ফররুখ আহমদের ‘নৌফেল ও হাতেম’

ড. ফজলুল হক তুহিন
(গত সংখ্যার পর)
এ-উপলক্ষে হাতেমের প্রতি দরিদ্র কাঠুরিয়া দম্পতির অপরিমেয় ভালবাসা ও শ্রদ্ধার কথা উল্লেখ করে কবি হাতেম চরিত্রের মহিমাকে উজ্জ্বলতর করে তুলে ধরেছেন। হাতেমের কণ্ঠে-
ব্যাকুল হয়ো না বৃদ্ধ। জিন্দেগানি রেখেছি আমার
আল্লার বান্দার কাজে। সামান্য প্রাণের বিনিময়ে
দুঃখের দুর্দিন যদি কেটে যায় তোমাদের, তবে
দিও না অহেতু বাধা। দেখ চেয়ে বৃদ্ধা পেরেশান
কিভাবে তাকিয়ে আছে, দেখ চেয়ে তোমার ফরজন্দ
ক্ষুধা-শীর্ণ। সকল যন্ত্রণা দুঃখ ফুরাবে তোমার,
মুশকিল আসান হবে জিন্দেগির কঠিন সড়কে;
যদি যাও বাদশার দরবারে।
হাতেমের মনুষ্যত্বের মহান আদর্শের আলোকে বিভ্রান্তদৃষ্টি নৌফেলের জাগরণকে সুনিশ্চিত করে তোলার জন্যেই যেন কবি হাতেম চরিত্রকে মহত্বের উজ্জ্বলতর বর্ণালিতে ভূষিত করেছেন এ দৃশ্যে। পঞ্চম দৃশ্যে অর্থাৎ এ নাটকের তৃতীয় এবং শেষ অঙ্কের শেষ দৃশ্যে নৌফেল ও হাতেমের মিলনের মধ্য দিয়ে নাটকীয় ঘটনার উপসংহার টানা হয়েছে। এ দৃশ্যের প্রথম দিকে যথেষ্ট নাটকীয়তা থাকলেও শেষ দিকে কাব্য এসে স্থান জুড়ে বসেছে। ‘হাতেমের শোকে সংখ্যাহীন নরনারী রাজ্য ছেড়ে চলে যাচ্ছে’ শায়েরের মুখে এ সংবাদ পেয়ে নৌফেলের মনে যে বিরূপ মানসিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তারই কথা দিয়ে দৃশ্যটি শুরু হয়েছে। শায়ের ও মুর্শিদ নানাভাবে বুঝিয়ে নৌফেলের মন থেকে হাতেম সম্পর্কিত বিভ্রান্ত ধারণা দূর করার চেষ্টা পান।
মুর্শিদ:
কি লাভ নৌফেল! এতে পাবে বলো তুমি? মুক্ত প্রাণ
যে চলে মিলায়ে কাঁধ ইনসানের সাথে, আমানত
খেয়ানত করে না কখনো, সেবাব্রতী যার কাছে
পায় শান্তি, সান্ত¡না সকলে; কি লাভ ক্ষতিতে তার?
কি সুখ্যাতি পাবে তুমি এই হংসা-কণ্টকিত পথে?
মুর্শিদ (কঠিন স্বরে):
রক্ত যদি নাও হাতেমের
বদলা নেবে সে খুনের ওয়ারিশান যারা। কীর্তি তার
রয়ে যাবে সব প্রাণে দুনিয়া জাহানে। নাম তার
ছড়াবে হাওয়ার সাথে নিঃস্বার্থ যে মানব-প্রেমিক
আল্লার বান্দার কাজে যে দিয়েছে জিন্দেগানি, আর
তামাম জিন্দেগী ভ’র যে রয়েছে সৃষ্টি খিদমতে।
এ কথা ভেবো না তুমি, অত্যাচারী জালিমের ভয়ে
থেমে যাবে মানুষের মনুষ্যত্ব। জুলুম-শাহীর
ত্রাসণে হয়নি শেষ কোনদিন ধর্ম, নীতি; শুধু
মিটে গেছে জালিমের নাম ও নিশানা।
বৃদ্ধ মুর্শিদ (উদ্দীপ্ত কণ্ঠে):
এসেছে সে নির্ভীক, দিলীর
প্রাণ বিনিময়ে তার, মজলুমের বেদনা মুছাতে;
এসেছে ঘুচাতে দুঃখ বঞ্চিত দুঃখীর। এসেছে সে
নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে নিষ্কম্প হৃদয়ে।... কে দেখেছে
এমন দারাজ-দিল কে দেখেছে দুনিয়া জাহানে?
