সোমবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
Online Edition

১৯৭১ সালের সংবাদপত্র যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ

জিবলু রহমান

জাতীয় আর্কাইভসের প্রতিষ্ঠা ১৯৭২ সালে। নগরের আগারগাঁওয়ের জাতীয় আর্কাইভসের সুরম্য ভবনটি তখন ছিল না। একটি ভাড়া বাড়িতে শুরু হয় আর্কাইভসের কাজ। জাতীয় আর্কাইভস প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের দলিল-দস্তাবেজ সংগ্রহ। সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের দলিল সংগ্রহে একাধিক প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ ছিল। এই প্রতিযোগিতায় আর্কাইভস আর বেশিদূর এগোতে পারেনি। বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভসের গাইড বইয়ে আর্কাইভসের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-‘একটি দেশের ঐতিহাসিক গুণসম্পন্ন সব সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত দলিল ও নথিপত্র, পা-ুলিপি ও পুস্তকের সংরক্ষণাগার।’ 

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই সংরক্ষণাগারে তেমন কোনো দলিলই নেই। সে সময় প্রকাশিত কিছু দৈনিক পত্রিকাই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে আর্কাইভসের ভাঁড়ার পূর্ণ করে আছে।  (সূত্র : বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস-মুক্তিযুদ্ধের দলিল বলতে কিছু দৈনিক পত্রিকা! পার্থ শঙ্কর সাহা, দৈনিক প্রথম আলো ১৭ ডিসেম্বর ২০১৩)

মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকার, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল, প্রবাসী বাঙালি এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত নিয়মিত-অনিয়মিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সংবাদমাধ্যমে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা-বর্বরতা, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশা, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। অসংখ্য পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ-সম্পাদকীয়, কবিতা-গান, প্রবন্ধ-কার্টুন ইত্যাদির মাধ্যমে পাকিস্তানিদের নির্মম-নৃশংসতার নিন্দা-ক্ষোভ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন জানানো হয়।

স্বাধীনতার পরের প্রথম সরকার ছাড়া কোনো আমলেই দেশে এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত অজস্র দলিল সংগ্রহে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সরকারের উদ্যোগের অভাব, অপ্রতুল বরাদ্দ, প্রয়োজনীয় জনশক্তির অভাবের কারণে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নথি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮২ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্প’ এর কাছে মোট সাড়ে তিন লাখ পৃষ্ঠার দলিলপত্র মজুত ছিল। ১৯৮৮ সালের বন্যায় এর একটি বড়ো অংশ নষ্ট হয়ে যায়। রক্ষা পাওয়া অবশিষ্ট দলিল স্থান পায় জাতীয় জাদুঘরে। 

মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ৬৪টি পত্রিকা প্রকাশের তথ্য পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি দৈনিক এবং বেশিরভাগ সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, সাময়িক, বুলেটিন, ম্যাগাজিন, নিউজলেটার প্রভৃতি।

অপর দিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় কেবল মুক্তাঞ্চল থেকে ৬৫টি সাময়িকী বের হতো বলে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বইটিতে উল্লেখ আছে। স্বাধীন বাংলা সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম, রণাঙ্গণের খবরাখবর, শরণার্থীশিবিরের দুর্দশাসহ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নানা তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে মুক্তিযুদ্ধকালে উত্তর জনপদের মুক্তাঞ্চল নওগাঁ থেকে ‘দৈনিক জয় বাংলা’, ‘সাপ্তাহিক বঙ্গ বাণী’ ও ‘ইশতেহার’ নামে তিনটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। তবে নওগাঁর তরুণদের প্রকাশিত কাগজগুলোর কোনো সংখ্যা সরকারিভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। স্থানীয় কিছু মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতিকর্মী ও গবেষকদের কাছে ওই সব পত্রিকার কিছু সংখ্যা এখনো সংরক্ষিত রয়েছে।

‘জয় বাংলা’ পত্রিকাটির লেখা ছিল টাইপমেশিনে আর সাপ্তাহিক ‘বঙ্গ বাণী’ আজকের মতো আধুনিক ছাপানো কাগজের পত্রিকা ছিল। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ নওগাঁ মহকুমা শহর থেকে নিয়মিতভাবে দৈনিক জয় বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন এম এ রহমতউল্লাহ (প্রকৃত নাম এম এ জি হায়দার)। রহমতউল্লাহর জন্ম ১৯৪৬ সালে, রাজবাড়ি জেলায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে রহমতউল্লাহ নওগাঁয় এক ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

