শতবাঁক

তমসুর হোসেন
কচুখেত ইসলামিয়া মার্কেটের ফুটপাতে ভিক্ষা করে কোরবান।
নদীতে সব হারিয়ে সে এসেছে ঢাকা শহরে। সাথে স্ত্রী শরবানু, ছেলে রমজান আর মেয়ে ফুলজান। তারা উঠেছিল মগবাজার রেলওয়ে বস্তিতে। শহরে এসে ওদের দিন ভালোই যাচ্ছিল। শরবানু বড়লোকের বাসায় ঠিকা কাজ করত। রমজান ঢুকেছে একটা মটর গ্যারেজে। ফুলজান মকতব আর ফরমায়েশের কাজে ব্যস্ত থাকত। কোরবান চালাত রিকশা। তার দেহে ছিল অসুরের শক্তি। মহাজন মিটিয়ে সব আয় যোগ করে তাদের দিন খারাপ যেত না। শরবানুর দেহে রূপের জোয়ার। প্রিন্ট শাড়ি পরে সে যখন রেললাইন ধরে হাঁটে তখন কোরবানের মন ভয়ে কাঁপে। বস্তির পরিবেশে রাখঢাক নেই। শরবানুর দিকে সবাই নজর দেয়। শহরের হাওয়া লেগে তার লজ্জাও কমে গেছে। একজনের সাথে প্রায়ই সে হেসে হেসে কথা বলে। কোরবান সাবধান করলেও গুরুত্ব দেয় না শরবানু। একদিন বাসায় ফিরে কোরবান হতবাক হয়ে যায়। চরিত্রহীন তহির মাস্তান তার বিছানায় শুয়ে আছে। শরবানু তার বগলে বসে পান দিচ্ছে। তাকে দেখে তহির হেয়ালি সুরে বলল-“কি ব্যাপার কোরবান ভাই, কাজ থেকে আসা হল। একটু দেরিতে এলে হত না। তোমাদের এখানে যে একটু আরাম করতে আসব তারও জো নেই।” কথা শুনে কোরবানের মাথায় খুন চাপে। শরবানু তহিরের কথায় খিলখিল করে হাসে। সে কোরবানকে বলে-“ভাইজান আরাম করতে চায় করুক। ওনারা আমাদের রক্ষক। আমরা যদি ওনাদের মন রক্ষা না করে চলি তাহলে আপদ ঠেকাবে কে।” কথা শুনে সে থ মেরে যায়। শরবানু বলে কি?
কোরবানের পায়ের তলার মাটি সরে যায়। এই কী তার জীবনের চাওয়া। আজ স্ত্রী মাস্তান নিয়ে মউজ করছে। দুদিন বাদে মেয়েটাও যাবে ঐ পথে। সে যদি গ্রামে মাটি কামড়ে পড়ে থাকত তাহলে আজ এই দৃশ্য দেখতে হত না। তার বাবা ছিল খাঁটি নামাজি মানুষ। শরবানুর বাবাও ছিল পরহেজগার খান্দানের লোক। সারাটা জীবন সে গ্রামের মকতবে বাচ্চাদের দ্বীনি এলেম শিক্ষা দিয়েছে। আর তার মেয়ে শরবানু আজ কোন রাস্তায় চলছে। কোরবান জীবন দেবে তবু এই অন্যায় সহ্য করবে না। আজ একটা ফায়সালা না করে সে ছাড়বে না। শরবানুর এই অধঃপতন কখন থেকে শুরু হয়েছে সে আন্দাজ করতে পারেনি। তবে কি অনেক আগে থেকে সে নরকের পথে যাত্রা শুরু করেছে? কোরবান রুখে দাঁড়ায়। সে চোখ দিয়ে যা দেখল তা মেনে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে তহির মাস্তানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার টুঁটি চেপে ধরে মাটিতে আছড়ে ফেলতে চায়। কিন্তু শরবানু তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। আর কিছু বলতে পারে না কোরবান। তার যখন জ্ঞান ফেরে তখন অনুভব করতে পারে সে হাসপাতালে শুয়ে আছে। তার ডান পায়ের উরুর হাড় ভেঙে গেছে। দাঁড়াবার শক্তি নেই তার। তার মাথায়ও প্রচ- আঘাত লেগেছে। সেই আঘাতে তার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গেছে। কে তাকে হাসপাতালে এনেছে সে একটুও বলতে পারে না। জ্ঞান ফিরে সে জানতে পারল বস্তিবাসির সহযোগিতায় তার ছেলে হজরত তাকে হাসপাতালে এনেছে। এখন হজরত গ্যারেজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে তার খোঁজখবর নেয়।
