শনিবার ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

আবারও ফাঁস প্রশ্নপত্র

কর্তাব্যক্তিদের হুমকিসহ সরকারের কঠোর মনোভাব থাকা সত্ত্বেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের কর্মকান্ডকে প্রতিহত করা সম্ভব হচ্ছে না। রাজধানী ও বড় বড় শহর-নগরীর পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও বরং পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। মোবাইলে মোবাইলে ছড়িয়ে পড়ছে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র। এক সময় একটি বা দুটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র কয়েকটি মাত্র স্থানে ফাঁস হতো। এসবের কোনো কোনোটি জাল বা ভুয়া বলেও জানা যেতো। সে কারণে ফাঁস হয়েছে শুনলেই পরীক্ষার্থী ও আগ্রহীরা ওই প্রশ্নপত্র পাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তো না। কিন্তু এখন চলছে ডিজিটাল যুগ। এখন আর আগের মতো জাল ও ভুয়া প্রশ্নপত্র ছাপানো এবং প্রচার করা সম্ভব নয়। মুহূর্তেই সেটা ধরা পড়ে যায়। জানাজানিও হয়। সে কারণে যতো ধূর্ত ও শক্তিশালীই হোক না কেন, কোনো চক্র বা গোষ্ঠীর পক্ষেই জাল ও ভুয়া প্রশ্নপত্র ছাপানো এবং সেগুলো বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। 

সম্ভব যে হচ্ছেও না সে বিষয়ে এবার প্রমাণ পাওয়া গেছে দিনাজপুর বোর্ডের অধীনস্থ বিভিন্ন এলাকায়। গতকাল ২২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী থানায় মামলা দায়ের করা হলে একটি গার্লস হাই স্কুলের হেড মাস্টার ও কেন্দ্রের সচিবসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কারাগারে পাঠানো হয় কেন্দ্র সচিব ও তিনজন সহকারী শিক্ষককে। মামলাটিতে প্রায় ১৫ জনকে আসামী করা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে তদন্ত চালানো হচ্ছে। জানানো হয়েছে, অন্য অভিযুক্তসহ সকলের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে পুলিশ। 

ওদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কারণে দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ডের গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, কৃষিশিক্ষা ও রসায়নের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। পরবর্তী কোনো সময়ে নতুন করে প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে এসবের পরীক্ষা নেয়া হবে। বোর্ড কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তকে অবশ্য যথেষ্ট মনে করা হচ্ছে না। কারণ, এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার প্রাক্কালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিল, দায়িত্বপ্রাপ্তদের মোবাইল ফোন না দেয়া এবং ইন্টারনেটের গতি কমানোসহ এবার এমন কিছু ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, যেগুলোর কারণে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার কোনো সুযোগ থাকবে না। অন্যদিকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রথম পরীক্ষার আগেই একটি বা দুটি নয়, ছয়-ছয়টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং দিনাজপুর বোর্ড কর্তৃপক্ষ যেসব বিষয়ের কথা জানিয়েছে সেগুলোর বাইরেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল।

উদ্বেগের কারণ হলো, এবারই প্রথম নয়, অতীতেও বেশ কয়েকবার বিভিন্ন বোর্ডের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২০১৮ এবং ২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষার সময় বিষয়ভিত্তিক সেট ধরে ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা এখনও সচেতন মানুষ মাত্রকে বিস্মিত ও স্তম্ভিত করে। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বোর্ড কর্তৃপক্ষও যে অসহায় হয়ে পড়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব জনাব আবু বকর ছিদ্দীকের একটি বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, “কাউকে না কাউকে দিয়ে তো কাজটি করাতে হবে। আমি কার ওপর বিশ্বাস রাখবো?”

বলা দরকার, শুনতে খারাপ লাগলেও সচিব মহোদয়ের বক্তব্যটুকুকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ ও বিবেচনা করা দরকার। কারণ, এবার দিনাজপুরের ঘটনায় দেখা গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস করার কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন একজন কেন্দ্রসচিবÑ নিরাপদে প্রশ্নপত্র পাঠানো যার দায়িত্ব ছিল। অন্যদিকে সে সচিবই প্রশ্নপত্র ফাঁসের কর্মকান্ডে অংশ তো নিয়েছেনই, নেতৃত্বও দিয়েছেন। এজন্যই শিক্ষা বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা অসহায় হয়ে পড়েছেন।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সবকিছুর পেছনে রয়েছে সরকারের ব্যর্থতা। মানতেই হবে, সরকার আসলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কর্মকান্ড প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে। একই কারণে আমাদের মধ্যেও উদ্বেগ বেড়ে চলেছে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে বহুবার বলেছেন এবং আমরাও মনে করি, লোক দেখানো এবং ক্ষতিকর হিসেবে প্রমাণিত কোনো ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে সরকারের উচিত প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি নিয়ে গভীর চিন্তা ও অনুসন্ধান করা। পদক্ষেপও নিতে হবে এমনভাবে, যাতে ফাঁসের কর্মকান্ডে জড়িত মূল ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়। দুঃখ ও উদ্বেগের কারণ হলো, এ ব্যাপারেও সরকার জাতিকে নিরাশই করেছে। অনুসন্ধাানের নামে মাঝে মধ্যে কমিটি গঠন করার বাইরে সরকারকে এমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি, যার ফলে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা প্রতিহত করা সম্ভব হবে।

আমরা মনে করি, দায়সারাভাবে আর যা-ই হোক, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কার্যক্রম বন্ধ বা প্রতিহত করা সম্ভব নয়। সরকারের উচিত, বিভিন্ন পর্যায়ে কয়েকটি পর্যন্ত তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের রহস্য অনুসন্ধান করা। প্রশ্নপত্র তৈরির কাজে জনাকয়েকের পরিবর্তে অনেক শিক্ষককে এমনভাবে জড়িত রাখা, যাতে তাদের নিজেদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক বা যোগাযোগ থাকতে না পারে। প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজও দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রেসে ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। এর ফলে ঠিক কোন প্রশ্নপত্রটি আসল এবং কোনটি ঠিক কোন বোর্ডের কোন পরীক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছেÑ এসব বিষয় তা কারো পক্ষে জেনে ফেলা সহজে সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়েও এমন স্বল্পসংখ্যক দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে রাখতে হবে, যারা কোনোভাবেই প্রশ্নপত্র ফাঁস করবেন না। করতে চাইলেও ধরা পড়ে যাবেন। এভাবে কয়েকটি ধাপে আয়োজন করা গেলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কর্মকান্ড প্রতিহত করা যেতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস। সেটাই সরকারের করা উচিত। কারণ, পরীক্ষা যে স্তরেরই হোক, তার সঙ্গে সমগ্র জাতির ভবিষ্যৎ জড়িত রয়েছে। কথাটা সরকারসহ সকলকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