স্বাধীনতার নেপথ্য ও গন্তব্য
সৈয়দ জাফর ইকবাল
ধীনতা কখনো নির্বিঘ্ন হয় না; উপহারও দেয় না কেউ বরং নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অনেক ত্যাগ ও কুরবানির বিনিময়ে তা অর্জন করে নিতে হয়। আমাদের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি বরং বেশ চড়া মূল্য দিয়েই আমাদেরকে স্বাধীনতা কিনতে হয়েছে। মূলত, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, আইনের শাসন ও অবাধ গণতান্ত্রিক অধিকারই ছিল মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার চেতনা। এসব দাবি আদায়ের জন্যই আমাদেরকে মরণপণ মুক্তিসংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। সে নেপথ্যের পথ ধরেই আজকের এই স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ ও লালসবুজের পতাকার উত্থান। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গন্তব্যকে সামনে রেখে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন, স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পরও আমাদের পক্ষে সেই কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পুরোপুরি পৌঁছা সম্ভব হয়নি। যা আমাদের জাতীয় ব্যর্থতায় বলতে হবে।
ইতিহাসের গতিধারায় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় পাকিস্তানের রাজনীতিতে অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে এক অভাবনীয় নাটকীয়তায় ও রূঢ় বাস্তবতায় বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। যেসব কারণে আমরা পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ি এবং সে অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মুক্তি সংগ্রামে অবতীর্ণ হই, মূলত সেগুলোই স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু, গন্তব্যহীন, ক্ষমতাকেন্দ্রীক ও নেতিবাচক রাজনীতির কারণেই এক্ষেত্রে বড় ধরনের বিচ্যুতি ঘটেছে। এখন শ্রেণিবিশেষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়গুলোকে স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে একাকার করে ফেলা হয়েছে। পরিকল্পিত ভাবেই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে বহুধাবিভক্ত করা হয়েছে। যা আমাদের জাতিসত্তার ভিত্তিমূলকেই দুর্বল ও ভঙ্গুর করে দিয়েছে।
স্বাধীনতা মূলত একটি শর্ত; যেখানে একটি জাতি, দেশ-রাষ্ট্র বা ভূখণ্ড ও জনগণ থাকবে, থাকবে নিজস্ব শাসনব্যবস্থা এবং সার্বভৌমত্ব। কিন্তু স্বাধীনতা কোনভাবেই স্বেচ্ছাচারিতা নয় বরং তা বিধি-বিধান, সংবিধান ও আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর স্বাধীনতা প্রতিটি জাতির জন্যই আরাধ্য। কিন্তু স্বাধীনতা এমনিতেই আসে না বা কোন দান-দক্ষিণার বিষয় নয় বরং তা আদায় করে নিতে হয়। সে ধারাবাহিকতায় আমাদেরকেও ১৯৭১ সালে অনেক উচ্চ মূল্যে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে।
স্বাধীনতার চেতনার ক্ষেত্রে প্রথম বিবেচ্য হচ্ছে-আমাদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রশ্ন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও স্বতন্ত্র সত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগ এবং বাংলা ভাষাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি আদায় এর উদাহরণ। বস্তুত, ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই আমাদের স্বাধিকারের চেতনার উন্মেষ ঘটে এবং ১৯৭১ সালে তা মুক্তি সংগ্রাম এবং বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ নামের নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পথ সুগম করে।
স্বাধীনতার চেতনার একটি ছিল বৈষম্যের অবসান। তদানীন্তন শাসকচক্র আমাদের সরকারি দায়িত্বপূর্ণ পদ ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন করেছে শুরু থেকেই। ফলে পূর্ব বাংলার মানুষরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। পাক শাসকচক্রের পক্ষপাতমূলক আচরণ, অবিচার, নির্যাতন-নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনার ফলে আমরা নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করতে বাধ্য হয়েছিলাম। ফলে পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে একটা গণ-অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়। এতে মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অনিবার্য হয়ে ওঠে।
আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, নিজস্ব স্বকীয়তা রক্ষা, বৈষম্যের অবসান ও সামাজিক অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্তির জন্য আমাদের পৃথক রাষ্ট্রকাঠামো প্রয়োজন; যার শাসন ও পরিচালন ভার নিতে হবে নিজেদেরই। ফলে এক অনিবার্য বাস্তবতায় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই পাকিস্তান ভূখণ্ডের পূর্ব অংশ আলাদা হয়ে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ ও লালন করে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুরাষ্ট্রের নাম দেয়া হয়েছিল ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণের নিজেদের শাসন করার অধিকারসহ একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড, যেখানে বাংলাদেশীরা নিজেদের বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা নিয়ে সব ধরনের বৈষম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারপরিপন্থী কর্মকা- থেকে মুক্ত থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও তার ভিত্তিতে সৃষ্ট বাংলাদেশের দু’টি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-প্রথমত, বাংলাদেশ হবে জনগণের এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত দেশ। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ হবে সব ধরনের বৈষম্যমুক্ত, অন্যায়-অবিচার ও শোষণমুক্ত। অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