১৯৮৮ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকার বিজয় দিবস সংখ্যায় গবেষক আফসান চৌধুরী ‘স্বাধীন বাংলার পত্রপত্রিকা’ শিরোনামে এক নিবন্ধে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ষষ্ঠ খণ্ড: গণমাধ্যম, পৃষ্ঠা: ২’ এর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন-‘যুদ্ধ চলাকালে দেশে ও দেশের বাইরে জয় বাংলা নামে মুক্তিযুদ্ধের একাধিক বুলেটিন প্রকাশিত হলেও একই নামে নওগাঁ থেকে প্রকাশিত একটি বুলেটিন ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রকাশিত বুলেটিন।’

রহমতউল্লাহ সম্পাদিত একপাতা দৈনিক জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য মুখপত্র নামক বই থেকে জানা যায়- নওগাঁর তরুণ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার অনুপ্রেরণায় নওগাঁ শহরের কাজিপাড়া এলাকার টিনের চাল ও মুলিবাঁশের বেড়া সমৃদ্ধ একটি ঘরে পায়ে চালানো ট্রেডল মেশিন সংবলিত প্রেস থেকে এটি প্রকাশিত হতো। ১৪ এপ্রিল নওগাঁ শহরে হানাদার বাহিনী ঢুকে পড়ার আগপর্যন্ত এর প্রকাশনা অব্যাহত ছিল। (সূত্র : কলমসৈনিকদের অনন্য ‘যুদ্ধ’, ওমর ফারুক, দৈনিক প্রথম আলো ৩১ মার্চ ২০২১)

তথ্য-উপাত্ত বলছে, সাপ্তাহিক বঙ্গ বাণীর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের ২৩ মে। পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিল। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নওগাঁ সরকারি কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক খন্দকার মকবুল হোসেন এবং সহকারী সম্পাদক ছিলেন নওগাঁ সরকারি কলেজের আরেক শিক্ষক অধ্যাপক কৃষ্ণপদ সরকার।

পত্রিকায় সম্পাদক খন্দকার মকবুল হোসেন ছদ্মনাম হিসেবে ‘কে এম হোসেন’ ব্যবহার করেছিলেন। মুজিবনগর সরকারের দেওয়া পত্রিকাটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল ১০। সাপ্তাহের প্রতি রোববার নিয়মিতভাবে ২৬টি সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকাটির সর্বশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। বঙ্গ বাণী পত্রিকাটি নওগাঁ প্রেসের নামে ছাপা হলেও এটি প্রকাশিত হতো পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট সুনীতি প্রিন্টিং প্রেস থেকে। এর প্রতিটি কপির বিক্রয় মূল্য ছিল ১৫ (পয়সা)। 

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বহির্বিশ্বে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বঙ্গ বাণী পত্রিকাটির খবরগুলো ভারতের বিভিন্ন ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় ছাপানো হতো। মুক্তিযুদ্ধের বুলেটিন হিসেবে পত্রিকাটি সে সময় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় নওগাঁ শহরের কৃষ্ণধন (কেডি) হাইস্কুলের সাইক্লোস্টাইল মেশিন থেকে ছাপানো হতো ইশতেহার নামের সাপ্তাহিক পত্রিকা। ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ ছাপা হয় এর প্রথম সংখ্যা। মাত্র তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। ইশতেহার পত্রিকাটিতে প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে নির্দিষ্ট করে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। বীর মুক্তিযোদ্ধা আখতার আহম্মেদ সিদ্দিকী, শফিকুল ইসলাম খান, জহুরুল ইসলাম ঈদুলসহ বেশ কয়েকজন তরুণ পত্রিকাটি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

চার পৃষ্ঠার এই পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা থাকত কবি রঙ্গলালের বিখ্যাত কবিতার দুটি চরণ-

‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়!

দাসত্ব শৃঙ্খল পায় কে পরিতে চায় হে, কে পরিতে চায়?’ 

