ইসলাম ও মানবাধিকার
তৌহিদুর রহমান
ইসলাম শুধুমাত্র ধর্ম নয়। বর একটা আদর্শের নাম। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র যেমন মতবাদ বা আদর্শ, ইসলামও সে ধরনের একটা মতবাদ বা আদর্শ। সমস্ত ভালো কাজই ইসলামে ইবাদত গণ্য হয়। রাস্তার একটা কাঁটা অপসারণও ইসলামে সওয়াবের কাজ। প্রতিবেশীর ঝগড়া মিটানোও সওয়াবের কাজ। যে মুসলিম যত ভালো কাজ করবে সমাজে সে তত বড় ধার্মিক। জ্ঞানার্জন ইসলামে সর্বাধিক একটা ভালো কাজ। কিন্তু নির্জনে জঙ্গলে বসে সারা জীবন আল্লাহর জিকির করা ইসলামে ভালো কাজ হিসাবে গণ্য নয়। মহান আল্লাহ এখানে বলেছেন, ‘মানব জাতির মধ্যে তোমরাই শ্রেষ্ঠ, যদি তোমরা মানব জাতির কল্যাণের জন্য কাজ করো।’ আল্লাহ কোথাও কিন্তু বলেননি, যদি তোমরা সারা জীবন আল্লাহ আল্লাহ করে জীবন পার করে দাও তাহলে দুনিয়াতে তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি। বৈরাগ্য সাধন বা ইসলামে বৈরাগ্যের কোন স্থান নেই। মহান আল্লাহ বলেছেন, ইকরা-পড়! আমাদের বুঝতে হবে একমাত্র পড়ার মাধ্যমে মানুষ দুনিয়াতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে। শুধু পড়া ও গবেষণার মাধ্যমেই চিকিৎসা বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, ভূ বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। যে যত বড় বিজ্ঞানী বা বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী মানব কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগও তার তত বেশি। আর একজন সৎ মুসলিম বিজ্ঞানীই পারে সমাজের সর্বাধিক কল্যাণ সাধন করতে। ইসলাম মানব কল্যাণের সমস্ত বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। সেজন্যই ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। ইসলাম জীবনের সব ব্যাপারেই পূর্ণাঙ্গ ও কালজয়ী চিরন্তন আদর্শ মতবাদ হিসেবে মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য স্পষ্ট নীতিমালা ও দিকনির্দেশনা দান করেছে।
বর্তমানে ওরিয়েন্টালিস্টরা যেভাবে বোমা মেরে মানবাধিকারের শিক্ষা দিচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে এক দিন হয়তো বোমা মেরে অধিকার আদায় করা মানবাধিকারের প্রধান শর্ত হয়ে দাঁড়াবে। গোয়ান্তানামো, আবুগারিব আজ ওরিয়েন্টালিস্টদের মানবাধিকারের শিক্ষাদানের প্রধানতম কারখানা। এসব কারাখানায় বন্দীদের ওপর সর্বনিকৃষ্ট রকমের নির্যাতন চালিয়ে বুঝানো হচ্ছে, বন্দী নির্যাতন হচ্ছে মানবাধিকার রক্ষার অন্যতম একটা শর্ত। আমরা দেখছি দুনিয়াতে যে যত অশান্তি সৃষ্টি করতে পারবেন তিনিই পাবেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। পশ্চিমাদের কাছে মানবাধিকারের লঙ্ঘনই হচ্ছে মানবাধিকার শিক্ষা দানের হাতিয়ার। আফগানিস্তানে মূর্তি ভাঙলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, অথচ বোমা মেরে লক্ষ লক্ষ শিশু, নারী ও মানুষ হত্যা করলে মানবাধিকার সুরক্ষিত হয়! ইরাকে টন টন বোমা ফেলে বুঝানো হচ্ছে, এগুলো মানবাধিকার রক্ষার হাতিয়ার। সাদ্দামকে ঈদের দিন ফাঁসি দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শাস্তি কত ভয়ঙ্কর হতে পারে! গাদ্দাফি, হোসনি মোবারকসহ প্রায় সব মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধানরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে দ-িতÑসমান অপরাধে অপরাধী মায়ানমার, চীন, ভারত, উত্তর কোরিয়া প্রভৃতি দেশের প্রধানরা! অথচ তাদের কোন শাস্তি পেতে হচ্ছে না। যত দোষ নিরপরাধ মুসলমানদের! হায়রে মানব সভ্যতা এর নাম কী মানবাধিকার!!