আমাদের সংবিধানেও এটা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় প্যারায় বলা হয়েছে-‘আমরা আরো অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ অনুচ্ছেদ ১-এ বলা হয়েছে- ‘বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা ‘গণপ্রজতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হইবে।’ ৭ অনুচ্ছেদের দফা-১ এ বলা হয়েছে-‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্ব কার্যকর হইবে।’
সাংবিধানিকভাবেই বাংলাদেশ জনগণের রাষ্ট্র; জনগণ সব ক্ষমতার মালিক। তারা নিজের দেশ নিজেরাই শাসন করার অধিকার সংরক্ষণ করে। তাই সংবিধান অনুযায়ী, জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করার বিষয়ে ক্ষমতাবান। এই প্রতিনিধিদের একটি অংশ তাদের হয়ে ক্ষমতা প্রয়োগ করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে। অন্য অংশ জনগণের হয়ে সংসদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ভুলত্রুটি তুলে ধরে শাসকদের জবাবদিহির আওতায় আনবে। জনগণ এ প্রক্রিয়ায় শুধু সরকার গঠনে নয়, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণে সক্ষম হবে।
এ পদ্ধতিকে কার্যকর করার জন্য অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হলো-অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি নির্বাচন। এর পরপরই প্রয়োজন কার্যকর সংসদ; যেখানে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি আবশ্যক। বস্তুত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রাধান্য লাভ করে এবং সম্পদের সুষমবণ্টন; অন্যায়-অবিচার, শোষণ, নিষ্পেষণ হ্রাস পায়; মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান একেবারেই তলানিতে।
গণতন্ত্রকে সঙ্কটমুক্ত করে একটি শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা। এর ভিত্তিতেই আমাদের দেশ একটি গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা বাঞ্ছনীয়, অনেক ক্ষেত্রেই তা নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে শাসনকার্যে জনগণের অংশগ্রহণের বিষয়টি এখনো প্রশ্নমুক্ত হয়নি। স্বাধীনতার পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হলেও আমাদের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকশিত হতে পারেনি, বরং বিপন্ন হয়েছে বলা যায়; যা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য বৈষম্যমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, অন্যায়-অবিচার, শোষণ-নিষ্পেষণমুক্ত এবং সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক বাংলাদেশ। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন যৎসামান্যই বলতে হবে। ফলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমরা এখনো পশ্চাৎপদ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায়, স্বাধীনতা হলো সামাজিক জীবনের তেমন পরিবেশ, যার মাধ্যমে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের বিকাশের সব রকম সুযোগ অল্পায়াসে লাভ করে এবং অন্যায়ের সামনে সাহসের সাথে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ করার মনোবল পায়। সমাজ-জীবনে একটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে, কিন্তু সে নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তির নৈতিক উন্নতির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়া জরুরি। বস্তুত, স্বাধীনতা একটি শর্ত; যে শর্তে একটি জাতি, দেশ-রাষ্ট্র এবং জনগোষ্ঠীসহ নিজস্ব শাসনব্যবস্থা ও সার্বভৌমত্ব থাকবে।
স্বাধীনতা অর্জন কোনো ক্ষেত্রেই সহজলভ্য হয় না। কিন্তু স্থান, কাল ও পাত্রভেদে এই অর্জনের প্রেক্ষাপট অভিন্ন নয় বরং আলাদা হয়ে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে ওসমানীয় সাম্রাজ্য এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। পরে ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য থেকে ৭০টি নতুন রাষ্ট্র স্বাধীনতা পায়। তবে ফরাসি বিপ্লব ও আমেরিকান বিপ্লবের একই পরিণতি দেখা গেছে। ফরাসিরা রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্বের আদর্শের ভিত্তিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি।
অল্প দিনের মধ্যেই দেখা যায়, পরাজিত ফরাসি সামন্তবাদী শক্তি ও কায়েমি স্বার্থবাদীরা আবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছে ‘প্রজাতন্ত্র’ নামের আড়ালে। তখন নেপোলিয়ন তো ক্ষমতা দখলের পর নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন। আমেরিকার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল ‘জনগণের জন্য জনগণ কর্তৃক জনগণের সরকার’ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ট্রুম্যান, বুশ ও ট্রাম্পের সরকারব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে মনে হয় যুক্তরাষ্ট্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে স্থির থাকতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে আমাদের বিচ্যুতিটা অপরাপর জাতিরাষ্ট্রের তুলনায় রীতিমতো উদ্বেগজনক বলেই মনে হয়।