পত্রিকাটির মাত্র তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পরেই এর প্রকাশনা ও সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় পরবর্তী সময়ে এটি আর প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। 

মুক্তিযুদ্ধ, সোনার বাংলা, বিপ্লবী বাংলাদেশ, নতুন বাংলা, জাগ্রত বাংলা, অগ্রদূত, আমার দেশ, অভিযান, মুক্তি, দুর্জয় বাংলা, বাংলার মুখ, জন্মভূমি, সাাপ্তাহিক বাংলা, দাবানল, স্বাধীন বাংলা, The Bangladesh, The Nation, Bangladesh Today-সহ অনেক পত্রিকা-সংবাদমাধ্যম নিজ নিজ অবস্থান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

১৯৭১ সালের নির্বিচারে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী নিধন, লাখ লাখ নারী ধর্ষণের বিষয় আড়ালে রেখে ধর্মের দোহাই দিয়ে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করেছিল পাকিস্তান। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের দ্বারপ্রান্তে যখন বাংলাদেশ, তখন মরণকামড় দিতে মরিয়া পাকিস্তান নিজ দেশে জাতীয় প্রতিরক্ষা তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহে সংবাদপত্রগুলোতে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করে। অতীতের ধর্মীয় যুদ্ধে ইসলামের খলিফাদের সম্পদ দানের উদাহরণও টানা হয় ওই সব বিজ্ঞাপনে।

‘প্রত্যেক পাকিস্তানির কাছে আবেদন’ শিরোনামের একটি বিজ্ঞাপনে বলা হয়-‘নবীজির সময়ে যখন জিহাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা হয়, তখন হজরত আবু বকর (রা.) তাঁর সবকিছুই দান করে দেন এবং হজরত উমর (রা.) তাঁর সম্পদের অর্ধেক দান করেন। আজ আমরা ধনী, গরিব, ব্যবসায়ী, ভূস্বামী প্রত্যেক পাকিস্তানির কাছে আবেদন জানাচ্ছি, তারা যেন তাদের সম্পদের কমপক্ষে ১০ শতাংশ দান করেন। যাঁরা বেশি দান করবেন, তাঁরা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে পুরস্কার পাবেন। আজ আমাদের নির্ভীক সেনারা আমাদের সুরক্ষার জন্য, মাতৃভূমির জন্য জীবন দান করছেন। সৈনিকদের হাতকে শক্তিশালী করতে আমরা অবশ্যই দান করব এবং উদারভাবে দান করব প্রতিরক্ষা তহবিলে।’

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে সেসব বিজ্ঞাপন দেয় বিভিন্ন পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক। ১৯৭১ সালের ১৪ থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডন পত্রিকায় এই বিজ্ঞাপনগুলো প্রচার করা হয়। প্রায় প্রতিটি বিজ্ঞাপনে মুক্তিযুদ্ধকে শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ উল্লেখ করে ধর্মকে টেনে আনা হয়। প্রত্যেক শ্রেণির মানুষকে তাদের সম্পদের কমপক্ষে ১০% দান করার আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞাপনগুলোতে বলা হয়Ñ‘বেশি দান করলে আল্লাহ পুরস্কার দেবেন।’

‘জিহাদ’ শিরোনামে হাবিব ব্যাংকের বিজ্ঞাপনে বলা হয়Ñ ‘যখন মুসলিমরা জিহাদ পরিস্থিতিতে থাকেন, তখন সম্পূর্ণ সংহতি প্রকাশের সময় হয়ে যায়। আসুন, আমরা প্রত্যেকে সেই কাজ করি...। 

হাবিব ব্যাংক জাতীয় প্রতিরক্ষা তহবিলে ২ কোটি ৪৬ লাখ রুপি দিয়েছে। হাবিব ব্যাংকের কর্মীরা শুধু তাদের বেতন থেকেই অর্থ দেননি, বরং তারা বাইরে থেকেও তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছে। হাবিব ব্যাংকের সব শাখায় দান নেওয়া হচ্ছে।’

২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর ডন ডটকম আর্কাইভে সংরক্ষিত এই বিজ্ঞাপনগুলো প্রকাশ করে। পরের বছর ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাতে আরও তথ্য যুক্ত করে হালনাগাদ করা হয়। এটাকে ‘অন্ধকার সময়’ উল্লেখ করে ডন ডটকমে বলা হয়Ñ‘সংবাদপত্রে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে উঠে এসেছে অতীতের অন্ধকার সময়ের এক ঝলক।’ (সূত্র : ৭১-এ মরিয়া পাকিস্তান দ্বারস্থ বিজ্ঞাপনের, নাজনীন আখতার, দৈনিক প্রথম আলো ২৬ মার্চ ২০১৮)

