রবিবার ১০ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

দায়

খাতুনে জান্নাত কণা

 আম্মু, বাবাকে ওরা নাকি কবরে নামাতে দিবে না। আনমোল হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে কোনোমতে বলতে পারল।

ঃ কে নামাতে দেবে না ? আমাকে তাদের কাছে নিয়ে চল।

ঃজানোনাতো আম্মু, দু’জন চাচ্চু এসে বাবাকে কবরে নামাতে বাধা দিচ্ছে। এদের আমি আগে থেকেই চিনি । তুমিও চিনবে। তারা নাকি বাবার কাছে সব মিলিয়ে আড়াই লাখ টাকা পাবে। তাই তার লাশ দাফন করতে দিবে না। আমাকে বলেছে তোমার কাছে খবরটা পৌঁছে দিতে । 

ঃ তোর চাচা-ফুপুরা ওখানে নেই ?

ঃ তারা কেউ কোনো কথা বলছে না। বলছে, আজিজের বৌ এর জিম্মাদার হবে। যেহেতু আজিজের সন্তান নাবালক, তাই তার পক্ষে তো ঋণ শোধ করা সম্ভব না। আমাদেরও নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো টাকা-পয়সা নেই যে ভাইয়ের জন্য দিব ।

ঃ ঠিক আছে চল। কোথায় ওরা?

ঃ আম্মু, তুমি ওদের সাথে কোনো ঝগড়া-ঝাঁটিতে যেও না। মাথা ঠান্ডা রেখো। এখন আর তুমি ছাড়া দুনিয়াতে আমার কে আছে বলো? আনমোল আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ইয়াসমিন ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে, মাথায়, পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে সান্ত¦না দিতে থাকল। ওর চোখ দিয়েও অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওড়নার আঁচলে মুখ মুছে নিয়ে বলল,

ঃ আল্লাহ আছেন বাবা। সব সময় আল্লাহর উপর ভরসা রাখবে। আমরা কেউ অমর হয়ে আসিনি। আল্লাহ হলেন ইয়াতিমের অভিভাবক। আর অভিভাবক হিসেবে আল্লাহ সর্বোত্তম ।

মাথায় ওড়নাটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে ইয়াসমিন এসে আব্দুল আজিজের লাশের সামনে দাঁড়াল। মসজিদের ইমাম সাহেব তার সামনে মাইকের স্পিকারটা রাখতে বললেন।

ইয়াসমিন যে কথাগুলো বলল, তা সচরাচর কোনো স্ত্রীর মুখে কোনদিন কেউ শোনেনি। কারো মুখ রাগে লাল হয়ে গেল, কেউ হতাশ হলো, কেউ লজ্জায় মাথা নত করল। ইয়াসমিন তখন বলে যাচ্ছিল, 

ঃ আসসালামু আ’লাইকুম। আমি এই মুহূর্তে শোকে কাতর হয়েও আপনাদের সামনে কিছু কথা বলতে এসেছি। একজন স্বামীর  যত সীমাবদ্ধতাই থাক, দোষত্রুটি থাক,  স্ত্রীর কাছে সে সম্মানের পাত্র। সেই মানুষটি যেহেতু তার সন্তানেরও পিতা, তার মৃত্যুতে স্ত্রী শোকে বিহ্বল হবে এটাই স্বাভাবিক। এখানে যারা উপস্থিত আছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আনমোলের বাবা আব্দুল আজিজের কাছে বেশ কিছু টাকা-পয়সা পান। তাই তারা বাধা দিয়ে বলছেন,“ঋণমুক্ত না হলে আব্দুল আজিজের লাশ কবরে নামাতে দিব না।” তাহলে, লাশটাকে আপনারা কী করবেন? কেটে টুকরো টুকরো করে ভাগ করে নিয়ে যাবেন? তা নিতে পারেন। কিডনি, চোখের রেটিনা, লিভার, হার্ট আলাদা আলাদা দামে বিক্রি করে দিতে পারেন ।

আনমোল চিৎকার করে উঠলো।-

ঃ আম্মু থামো। এসব কী বলছো ?

আব্দুল আজিজের ভাই- বোনেরা ইয়াসমিনের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। বলল,

ঃ তোমার নিজের কিডনি বিক্রি করো। আমার ভাইয়ের লাশ কাটা- ছেঁড়া করতে চাও কোন সাহসে? তার কামাই রোজগারতো তোমরাই ভোগ করছো। 

