ফররুখ আহমদের ‘নৌফেল ও হাতেম’

ড. ফজলুল হক তুহিন
ঊনিশ শতাকের শেষ থেকে বিশ শতকের চল্লিশের দশক পর্যন্ত, বহুদিনের স্থবিরতার পর পৃথিবীর কাব্য আন্দোলনের আধুনিকতম বিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলাতে এত দ্রুত বাংলা কবিতাকে অগ্রসর হতে হয়েছে যে, বিশেষ কোনো ধারা এ ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ পায়নি। বিবর্তনের এক স্তর পার হয়ে অস্বাভাবিক দ্রুততায় লাফিয়ে গেছে অন্য স্তরে এবং প্রায় কবিই এ গতিকে ত্বরান্বিত করার কাজে নিজেদের অগ্রসরমানতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সঞ্চরণী পল্লবশীলতা দিয়ে সাহায্য করেছেন। বাংলা কাব্যের বিবর্তনে বহুদিনের দায় এত দ্রুত পালটে নেয়া সম্ভব হয়েছে আন্তর্জাতিক কাব্য বিবর্তনের ফলশ্রুতি এবং এ সম্পর্কে কবিদের সজাগতা, গ্রহণশীলতা ও সক্রিয়তার গুণেই। এ ক্ষেত্রে চল্লিশ দশকের কবিদের ভূমিকা অগ্রণী। এই দশকের উল্লেখযোগ্য কবি হলেন:
আহসান হাবীব (১৯১৭-৮৫), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-৭৪), সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২), আবুল হোসেন (১৯২২-২০১৪), সুফি জুলফিকার হায়দার (১৮৯৯-১৯৮৭), রওশন ইজদানী (১৯১৭-৬৭), তালিম হোসেন (১৯১৮-১৯৯৯), মুফাখখারুল ইসলাম (১৯২১) প্রমুখ।
ফররুখ আহমদের মজ্জাগত বিষয় হলো ঐতিহ্যবোধ। আরব্য উপন্যাস, ইরান ও আরবের সংস্কৃতি ও পুরাকথা এবং কুরআনে উল্লিখিত কাহিনীর ঐতিহ্য একদিকে এবং অন্যদিকে মুসলিম অভ্যুত্থান যুগের ব্যক্তিত্ব ও ভাবধারার ঐতিহ্য তার কাব্যকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আধুনিক কবিতার উত্তরণে তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো কাব্যভাষা ও আঙ্গিকের স্বাতন্ত্র্যে ও উৎকর্ষে। নজরুল-পরবর্তী যুগের লক্ষণ-সম্পন্ন একটি বিকশিত কাব্যভাষার রূপ তার কবিতায় লক্ষণীয়। সমকালীন প্রসঙ্গ, বোধ, স্বপ্ন, কল্পনা ও রুচির এক পরম মিলন ঘটেছে তার এই কাব্যভাষার ধ্বনি উদ্ভাবনার সঙ্গে।
২.
কবি ফররুখ আহমদ আজীবন বিচিত্র আঙ্গিকে কাব্যচর্চা করেছেন। লিরিক, মহাকাব্য, কাব্যনাট্য ইত্যাদি প্রকরণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। ‘সাত সাগরের মাঝি’র স্বপ্ন-অভিযাত্রা-জাগরণের পর ‘সিরাজাম মুনীরা’র আদর্শ বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট পথরেখা নির্দেশ করেন এবং এরপরই কাব্যনাট্যের নতুন দিগন্তে প্রসারিত করেন ‘নৌফেল ও হাতেম’ কাব্যনাট্য প্রকাশের মাধ্যমে।
্আমেরিকার খ্যাতিমান কবি ও সমালোচক টি.এস. এলিয়ট এবং আইরিশ কবি ডব্লিউ. বি. ইয়েটস্ কাব্যনাট্য রচনায় সফলতা দেখিয়েছেন। এলিয়ট বলেন: জীবনের সমগ্র সত্তাকে গ্রহণ করাই তার নাটকের অভিপ্রায়; আর সমগ্র বলেই গদ্যবাহন তার উপযোগী নয়। গদ্যে জীবনের খ-ীকৃত রূপই ধরা পড়তে পারে- সমগ্রকে চিরন্তনকে পেতে হলে কাব্যের আশ্রয় নিতেই হবে। গ্রিক নাট্য ও সেক্সপীয়ারের নাট্য সাধনা আমাদের ঐ সত্যেরই নির্দেশ দেয়। গদ্য যতই কাব্যধর্মী হোক না কেন তা দিয়ে এ কাজ চলতে পারে না বলেই এলিয়টের ধারণা। এলিয়ট ‘Drama and Poetry’ নামক গ্রন্থে তিনি প্রকারান্তরে কাব্যনাট্য সৃষ্টিতে আপন সার্থকতার স্বল্পতাকে স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন: ‘একমাত্র সেক্সপীয়ারের মতো প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি যিনি কবিত্ব ও হৃদয়াবেগের বিস্ময়কর সামঞ্জস্য বা মিলন ঘটাতে পারবেন, তিনিই পদ্য নাটক লিখে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারেন।’ মোট কথা কাব্যনাট্য রচনায় সার্থকতা অর্জনের জন্য একদিকে উৎকৃষ্ট কবি কল্পনার, অপর দিকে সাময়িক ঘটনা প্রবাহকে দৃঢ় মুঠোর মধ্যে ধরে রাখবার জন্য সংহত সন্ধানী দৃষ্টির অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকেই আধুনিক বাংলা কাব্যনাট্য রচনার সুসময়। মূল প্রবাহের বাইরে থেকেও ফররুখ আহমদের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ কাব্যনাট্য ‘নৌফেল ও হাতেম’ এই সময়েই রচিত ও প্রকাশিত (১৯৬১)। ‘নৌফেল ও হাতেম’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ‘মাহে নও’ পত্রিকায় ১৯৫৬ সালে (কার্তিক ও অগ্রহায়ণ ১৩৬৩)।
এই কাব্যনাট্যের কাহিনীসূত্র অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। ইয়েমেনের শাহ্জাদা হাতেম তায়ীর দানশীলতার বিপুল খ্যাতিতে আরবের নৌফেল শাহ ঈর্ষান্বিত। অনেক কৌশল করেও নৌফেল শাহ যখন হাতেম তায়ীর মতো যশ-খ্যাতি অর্জন করতে পারলেন না, তখন ঘোষণা করলেন: যে হাতেমকে ধরে আনতে পারবে, তাকে পুরস্কৃত করা হবে। হাতেম এক গরীব কাঠুরেকে সহায়তা করার জন্যে স্বেচ্ছায় ধরা দিলেন। বৃদ্ধ কাঠুরে নিজেই যখন রাজদরবারে হাতেমের এই স্বেচ্ছাবন্দিত্বের সংবাদ ফাঁস করে দিলো, তখন হাতেমের মহত্তে অভিভূত নৌফেল ইয়েমেনের শাহজাদা হাতেমের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন নিজ কৃতকর্মের জন্য এবং নিজের মাথার তাজ পরিয়ে দিলেন হাতেমতায়ীর মাথায়। এই কাহিনীসূত্র সংক্ষিপ্ত ও একেবারেই সামান্য। কিন্তু এই কাহিনী ঘিরেই নৌফেল, হাতেম, উজীর, আমির, শায়ের, কোতোয়াল, গুপ্তচর, মুর্শিদ, ভাঁড়, মোসাহেব, বেগম, কাঠুরিয়া, কাঠুরিয়ার স্ত্রী, কাঠুরিয়ার সন্তান ও অন্যরা আবর্তিত হয়েছে। এবং সবমিলিয়ে নাটকের আবশ্যিক গতিও সচল থেকেছে আনুপূর্ব: নাটক শুরু হয়েছে নৌফেলের রাজ্যের একটি প্রাচীন মেলায় আর শেষ হয়েছে নৌফেলের রাজদরবারে। ফররুখ আহমদের রচনার প্রধান গুণ তার সাবলীল সচ্ছলতা: ‘নৌফেল ও হাতেম’ নাটকের তিনটি অঙ্কে তা বজায় থেকেছে। ফররুখের যে-কোনো রচনার মতোই গতিশীল ও লক্ষ্যমুখী।
এ-কাব্যনাট্যে কবি যে আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনাকে বাস্তবায়িত করার এক বাস্তব পন্থা হিসেবেই যেন আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন হাতেম তায়ীর নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও সেবার দৃষ্টান্তকে। কবি তার ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন তথা মুসলিম পুনরুজ্জীবনের স্বপ্ন একমাত্র সার্থকতা ম-িত হতে পারে মানবতার নিঃস্বার্থ ও অক্লান্ত সেবার পথে। এ পথের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে কবিপ্রত্যয়টি ভাষা পেয়েছে কাব্যনাট্যের সমাপ্তিতে শায়েরের কণ্ঠে উচ্চারিত:
কাব্য নয়, গান নয়, শিল্প নয়, - শুধু সে মানুষ