বস্তুত, ব্যক্তিস্বাধীনতাই রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলে। কোনো দেশের নাগরিকেরা যখন নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করেন, তখন রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাও মজবুত হয়। এ ক্ষেত্রে নাগরিকেরাই স্বাধীনতা-সচেতন ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার রক্ষক হয়ে ওঠে। আর ব্যক্তিস্বাধীনতা (Civil liberty) হলো ব্যক্তিগত অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, যা সরকার সাধারণত নির্ধারিত প্রক্রিয়া ছাড়া আইন বা বিচারিকপ্রক্রিয়া প্রয়োগ করে খর্ব করতে পারে না। ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপ্তি রাষ্ট্রভেদে ভিন্ন হতে পারে।
ব্যক্তিস্বাধীনতার আওতায় পড়ে-নির্যাতন থেকে বাঁচার অধিকার, বাস্তুচ্যুত হওয়া থেকে বাঁচার অধিকার, আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার, গণমাধ্যমের সহায়তা পাওয়ার অধিকার, নিজ নিজ ধর্ম পালন ও প্রচারের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার অধিকার, নিজস্ব গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার, আইনের সুবিধা লাভের অধিকার, নিরপেক্ষ আদালতে বিচার পাওয়ার অধিকার এবং জীবন বাঁচানোর অধিকার। অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কি স্বাধীনতার সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন, By liberty I mean the eager maintenance of the atmosphere in which men have the opportunity to be their best selves. অর্থাৎ স্বাধীনতা বলতে সে পরিবেশের সাগ্রহ সংরক্ষণ বুুঝি, যা দ্বারা মানুষ তার শ্রেষ্ঠ সত্তা উপলব্ধি করার সুযোগ পায়।
বস্তুত, স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হলো একটি অবস্তুগত বৈধ সত্তা, যা একটি সরকার কর্তৃক শাসিত এবং যার একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সার্বভৌমত্ব বিদ্যমান। সেখানে নাগরিকের সব মৌলিক অধিকারের নিশ্চিয়তা প্রদান করা হয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি স্থায়ী জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট সীমানা ও সরকার এবং অপর কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের যোগ্যতা থাকলে তাকে সার্বভৌম রাষ্ট্র বলা হয়। বস্তুত রাষ্ট্রের উদ্ভব তখনই ঘটে, যখন মানুষ ধীরে ধীরে তাদের আনুগত্য কোনো ব্যক্তিক সার্বভৌমত্ব থেকে রাষ্ট্র নামক একটি ‘অস্পৃশ্য’ কিন্তু স্থানিক রাজনৈতিক সত্তার প্রতি স্থানান্তরিত করে। আর সে রাজনৈতিক সত্তা রাষ্ট্রের অখ-তা, নিরাপত্তা ও নাগরিকের সব বৈধ ও সঙ্গত অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে বাধ্য থাকে।
সার্বভৌমত্ব এমন একটি প্রত্যয়, যার প্রায়ই অপব্যবহারও হয়; যেমনটি হচ্ছে আমাদের দেশের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। অসহিষ্ণু ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাজনীতিই এ জন্য প্রধানত দায়ী। এ কথা সত্য, বিশ্বের কিছু মানুষের জীবন ছিল অসভ্য এবং সমাজকাঠামো ছিল অসংগঠিত। এটা নির্ণয়ের জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘সভ্যতার মান’-এর বিচ্ছিন্ন ধারণাটি বিস্তার লাভ করে।
ওপেনহেইমের ভাষায়, ‘সম্ভবত সার্বভৌমত্বের ধারণার মতো বিতর্কিত বিষয় আর কিছু নেই। এটি অকাট্য সত্য যে, ধারণাটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এর অর্থের বিষয়ে বিশ্বজনীন ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।’ অস্ট্রেলিয়া উচ্চ আদালতের বিচারক এইচ ভি এভাট মত দেন, ‘সার্বভৌমত্ব নীতিগত বা আইনগত প্রশ্ন কোনোটিই নয়, বরং এটি এমন একটি প্রশ্ন যা উত্থিতই হয় না।’ আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সার্বভৌমত্বের ধারণা ও প্রয়োগ নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা উদ্বেগজনক।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের স্বাধিকারের মূলমন্ত্র। কিন্তু আমরা তা লালন করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আজো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বৃত্তে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এখন একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরও আমরা এখনো জাতিকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি উপহার দিতে পারিনি বরং ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে নির্বাচনের ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ করার একটা মোক্ষম সুযোগের ক্ষেত্র রয়েই গেছে। গণতন্ত্রকে আটকে দেয়া হয়েছে একটি সঙ্কীর্ণ বৃত্তে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়েও সুবিধাবাদী ব্যাখ্যার উপদ্রব পুরো জাতিসত্তাকেই হীনবল করে তুলছে। উদারনৈতিক গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন আমাদের সংবিধানের মৌলিক চেতনা হলেও এসবের প্রয়োগ হতাশাব্যঞ্জকই বলতে হবে। ফলে আমরা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এখনো বেশ পিছিয়ে।
মহাকবি মিল্টনের ভাষায়,‘স্বাধীনতা মানুষের প্রথম এবং মহান একটি অধিকার’। কিন্তু স্বাধীনতাকে ফলপ্রসূ ও অর্থবহ করতে হলে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সমাজের আবশ্যকতা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। থিওডোর পার্কারের ভাষায়, ‘চিন্তার স্বাধীনতা থাকবে, কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে এবং উপাসনার স্বাধীনতা থাকবে-এই হলো গণতন্ত্রের আদর্শ।’ কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আমরা কি সে গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছি? গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কি স্বেচ্ছাচার ও রাহুমুক্ত হয়েছে? উত্তরটা নিঃসন্দেহে নেতিবাচকই হওয়ার কথা। যা আমাদের জাতীয় ব্যর্থতাই বলতে হবে