ইয়াসমিন তখন বলছিল,

ঃ আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। কেউ আমাকে বাধা দিবেন না প্লিজ। আপনারা যারা আব্দুল আজিজের টাকা-পয়সা পাবেন বলছেন, তাদের সাথে আরো একজনকে যুক্ত করে নিতে পারেন। সেটা হলো মিসেস আব্দুল আজিজ, ওরফে ইয়াসমিন জাহান। যে তার স্বামীর কাছে বারো লক্ষ টাকা দেনমোহর বাবদ পায়। আব্দুল আজিজ তা পরিশোধ করেনি। এছাড়া, ইয়াসমিন তার বাবার বাড়ির সম্পত্তি থেকে দশ লাখ টাকা এনে আব্দুল আজিজের হাতে দিয়েছিল। সে সবের কিছুই আব্দুল আজিজ রাখতে পারেনি। কারণ, সে অগোছালো জীবন-যাপন করতো। না বুঝে টাকা-পয়সা যাকে তাকে দিয়ে বেড়াতো। তার স্ত্রী তাকে বাধা দিতে গেলে আব্দুল আজিজ বলতো,“ কারুনের মতো সম্পদ চিনিও না। টাকা-পয়সা জমাতে নাই।” স্ত্রী তাকে বুঝাতে চেষ্টা করতো, যখন হাতে অর্থকড়ি থাকে, বুঝেশুনে খরচ করলে, নিজের বিপদে আপদে নিজের উপার্জনের টাকাটাই কাজে লাগানো যায়। আব্দুল আজিজকে কুরআন শরীফের বিভিন্ন সূরায় অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা সম্পর্কে আল্লাহ যা বলেছেন, তা স্মরণ করিয়ে দিত। কিন্তু, আব্দুল আজিজ শোনেনি। যার পরিণতি আজকের এই পরিস্থিতি। এখন আমিও যদি আমার পাওনা টাকা না পাওয়া পর্যন্ত আমার স্বামীর লাশ দাফন করতে না দেই, অবস্থাটা কেমন দাঁড়াবে বলেন ?

সবাই নীরব। ইয়াসমিন বলে চলল,

ঃ আব্দুল আজিজ তো তার আমল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আমরা যা করছি, তা আমাদের জন্য কতখানি শোভনীয়, তা ভাবতে হবে। আপনারা যদি আমার স্বামীর শরীরের বিভিন্ন অর্গান বিক্রি করে টাকা নিতে চান, সেক্ষেত্রে তার সন্তানের আপত্তি আছে। তা ছাড়া তা ভালো দৃষ্টান্ত হবে বলে মনে হয় না। এখন কি করবেন? লাশ কবরে না নামিয়ে এখানেই রাখবেন? তাতে কি হবে? পচে দুর্গন্ধ বের হবে। যদি পাওনা টাকা পেতেই চান, সময় দিতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে। আনমোলের বাবা তার বাবার বাড়ির ভিটেমাটি বিক্রি করেনি। কিন্তু, একজন ইয়াতিম সন্তানকে নিয়ে ঠিকানাবিহীন অবস্থার মধ্যে তো আর আমাকে আপনারা ঠেলে দিতে পারেন না। তাই, যে যে টাকা পাবেন, উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে রাখুন। সময় নিয়ে সব শোধ করে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ। আমার ছেলেটা এখনও নাবালক। আমি এক সময় চাকরি করতাম। পরে, স্বামীর অনুরোধে চাকরি ছেড়েছি। ঘরে থেকে সংসার সামলাতাম। এখন জীবনের প্রয়োজনে আমাকে একটা চাকরিতে ঢুকতে হবে। আর হ্যাঁ, আব্দুল আজিজ আর আমি, দু’জনই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। আমার প্রতিষ্ঠান আমাকে পাওনা থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ঠকিয়েছে। আব্দুল আজিজের অফিস, তাকে তিন বছরের বেতন কোম্পানি লসের অজুহাত দেখিয়ে দেয়নি। এই টাকাগুলো পেলে আব্দুল আজিজ যত বোকা এবং সাদাসিধে লোকই হোক, আমাদের সংসার চালাতে তেমন কোনো সমস্যা হতো না। আপনারা তো তার মতো মানুষের লাশ আটকাতে পারেন। এইসব কোম্পানির মালিকদের কাছ থেকে আব্দুল আজিজদের পাওনা আদায় করে এনে দিতে পারেন না? এইসব ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের লাভ-লোকসানের দায় টানে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ। এখন আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন, লাশ সসম্মানে দাফন করা হবে, নাকি মাটির উপরেই থাকবে?

ইয়াসমিন কথা শেষ করে চোখ মুছে ভিড়ের সামনে থেকে সরে বাড়িতে গিয়ে ঢুকল। ততক্ষণে আব্দুল আজিজকে ঘিরে নানারকম গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। ইমাম সাহেব সবাইকে থামতে বললেন।

আনমোল কিছুক্ষণ পর এসে ওর মা’কে বলল ,

ঃ আম্মু, ইমাম নানাভাই বলছেন, তুমিও বাবাকে ক্ষমা করে দাও। পাওনাদার চাচুরা আমাদের সময় দিয়ে বলেছে, ধীরে ধীরে বাবার ঋণগুলো আমরা শোধ করে দিতে পারবো।