বড় নাটকীয় এ দৃশ্য! তারপর নৌফেলের প্রশ্নের উত্তরে হাতেম যখন জানান বৃদ্ধ কাঠুরিয়া তাকে বন্দী করেছে, তখন সে কথা বিশ্বাস হয় না নৌফেলের। হাতেম তাকে জানান, বৃদ্ধের দুঃখের জিঞ্জিরে তিনি স্বেচ্ছায় বন্দী হয়েছেন। তিনি নৌফেলকে আহ্বান জানান, তার মস্তকের জন্য ঘোষিত পুরস্কার বৃদ্ধ কাঠুরিয়া এ নিষ্ঠুর প্রতিশ্রুতি মতো বৃদ্ধ কাঠুরিয়াকে দেওয়ার জন্যে। সে আবেগ-কম্পিত কণ্ঠে বর্ণনা করে হাতেমের স্বেচ্ছায় বন্দীত্ব বরণের অপরূপ কাহিনী। শুনে বিস্মিত হন নৌফেল। অবাক হয় দরবারের সবাই। শায়ের বলেন:
কে শুনেছে এই ত্যাগ, মর্দমীর কথা? প্রবৃত্তির
ঊর্ধ্বে জানি ফেরেশতারা- নূরানী লেবাস; কিন্তু ধূলি
মলিন লেবাস যার সেই লুব্ধ মাটির মানুষ
হিংসা ও বিদ্বেষে অন্ধ করে যায় ব্যর্থ হানাহানি
ভ্রাতৃরক্তে প্রতিদিন বাড়ায়ে মুনাফা। এ মাটিতে,
হীন স্বার্থে কলঙ্কিত জুলমাতের হিংস্র অন্ধকারে
যেখানে দুর্লভ জানি মনুষ্যত্ব, মর্দমী, সেখানে
হাতেম তা’য়ীর ত্যাগ অন্তহীন দরিয়ার মত,
হাতেম তা’য়ীর শির পর্বতের মত মহীয়ান,
সুবহে উম্মীদের মত মুখ তার উজ্জ্বল রওশন।
কি হাতেমের উদ্দেশ্য কে জানে? বৃদ্ধ মুর্শিদ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেন হাতেমের মহান আত্মত্যাগের ক্ষমতার প্রশংসায়; শায়েরের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় হাতেমের চরিত্র-মহিমার প্রশংসা বাণী। এক অভূতপূর্ব অচিন্ত্যনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। নৌফেলের মনের অর্গল খুলে যায়, হাতেমের চারিত্রিক মহিমা উপলব্ধি করতে পারেন তিনি। রাহুমুক্ত হয় নৌফেলের আত্মা- তিনি সসম্ভ্রমে সিংহাসন থেকে নেমে এসে হাতেমের মস্তকে তাজ পরিয়ে দিয়ে তাকে বন্দী করেন হৃদয় পাশে। শায়েরের কণ্ঠে ব্যক্ত হয় এ মহান মিলন দৃশ্যের আনন্দ ও তাৎপর্য। আর এখানেই ঘটেছে ‘নৌফেল ও হাতেম’ কাব্যনাট্যের সমাপ্তি। নৌফেল আত্মোপলব্ধি করেন ও হাতেমের মাথায় তাজ পরিয়ে দেয়।
বুঝেছি খ্যাতির মূল্য এতদিনে, বুঝেছি এখন
যে মানুষ প্রাণ দিয়ে করে যায় বিশে^র কল্যাণ
কুল মখলুকের বুকে স্থান তার; দুনিয়া জাহানে
পায় সে বিপুল মান জীবনে অথবা মৃত্যুপারে।
’য়েমনের শাহজাদা! ক্ষমা করো শত্রুতা আমার।
আল্লার পিয়ারা বান্দা, নাও তুমি তাজ তখত ফিরে,
নাও শাহী বালাখানা; দিয়ে যাও মহৎ প্রেরণা
প্রেমপন্থী সুমহান আদর্শের পথে, নিয়ে যাও