ছয় মাস হাসপাতালে থেকে খানিকটা সুস্থ হয়ে সে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করল। ডান পায়ে খুব একটা শক্তি নেই। লাঠিতে ভর দিয়ে কোনমতে চলতে হয়। নীলক্ষেতের একটা বস্তিতে ছেলেকে নিয়ে থাকে সে। মেয়ে ফুলজানের খবর সে জানে না। সে শুনেছে শরবানু তহির মাস্তানের ঘর করছে। মেয়েটা কেমন আছে এ নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। খারাপ সঙ্গ পেয়ে মেয়েটা না জানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। মা যদি খারাপ হয় মেয়ে ভালো হয় কী করে। এখন তার নিজের জীবন বাঁচে না। তবু মেয়েটার কথা ভেবে রাতে তার ঘুম আসে না। খোদার কাছেও সব সময় মেয়ের ইজ্জত-আবরুর সুরক্ষা কামনা করে। এই পচন ধরা সমাজে দস্যুদের অপহাত থেকে নিরাশ্রয় নারীর সম্ভ্রম কিছুতেই রক্ষা পায় না। যে নারী স্বামী বেঁচে থাকতে অন্যায়ের পথে নিমজ্জিত হয় তাকেও ক্ষমা করা যায় না।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নীলক্ষেতের আশেপাশে ভিক্ষে করে কোরবান। এ ছাড়া আর উপায় কি? তারা তিনজন ভিক্ষুক একসাথে গান-গজল করে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একাকি কাজ করার চেয়ে এভাবে পরতা পড়ে বেশি। ভিক্ষার ফাঁকে খোশগল্প করে সারাদিন আনন্দে কাটে। তাছাড়া চাঁদাবাজ, মাস্তান ও মক্করবাজদের ঝামেলা থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যায়। নানারকম উৎসাহব্যঞ্জক গান গেয়ে তারা মানুষকে দানে অনুপ্রাণিত করে। জনগণ অবশ্য দান কম করে না। তাতে লাভ কি? দানের ফায়দা তো বারোভূতে বখরা করে খায়। এ যে কোন ফেতনার জামানা। ফকির-ফাকরারা খয়রাতি পয়সার বাটোয়ারা ফক্করবাজদের না দিয়ে হজম করতে পারে না। অন্ধ-আতুরদের রক্ত যারা চোষে তাদের জন্য কোন জাহান্নাম বরাদ্দ আছে কোরবান তা জানে না। কোরবানের দেহখানা এখন ঝালাই করা গাড়ির মতো হয়ে গেছে। এই লক্করঝক্কর বডি নিয়ে মুর্শিদের দোয়ায় সে দুপয়সা কামাই করে খাচ্ছে। ভিক্ষার ফাঁকে তারা তিনজনে চানাচুর দিয়ে ডবল চা খায়। মনটা চাঙ্গা না করলে তো কাজে মন বসে না। তাদের কামাই দিয়ে বাজানরা ক্লাবে ফূতি করে। মিথ্যে বলে দোষ নেই। সিগারেটটা সে দামিই খায়। তার বউ নিয়ে অন্যে মজা করছে। তার বিগড়ানো দেমাগটা সে কী দিয়ে আয়ত্ত করবে।
তবে ছফুরার জন্য তার মনটা খুবই ছটফট করে। এক কমিশনারের বাসায় ঠিকালি কাজ করে সে। বয়স বুঝি চল্লিশ ধরা ধরা। চলাচলের সময় বাসাটার সামনে এক-আধবার হাঁক-ডাক দেয় কোরবান। যদিও সে ইদানিং বাসায় যেয়ে ভিক্ষা করে না, তবু একটা বাসার সামনে তার পা থেমে যায়। ওর আওয়াজ শুনলেই হেলেদুলে বাসা থেকে বের হয়ে আসে ছফুরা। গা ঝাঁকি দিয়ে বলে-
“আইজ ফহিরের ভিক্ষা জোটে নাইকা?”