নিঃস্বার্থ, ত্যাগী ও কর্মী, সেবাব্রতী- পারে যে জাগাতে
সমস্ত ঘুমন্ত প্রাণ,- ঘুমঘোরে যখন বেহুঁশ
জ¦ালাতে পারে যে আলো ঝড়-ক্ষুব্ধ অন্ধকার রাতে;
যার সাথে শুরু হয় পথ চলা জাগ্রত যাত্রীর
দিল সে ইশারা আজ আত্মত্যাগ হাতেম তা’য়ীর ॥
‘সাতসাগরের মাঝি’র অপরূপ স্বপ্নাভিজ্ঞতার জগৎ থেকে ‘সিরাজাম মুনীরা’র মহৎ জীবন ভাবনা অথবা আদর্শ ভাবনার পথ ধরেই কবি উপস্থিত হয়েছেন ‘নৌফেল ও হাতেম’-এর কাক্সিক্ষত মানবিক ভাবনার জগতে। ঐতিহ্যের স্বপ্নালোক ও আদর্শের ধ্যানলোক থেকে বাস্তব সমস্যাক্ষুব্ধ জীবনের মাঠে কবির এ জাগরণ বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ। অতীতচারী, স্বাপ্নিক কবির জীবন দৃষ্টির প্রখরতা তার প্রতিভাকে অনেকটাই অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে। ‘নৌফেল ও হাতেম’ কাব্যনাট্যে ফররুখ আহমেদ স্বপ্নের, আদর্শের ও তত্ত্ব-ভাবনার জগত থেকে অনেকটাই যেন সমাজকর্মীর বাস্তবভাবনার জগতে নেমে এসেছেন। তবু মানবিক শ্রেয় ও কল্যাণের আদর্শে সুদৃঢ় আস্থাই এ কাব্যনাট্যের প্রাণবায়ু যুগিয়েছে নিঃসন্দেহে। কিংবদন্তী নির্ভর হাতেম তায়ী চরিত্রকে কবি ইসলামী প্রেম, সেবা ও কর্মের মহান আদর্শের মূর্ত প্রতীক রূপে দাঁড় করিয়ে আপন সযতœলালিত কবি স্বপ্নটিকে বাস্তবায়নের পথ খুঁজেছেন। গণমানুষের সামগ্রিক মুক্তির জন্য হাতেমের মতো সেবাব্রতী, মানব-প্রেমিক, ‘কামিল ইনসানের’ চরিত্র মাহাত্ম্য কবির মনোগত আদর্শটির পরিপোষকতা করেছে বলেই তাকে নিয়েই কবির এ কাব্যনাট্য রচনার প্রয়াস।
‘নৌফেল ও হাতেম’ গ্রন্থটি তিন অঙ্কে চৌদ্দটি দৃশ্যে বিভক্ত এ নাটকের প্রথম অঙ্কে পাঁচটি, দ্বিতীয় অঙ্কে চারিটি এবং তৃতীয় বা শেষ অঙ্কে পাঁচটি দৃশ্য সংযোজিত হয়েছে। প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে নৌফেলে রাজ্যের প্রাচীন মেলা উপলক্ষে নানা শ্রেণির মানুষের সন্মিলনে বিদেশী মুসাফিরের তিক্ত-মধুর অভিজ্ঞতার চিত্রায়নের মধ্য দিয়ে এক দিকে হাতেম চরিত্রের মহিমার আভাস দেওয়া হয়েছে অপর দিকে যশোলিপ্স, বলদর্পী নৌফেল বাদশার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রতিভাসিত হয়েছে। দ্বিতীয় দৃশ্যে হাতেমের সুনাম শ্রবণে যশোলিপ্স নৌফেলের মনে ঈর্ষা উদ্রেকের কথা এবং নৌফেল কর্তৃক হাতেমের গৌরব খর্ব করার সংকল্প ব্যক্ত করা হয়েছে। তৃতীয় দৃশ্যে নৌফেলের সুনাম অর্জনের গ্লানিকর প্রচেষ্টার ব্যর্থতার আভাস ব্যঞ্জিত হয়ে উঠেছে মুসাফির কর্তৃক বাদশার দান গ্রহণে অসম্মতি ও ক্ষিপ্ত নৌফেল অনুচরদের জিঘাংসার মনোভাবে। চতুর্থ দৃশ্যে উদ্ধত নৌফেলের মানসিক বিকৃতিরই আর একটি ধাপ বর্ণিত হয়েছে। সিপাহসালারের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে সেই মনোভাব:
যশের কাঙাল হয়ে কে পেয়েছে যশ পৃথিবীতে?
যে ত্যাগী অথবা কর্মী খ্যাতি আসে তার পিছে পিছে
অচ্ছেদ্য ছায়ার মত সাফল্যে সাথে। কিন্তু যার
নির্লজ্জ কাঙালপনা খ্যাতির দুয়ারে, - দরিদ্র সে
চিরকাল মরে শুধু মিসকিনের হালে।
চতুর্থ দৃশ্যে নাটকীয় ঘটনা চূড়ান্ত মোড় নিয়েছে। দীনের বন্ধু হাতেম এক দরিদ্র বৃদ্ধ কাঠুরিয়া দম্পতির অভাব মোচনের জন্যে স্বেচ্ছায় বৃদ্ধ কাঠুরিয়ার হাতে ধরা দিয়ে আপন মহানুভবতার চূড়ান্ত পরিচয় দিয়েছেন। (চলবে)