পাশ্চাত্য আজ বোমা মেরে নিরীহ মানুষ হত্যা করে, যুদ্ধবন্দীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে মানবাধিকারের শিক্ষা দিচ্ছে! অথচ ৬২৪ খৃস্টাব্দে মহানবী মুহাম্মদ স. বদর যুদ্ধের পর যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করেন, বিজয়ী সৈনিকরা না খেয়ে হলেও যুদ্ধবন্দীদের খাওয়াবেন। যুদ্ধবন্দী শত্রু হলেও সে যেহেতু মানুষ তাই তার সমস্ত মৌলিক ও ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
কোন যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা যাবে না। তাদের সাথে সর্বত্তোম ব্যবহার করতে হবে। যুদ্ধবন্দীদের অতিরিক্ত গরম ও ঠা-া থেকে রক্ষা করতে হবে। তারা কোন প্রকার কষ্ট অনুভব করলে দ্রুত তা দূর করতে হবে। বন্দীদের মধ্যে কোন মাকে তার সন্তান থেকে আলাদা করা যাবে না, কোন আত্মীয়কে তার থেকে আলাদা করা যাবে না। বন্দীদের মান মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। জোর করে বন্দীদের কাছ থেকে কোন কাজ আদায় করা যাবে না। চৌদ্দশ’ বছর আগে মুসলমানরা এসব নিয়ম-নীতি নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে। অথচ, নিয়তির কী নির্মম পরিহাস তাদেরকেই আজ বোমা মেরে মানবাধিকার শেখানো হচ্ছে!
ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর রা. সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে যাত্রার সময় নির্দেশ দিতেন, অর্থ-সম্পদ অপহরণ করবে না, তসরূপ করবে না, প্রতারণা করবে না। শিশু, নারী কিংবা বয়োবৃদ্ধকে হত্যা করবে না। ফলবান গাছ কাটবে না এবং ফসলের ক্ষেত পুড়িয়ে দেবে না। অন্য ধর্মের উপাসনালয় ধ্বংস করবে না।
হযরত ওমর রা.-এর নির্দেশ হলো, যুদ্ধে ভীরুতা প্রদর্শন করবে না। তোমার শক্তি থাকলেও কারো অঙ্গচ্ছেদ করবে না। বিজয়ী হলে বাড়াবাড়ি করবে না। বৃদ্ধ ও নাবালককে হত্যা করবে না। যুদ্ধের সময় শিশু, অসহায় নারী ও বৃদ্ধদের এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।
যাহোক, মানবাধিকারের বিষয়টি ইসলামে সর্বত্রই সমান। মানবজাতিকে ইসলাম গৌরব, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইসলাম মানুষকে সমান অধিকার, একতা, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। ইসলামে বংশ মর্যাদা, শ্রেণীবিভেদ, জাতিগত বিভেদ ও বর্ণবিভেদ হতে সতর্ক করেছে। দাস-দাসী ও অধীনস্থদের প্রতি সুন্দর ও ন্যায়ানুগ ব্যবহার করতে শিক্ষা দিয়েছে। ইসলাম সাদা-কালো, আরব-আজম সবাইকে সমান মর্যাদা দান করেছে। সবারই পিতা-মাতা হযরত আদম আ. ও হযরত হাওয়া আ.। সবাই আদি পিতা-মাতা হযরত আদম আ. ও হযরত হাওয়া আ.-এর সন্তান। সবারই দেহে একই রক্তধারা প্রবাহিত হচ্ছে। মানুষ সবাই ভাই ভাই। মর্যাদার দিক দিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকতে পারে না। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষ হিসেবে সবাই সমান মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী। মৌলিক অধিকার সবার সমান। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকারও সবার ক্ষেত্রে সমান।
ব্যক্তি স্বাধীনতাও সবার ক্ষেত্রে সমান। মর্যাদার দিক দিয়ে ইসলামে ধনী। গরীব সবাই সমান। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারও সবার ক্ষেত্রে এক। জানমালের নিরাপত্তার অধিকার একই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অর্থাৎ বাকস্বাধীনতা সবার ক্ষেত্রে এক। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ ইসলামে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সৎপথে উপার্জন করার অধিকারও ইসলামে সবার জন্য সমান। অসহায়, প্রতিবন্ধী, এতিম, মিসকিন, নারী ও শিশু অধিকার ইসলাম সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইসলামে প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে আর নিজে পেট পুরে খায় সে ব্যক্তি মুমিন নয়। কৃষক, মজুর, শ্রমিকের অধিকারও মূল্যায়িত হয়েছে গুরুত্ব সহকারে। শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগেই মজুরি পরিশোধের তাকিদ দিয়েছে ইসলাম।