“হ,দশবাড়ি বেড়াইনা কপাল। বইসা থাইকা কি প্যাট চলে?”
“তয় মতলবডা কি। ছফুরারে মনে ধরে?”
“যদিল একিন না হয় বুকখান ফাডায়া দেই।”
“ফহিরের আবার পিরিতের খায়েস।”
আহা কথা তো নয় যেন চাকুর ধার। কোরবানের বুকটা জখম করে দেয় ছফুরা। ছয়মাস হাসপাতাল ঠেলে ওর দেহে কতটা মর্দামি আছে। বাবা-মা খেয়ে না খেয়ে দেহটা যতটুকু মেরামত করে দিয়েছে তারই জোরে ধকল সয়ে টিকে আছে কোরবান। ছফুরার জন্য তার মন শিমুল তুলোর মতো উড়ে বেড়ায়। সে যদি তার গলায় দড়ি দিয়ে ভেড়ার মতো টেনে নিয়ে বেড়াত। কোন আপত্তি করত না সে। সারাদিন ওর পিছে পিছে টু শব্দ না করে ঘুরে বেড়াত। কমিশনারের বাসায় থাকে কথাবার্তা একদম ছকছকা। ওর সাথে কথা বলতে শরম লাগে কোরবানের। ওর চেহারা সুরত কত ফিটফাট। অমন সুন্দর মহিলা তার সাথে হৃদয়ের দরদ ঢেলে কথা বলে এতে ওর মন গলে যায়। তার কপালের লাল টিপটা কতই না ভালো লাগে। এখন মাঝরাতে হুট করে ঘুম ভাঙে কোরবানের। তার মনের দেয়ালে ছফুরার অমলিন ছবি কে যেন লটকিয়ে যায়। ছফুরাকে মনের কথা সাহস করে বলতে পারে না সে। যে রূপবতি তাগড়া মহিলা। কোন অঘটন না জানি ঘটায়। তার চেয়ে কোরবান অন্যরকম কথা বলে-
“তোমার মালিক কোন পাট্টি গো”?
“ছরমিক পাট্টি। হে ছরমিক গো নেতা।”
“হেতি ফহিরগো কতা কয় না”?
“হেতি ফগিরগো একদম পছন্দ করে না।”
“সেকি! ফহিররা মানুষ না? হেরাই তো সব্বহারা।”
“হে কয় তারা ছরমিকের শত্রু। দেশের বোঝা।”
এমন করে অনেক আলাপে দুজনের মনোসংযোগ হয়। ছফুরার মনটাও প্রবল আকর্ষণে কোরবানের দিকে ধেয়ে আসে। তার স্ত্রীর কাহিনী শুনে ছফুরার মন ব্যথিত হয়। এমন ঘটনাও কী আল্লাহর দুনিয়ায় ঘটতে পারে! লোকটা তো আগে ভিক্ষুক ছিল না। খেটেখাওয়া পরিশ্রমী মানুষ ছিল। পরিস্থিতি তাকে এ পথে টেনে এনেছে। এখনও কোরবানের চেহারায় পৌরুষের যে ছাপ আছে তা অবলোকন করে ছফুরার মন বিগলিত হয়। এমন একজন সহজ সরল হৃদয়বান মানুষের হাত ধরে সে সংসারের অরণ্যে হারিয়ে যেতে রাজি। তবু নীতিভ্রষ্ট কমিশনারের খেলার গুটি হয়ে থাকতে সম্মত নয় সে। এদের বিকৃত রুচি দেখে তার মনটা বিষিয়ে উঠেছে। যাদের হাতে অনাথের সুরক্ষা নেই তারা সমাজের নেতৃত্বে। সব বঞ্চিতরা মনে হয় এক অভেদ যন্ত্রণার ভাগীদার। এক সমমাত্রিক দুর্দশার নিষ্পেষণে তারা পর্যুদস্ত। ছফুরা চায় কোরবান কোন সম্মানজনক পেশা গ্রহণ করুক। এই হীন পেশা থেকে তাকে মুক্ত করার চিন্তা করে সে। প্রয়োজন হলে রাজধানীর কোলাহল ছেড়ে দূরের কোন লোকালয়ে সামান্য কারবার করে তারা জীবন নির্বাহ করবে।
