়েছেন। খান সাহেব শেষ পর্যন্ত “এটা ছেলের দুষ্টামি” বলে মন্তব্য  করেছিলেন। কিন্তু আজ স্ত্রীর মুখে গত দেড় মাসে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন লণ্ডভণ্ড মার্কা অঘটনের কথা শুনে তিনি আরো ঘাবড়ে গেলেন, চিন্তার পাহাড় মাথায় পড়লো যেনো। এর একটি বিহিত করা লাগবেই এবং খুবই জরুরী। না আর নয়, কালই বড় ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। সাইফের ডিমোশন রোধ করতেই হবে।
পরদিন মা বা ছেলেকে নিয়ে ডাক্তার শিহাব উদ্দিনের চেম্বারে হাজির হয়। ডাক্তার শিহাব সব কিছু শুনে কয়েকটি পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে প্রেসক্রিপশন করে দেন। প্রেসক্রিপশনের উপরে লিখে দেন সাইফের রোগের নাম ম্যারাসমাস বা অপুষ্টিজনিত সমস্যা। কয়েক মাস চিকিৎসা চলার পর সাইফের স্বাস্থ্য ও উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভুলে যাওয়ার ঘটনাও আর হয় না। সব কিছুতেই স্বাভাবিকতা ফিরে আসে সাইফের জীবনে। এখন আর ওকে জোর করে কিংবা মুখে তুলে খাওয়ানো লাগে না, নিজে নিজেই খায় এবং খেতে চায়। বাবা মা ভাবেন অনেক পূর্বেই ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত ছিলো। সন্তানের প্রতি অবহেলা করা মোটেও ঠিক হয়নি তাদের। সাইফ এখন খাওয়ার পাগল। সামনে যা পায় তাই গপাগপ মুখে পুরে নেয়। আর বলে- এতো দিন যা কম খেয়েছি সেগুলো এখন বেশি করে খাবো। খাওয়ার মজাইতো বড় মজা! খাবো আর পড়বো বুবুর মতো রেজাল্ট করবো। একমাত্র ছেলের এই অভাবনীয় পরিবর্তনে শাজাহান আলী ও তার স্ত্রী শবনম খানমের আনন্দ বহুগুনে বেড়ে যায়। তারা শুকরিয়া জ্ঞাপন করে স্রষ্টার দরবারে। জেএসসি পরীক্ষায় কিশোর সাইফুদ্দিন আলী সাইফও বোনের মত বোর্ড সেরা তৃতীয় স্থান অধিকার করে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