বিক্ষত, বিভ্রান্ত জনে মানুষের মুক্তির মঞ্জিলে;
বন্ধু বলে ভাবো তাকে যে করেছে শত্রুতা জীবনে।
নাটকের শেষ দিকে কবি মুর্শিদ, শায়ের, নৌফেল ও হাতেমের উক্তি-প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে যখন আমাদের জানালেন, হাতেম একজন মোমিন মুজাহিদ, কামিল ইন্সান এবং প্রেমের পন্থাই সকল পন্থার শ্রেষ্ঠ, তখন কবির মনোগত আদর্শটি প্রচারের সজ্ঞান প্রচেষ্টাই প্রমূর্ত হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত যে সিদ্ধান্তে কবি পৌঁছেছেন: হাতেম তায়ীর আত্মত্যাগ ঝড়ঝঞ্ঝা ক্ষুব্ধ অন্ধকার রাত্রে জাগ্রত মানবযাত্রীর পথের ইশারা দিচ্ছে। ‘নৌফেল ও হাতেম’ কাব্যনাট্যের পরিকল্পনা মূলেও যে কবির মজ্জাগত ঐতিহ্যবোধ ও আদর্শ-প্রীতি কাজ করেছে তা প্রথম দিকে ততটা স্পষ্ট না হলেও; শেষদিকে প্রায় স্পষ্টরূপই ব্যক্ত হয়েছে। কবির বিশ্বাস হাতেমের মত নিঃস্বার্থ, সেবাব্রতী, মোমিন মুজাহিদ মুক্তিকামী ও প্রেমপন্থী মুসলমানই কেবল পারে ঐরূপ একটি মহৎ আদর্শকে বাস্তব রূপ দিতে।
কবি ফররুখ আহমদের ‘নৌফেল ও হাতেম’ একটি শিল্পসফল কাব্যনাট্য। আখ্যান, চরিত্র নির্মাণ ও সংলাপ মিলিয়ে মঞ্চসফল নাটক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত। ইতিহাস ও পুঁথির হাতেম তায়ী চরিত্রকে আধুনিক একটি কাব্যনাট্যের নায়ক ও মুক্তিদাতারূপে যেভাবে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নতুন কালের প্রেক্ষিতে কবি হাজির করেন তা সত্যিই স্মরণীয় ঘটনা। নতুন একটি রাষ্ট্রের জনমানুষের সামনে এমন একটি মানবতাবাদী চরিত্রের প্রাণবন্ত উপস্থিতি অন্য এক মাত্রায় উন্নীত করে।
তথ্যসূত্র:
১. আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত ফররুখ রচনাবলী ১ (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৫)।
২. সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, কবি ফররুখ আহমদ (ঢাকা: নওরোজ কিতাবিস্তান, ১৯৬৯)।
৩. আবদুল মান্নান সৈয়দ, ফররুখ আহমদ: জীবন ও সাহিত্য (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০২)।
৪. মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, বাংলা কাব্যে ফররুখ আহমদ : তার শক্তি ও স্বাতন্ত্র্যের স্বরূপ (ঢাকা: ফররুখ একাডেমী, ২০০৩)।
৫. শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত ফররুখ আহমদ: ব্যক্তি ও কবি (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৮৮)।