এসব কথা কোরবানের মনেও জাগে। এই নিন্দনীয় জীবনের পরিসমাপ্তি চায় সে। ছফুরার জন্য সে নিজের পরিবর্তন কামনা করে। শরবানুকে হারিয়ে তার মনটা শূন্যতায় ভরে গেছে। একজন স্বামীপ্রাণা নারীর জন্য সে চাতকের মতো অধীর হয়ে আছে। সে অবশ্যই একদিন ছফুরাকে নিয়ে দূরে চলে যাবে। তারপর অজানা এক গ্রামে একটি শান্তির আবাস গড়বে। তত কাজ থাকবে না। থাকবে শান্তিময় সংসারযাত্রা আর অসংখ্য নিদ্রাহীন রাতের হৃদয়ঘন রসালাপ।
ছফুরাকে নিয়ে কোরবানের সত্তা প্রেমের মদিরায় নিমজ্জিত তখন একদিন এক ভদ্রলোক দামি কারে চড়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। অত্যন্ত বিনয়ে সাথে লোকটা তার কদমবুছি করল। কতদিন থেকে লোকটা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এমন অভিযোগের ভঙ্গিতে কথা বলতে লাগল।
“বাবা। আপনি এখানে বসে কি করছেন?”
“কি করব বাবা। আমার যে ভিক্ষা করইনা কপাল।”
“না না এটা অসম্ভব। আপনি কেন ভিক্ষা করবেন?”
“ভিক্ষা না কইরা কি করুম। কোনে পামু খাবার?”
“সে চিন্তা করতে হবে না আপনাকে। উঠুন গাড়িতে।”
“না বাপু। সেটা কেমনে হয়। কোনে যামু আমি?”
“কেন আমার বাসায় যাবেন। আমার বউ খেদমত করবে আপনার।”
“আমি যে পতের ফহির। এসব কি কও বাপু?”
“ না না। আপনাকে আর ভিক্ষা করতে দেয়া হবে না।”
“না বাপু আমার যাওয়া হবে না। বহুত ভ্যাজালে আছি আমি।”
লোকটা কোরবানকে চিন্তা করার অবকাশ দেয় না। তার সাথের ফকিররা ঘটনার আকস্মিকতায় থ মেরে যায়। কোরবানের ভাগ্য এত ভালো যে গাড়ি নিয়ে ছেলে চলে এসেছে। এসবের মাথামু-ু কিছু বুঝতে না পেরে তার আঙুল দিয়ে দাঁড়ি খিলাল করে। ছফুরার সাথে দেখা করার সুযোগও দেয় না লোকটা কোরবানকে। বাবা হয়ে ছেলের সামনে একটি ব্যক্তিগত দুর্বলতা কেমন করে প্রকাশ করবে সে। তাছাড়া সে চলে গেলে আগলপাগল হজরত কার কাছে থাকবে। গাড়িতে দুজন ষ-ামার্কা যোয়ান ছেলে ছিল। তারা পাজাকোলা করে মুহূর্তে কোরবানকে গাড়িতে তুলে নেয়। ড্রাইভার দ্রুত গাড়ি চালিয়ে রাজপথের জনারণ্যে মিশে যায়। কোরবানের ভিক্ষার ঝোলা আর ভিক্ষালব্ধ খুচরো পয়সা ফুটপাতে পড়ে থাকে।