কিছু বিজ্ঞাপনে কোটি কোটি রুপি দান করার বিষয়টি উল্লেখ করা ছিল। তবে এসব বিজ্ঞাপন স্বেচ্ছায় নাকি, পাকিস্তানি শাসক বাধ্য করেছিল, তা যাচাই করা যায়নি। এসব ইংরেজি বিজ্ঞাপনের বাইরে উর্দু ভাষায় অন্যান্য স্থানীয় পত্রিকায় এ ধরনের কত বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছিল, সে তথ্যও নিশ্চিত করা যায়নি।

সাবান প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ডারবার সোপ ওয়ার্কস লিমিটেডের বিজ্ঞাপনে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য প্রচার করে বলা হয়-‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর অঙ্গীকার স্মরণ করুন যে ন্যায়বিচারের পথে আপনি যদি অটল হন, তবে আল্লাহ আপনাকে চূড়ান্ত বিজয় দান করবেন। আল্লাহ আকবর বলে এগিয়ে যান, শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ুন। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’

পাকট্র্যাক (করাচি, লাহোর ও ঢাকা) ব্যানারে প্রচারিত আরেকটি বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল এমনÑ‘শত্রুকে পুরো ধ্বংস করুন। জাতীয় প্রতিরক্ষা তহবিলে মুজাহিদের মতো দান করুন।’

রিজভি ব্রাদার্স লিমিটেডের আরেকটি বিজ্ঞাপনে বলা হয়-‘ ইসলামের ঐতিহ্য অনুসারে সত্যিকারের যোদ্ধার মতো আমাদের নির্ভীক সেনারা পাকিস্তানের পবিত্র ভূমি রক্ষার জন্য লড়াই করছে।’ 

একই প্রতিষ্ঠানের পৃথক বিজ্ঞাপনে বলা হয়-‘আমাদের সাহসী যোদ্ধারা শত্রুক নির্মূল করছে, পুরো জাতি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে পর্বতের মতো। সর্বশক্তিমান আল্লাহর সহায়তায় কাপুরুষ শত্রুক চূর্ণ করে আমরা পরাজিত করব ইনশা আল্লাহ।’

জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ছবি ও যুদ্ধরত সৈনিকদের ছবি ব্যবহার করে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক বিজ্ঞাপন প্রচারে। ওই বিজ্ঞাপনে ইয়াহিয়ার বাণী প্রচার করে বলা হয়-‘দিন ও রাতের প্রত্যেক সময়ে, আপনার অবশ্যই নিজেকে একটি প্রশ্ন করা উচিত: জাতীয় যুদ্ধে আমি কী অবদান রাখছি?’

তহবিলে অর্থ দান করার আবেদন জানিয়ে ইউনাইটেড ব্যাংক বিজ্ঞাপনে জানায়-তারা ১ কোটি ৩২ লাখ রুপি দান করেছে। বিজ্ঞাপনটির ভাষা ছিল এমন-‘এই যুদ্ধে আমাদের প্রত্যেকের অংশ নেওয়া দায়িত্ব। আমাদের গাজিরা মাতৃভূমিকে রক্ষা করছে, তাদের সফলতার জন্য আমাদের অবদান রাখতে হবে।’

তহবিলে অর্থ দেওয়ার আবেদন জানিয়ে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের বিজ্ঞাপনের শিরোনাম ছিল-‘সিলভার বুলেট।’ বিজ্ঞাপনে বলা হয়-১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কায়েদ-ই-আজম (মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদ-ই-আজম বলা হয়) বলেছিলেন, ‘আমাকে সিলভার বুলেট দাও এবং আমি তোমাদের পাকিস্তান দেব।’ পবিত্র ভূমির সম্মান ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য রুপালি বুলেটের আবারও প্রয়োজন আজ।’

একই ব্যাংকের আরেক বিজ্ঞাপনে কায়েদ-ই-আজমের বাণী তুলে ধরা হয়-‘মুসলিমরা কখনো ধ্বংস হতে পারেন না। গত এক হাজার বছরেও কোনো শক্তি তাদের ধ্বংস করতে পারেনি। এটা স্বপ্ন ও অলীক ভাবনা। ঝেড়ে ফেলুন তা...আমাদের ধর্ম, আমাদের সংস্কৃতি এবং আমাদের ইসলামি আদর্শ আমাদের পরিচালনাকারী শক্তি...।’ 

করাচির এক পোশাক বিক্রির প্রতিষ্ঠান আফতাব শফিক ওমর শফিক অ্যান্ড ব্রাদার্স পোশাক কেনার মাধ্যমে তহবিলে অর্থ দান করে নারীদেরও জিহাদের অংশ হওয়ার আবেদন জানিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করে।

facebook.com/5.5.78jiblurahmannewpage

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