চৌদ্দশ’ বছর আগে ইসলাম মানবাধিকারের স্পষ্ট নীতিমালা ঘোষণ করেছে। ৬২২ খৃস্টাব্দে বিদায় হজে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ স. যে অবিস্মরণীয় ভাষণ দিয়েছিলেন, তা ছিল মানবাধিকারের সর্বশ্রেষ্ঠ একটি দলিল। মহানবী মুহাম্মাদ স. সেদিন যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা হচ্ছে, ‘হে মানব সকল! অবশ্যই তোমাদের রব এক এবং তোমাদের পিতাও একজন। সুতরাং আজ থেকে কোনো আরবের ওপর কোন অনারবের প্রাধান্য নেই। সাদা মানুষের ওপর কালো মানুষের এবং কালো মানুষের ওপর সাদা মানুষের কোনোই শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একমাত্র আল্লাহভীতি ও মানব কল্যাণ হলো মর্যাদার একমাত্র মানদ-।’ তারপর তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘মনে রেখো! প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই, সবাই একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। কেউ কারো থেকে ছোট নয়, কারো থেকে কেউ বড়ও নয়। মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে সবাই সমান। নারী জাতির প্রতি অবহেলা করো না। নারীর ওপর পুরুষের যেধরনের অধিকার আছে, নারীরও পুরুষের ওপর সেধরনের অধিকার আছে। তাদের প্রতি অন্যায় অত্যাচার করো না। মনে রেখো! মহান আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদেরকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছ। সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে ইতিপূর্বে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।’
ইসলামে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কোন সুযোগ নেই। এরশাদ হয়েছে, ‘আপনি বলে দিন,...আমি যার ইবাদত করি তোমরা তার ইবাদতকারী নও। তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন আর আমার জন্য আমার দ্বীন।’(সূরা আল কাফিরুন, আয়াত ৫-৬) ইসলামী রাষ্ট্রে শান্তিপূর্ণভাবে প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ ধর্ম ও ধর্মীয় বিধি-বিধান পালন করতে পারে। তাতে কোনো প্রকারের বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারো নেই। ইসলামী রাষ্ট্রে সব ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ের সংরক্ষণের সুব্যবস্থা রয়েছে। কখনো ভিন্নধর্মের লোকদের জোর করে ইসলামে দাখিল করা যাবে না এবং তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও দেব-দেবী নিয়ে কটাক্ষ করা যাবে না। ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম ও সংখ্যালঘুদের সমান অধিকার ইসলাম নিশ্চিত করেছে। প্রথম লিখিত সংবিধান মদীনা সনদে বলা হয়েছে, ‘আজ থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকার ও মর্যাদা সমান। মদীনায় বসবাসরত ইহুদি, খৃস্টান, মূর্তিপূজারী ও মুসলমান সবাই একদেশি এবং সবাই সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউ অন্য কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না।
মুহাম্মদ স.-এর অনুমতি ছাড়া কেউ কারো সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারবে না। বাইরের শত্রুর দ্বারা মদীনা নগরী আক্রান্ত হলে সবাই সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবেলা করবে। এমনকি নিজেদের মধ্যে কোনো প্রকারের বিরোধ দেখা দিলে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে হবে।’
নারী-পুরুষ উভয়ের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার ইসলাম দিয়েছে। স্বামী যা উপার্জন করবে, তা স্বামীর অধিকারে থাকবে আবার স্ত্রী যা কিছু উপার্জন করবে, তা স্ত্রীর অধিকারে থাকবে। ইসলামী বিধান অনুযায়ী নারীরাও পুরুষদের মতো সম্পদের মালিক হবে। সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রেও নারীরা তাদের মৃত পিতা-মাতা, স্বামী ও সন্তানদের একটি নির্দিষ্ট অংশ আলাদাভাবে ভোগ-দখল করতে পারবে।
ইসলাম ধনীদের সম্পদে অসহায় ও মিসকিনদের অধিকার নিশ্চিত করেছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ধনীদের সম্পদে গরিব ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ (আল-যারিআত, আয়াত-১৯)
একজন মুমিন মুসলমানের মৌলিক গুণাবলি কখনো মানবাধিকারের সীমালঙ্ঘন করে না। ইসলাম এমনিভাবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানবজাতির সব রকমের মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করে সর্বাত্মক মানবাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।