ঃ না, ওদের সময় দেয়ার দরকার নেই। আমার গলার স্বর্ণের চেইন আর কানের এই ঝুমকাজোড়া নিয়ে যাও। ওখানে জুয়েলারীর দোকানের মালিক তোমার কামাল মামা আছেন। তাকে গিয়ে বলো, এখানে তিন ভরি স্বর্ণ আছে। সব বাইশ ক্যারেটের। আমার আম্মার দেয়া গহনা। এগুলো বিক্রি করলে প্রায় তিন লাখের কাছাকাছি দাম আসবে। সে যদি গহনা রেখে টাকাটা দিয়ে দেয়, ভালো হয়।

আনমোলের খুব খারাপ লাগল মায়ের গহনাগুলো নিতে।  আবার খুশীও হলো। ভাবল, ওর বাবাকে আর কেউ অপমানজনক কথা বলতে পারবে না।  দৌড়ে বাড়ির বাইরে গেল।

কামাল গহনা নিতে রাজি হলেন। ইয়াসমিনের হাতে দুই লাখ পঁচাশি হাজার টাকা নগদ ধরিয়ে দিলেন। সবার পাওনা শোধ করার পর, ইয়াসমিন আবার কিছু বলতে চাইল। ইমাম সাহেব সুযোগ দিলেন। ইয়াসমিন বলল,

ঃ আপনাদের তখন আমি যা যা বলেছিলাম, অনেক বেশি কষ্ট পেয়ে বলেছি। কেউ কিছু মনে রাখবেন না। আব্দুল আজিজ, অগোছালো, বেহিসাবী মানুষ হলেও আমি ঠিক তার বিপরীত মানুষ।  সব সময় ঋণমুক্ত জীবন-যাপনের চেষ্টা করি। আজ আব্দুল আজিজকে নিয়ে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না, যদি তার আশ-পাশের, কাছের, রক্তের সম্পর্কের কিছু মানুষ তার কাছে অন্যায় সুবিধা না নিত।

এই কথাগুলো শুনে আব্দুল আজিজের ভাই- বোনদের মুখ কালো হয়ে গেল। ইয়াসমিন তখন বলে যাচ্ছিল, 

ঃ তারা নিজেদের অভাব দেখিয়ে আমার স্বামীর কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়েছে। আজ তার বিপদের সময় কেউ এক কানাকড়ি দিয়েও সহযোগিতা করেনি। মানুষের জীবন এমনই। তবে, আমরা ভুলে যাই, একদিন আমরা সবাই আল্লাহর কাছে চলে যাব। তখন, সমস্ত অর্থ-সম্পদ, জায়গা-জমি সবই পড়ে থাকবে। আনমোল আজ তার জীবন থেকে একটা শিক্ষা পেল। আপনারা আমার সন্তানের জন্য দোয়া করবেন। সে যেন একজন ভালো মানুষ হয়। আব্দুল আজিজের জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসীব করেন। আমি তার মোহরানার টাকাসহ সব ঋণ থেকে মুক্তি দিলাম। আল্লাহ যেন তাকে ক্ষমা করে দেন। আসসালামু আ’লাইকুম ।

আব্দুল আজিজকে সসম্মানে দাফন করা হলো। আনমোল আজ অনেক কেঁদেছে। উপস্থিত কারো চোখ তখন শুষ্ক ছিল না। কেউ কেউ ওর মাথায় হাত রেখে শান্ত¦না দিয়েছে।

বাড়িতে ইয়াসমিন তখন দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে, আল্লাহর কাছে তার স্বামীর শান্তির জন্য মুনাজাত করছে। তার গহনাগুলো আজ এই বিপদের মুহূর্তে কাজে লেগেছে। তাই সে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাল।  ছেলেটাকে নিয়ে বাকি দিনগুলো কীভাবে চলবে, আল্লাহ তার একটা উত্তম ব্যবস্থা করে দিবেন ইনশাআল্লাহ। ইয়াসমিন জানে, আল্লাহর উপর নির্ভর করলে, বান্দার জন্য আল্লাহই উত্তম রিজিকের ব্যবস্থা করে দেন ।

আনমোল তার বাবার কবরের মাটি মাখা পাঞ্জাবী গায়ে বাড়ি ফিরে মা’কে জড়িয়ে ধরল। তার মুখে এখন কোনো দুশ্চিন্তার ছাপ নেই। বলল,

ঃ আম্মু , আমার আর কোনো ভয় নেই। আল্লাহর রহমতে তুমি আমার পাশে আছো। 

ইয়াসমিন কিছু বলল না। শুধু চুপচাপ ছেলেকে বুকের মাঝে কিছুক্ষণ আগলে রাখল। মনে মনে ভাবল,

“তোর বাবা যেমন ঋণের দায় রেখে চলে গেছেন, আমি সেভাবে কোনো দায় রেখে যেতে চাই না বাবা। দোয়া করি, তুই এমন মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকিস, যেন আমৃত্যু বাবা-মায়ের জন্য সাদাকার সওয়াবের কারণ হতে পারিস । 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