কোরবানকে নিয়ে যাওয়া হয় এক বিশাল অট্টালিকায়। একটি প্রশস্ত কক্ষ সাজানো হয়েছে তার বসবাসের জন্য। মনোরম বাথরুমে তাকে গোসল করিয়ে দামি পোশাক পরানো হয়। টেবিলে রাখা আছে উপাদেয় খাবার। মাথার উপর ঘুরছে খইতান ফ্যান। তরতাজা ফল, বিস্কুট, কফি এবং উন্নতমানের পানীয় সুদৃশ্য টেবিলে সজ্জিত করে রাখা হয়েছে। তার ছেলের নাম মোস্তফা জালাল। সে বারবার এসে তার খবর নিচ্ছে। চাকর বাকরের উপর কড়া নির্দেশ বাবার যেন কোন সমস্যা না হয়। তার শোবার খাটের পাশে দামি সিগারেট, লাইটার, পান, জর্দা, পিকদানি, ছাইদানি কত কী! যেন এক রাজকীয় জীবন। কালার টেলিভিশনের বিদেশি চ্যানেলের এডভেঞ্চার সিরিজ, মক্কা-মদিনার ঝকঝকে দৃশ্য কোরবানের মনকে অন্য জগতে নিয়ে যায়। খাবার পর নরম শয্যায় গা এলিয়ে লম্বা ঘুম দেয় কোরবান। রাতে তার সাথে জরুরি পরামর্শে বসে মোস্তফা। তার কাছে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে সে। ঢাকা শহরে পাখির মতো টাকা উড়ে বেড়াচ্ছে। ধরার মানুষ নেই। এই টাকা ধরতে হবে। কোরবানের কাছে সে কিছু চায় না। শুধু দোয়া চায়। পুত্রের প্রতি পিতার দোয়া। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে মোস্তফা। জীবনে সে অনেক পেয়েছে শুধু বাবার দোয়া পায়নি। কোরবান ইচ্ছে করলে সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারে। এখন থেকে তার কাজ হল খাবে দাবে আর ছেলের জন্য খোদার দরবারে খালেছ মনে দোয়া করবে। কথা শুনে কোরবানের মনটা বিগলিত হয়ে যায়।
সে শুধু চিন্তা করে কী হচ্ছে এসব। ফুটপাত থেকে একেবারে সুউচ্চ বালাখানায় তার অবস্থান। এটা কী কল্পনা করা যায়। ফোমের বিছানায় শুয়ে টিউব লাইটের নরম আলোয় তার মগজে চিন্তার রুপালি তরঙ্গ নৃত্য করে। ছেলে যদি এতসব সুখের কথা খেয়াল করে তাহলে ছফুরার প্রসঙ্গটা তার সামনে তোলা যায় কিনা। সে এলে তো তার সেবাযতেœর কোন ঘাটতি থাকবে না। খোদার কাছে প্রার্থনা করতে হলেও মনের স্বস্তির প্রয়োজন। ছফুরা না থাকলে তার মন এখানে বসবে না। সে তার মনটাকে গরম তাওয়ায় মচমচা করে ভেজেছে। রাতে একটুও ঘুম আসে না। এটাকে কোনক্রমেই সুখের আবাস বলা যায় না। মনে হয় এটা একটা কষ্টের জেলখানা। দম বন্ধ হয়ে আসে। হজরত আর ফুলজানের কথা ভেবে তার চোখে পানি আসে।
কোরবান বাণিজ্যের কি বোঝে। তবু তার মনটা কায়-কারবার করার জন্য উতলা হয়। মোস্তফা বলেছে শহরে টাকা উড়ে বেড়ায়। যারা ধরতে পারে তারা চকচকে টাকার উপর গড়াগড়ি খায়। বড়লোক হয়ে রাস্তায় চার চাকায় চড়ে বেড়ায়। পরের ছেলে হোক না। বাবা বলে যখন ডেকেছে উড়ন্ত টাকা আায়ত্ত করার কায়দা তাকেও নিশ্চয় শেখাবে। বাপ ছেলেতে বনিবনা না হলে কোরবান সেই টাকায় সংসার চালাবে। তখন ছফুরাকে সাদি করে ছেলে মেয়েকে নিয়ে শহরে থাকতে কোন সমস্যা হবে না। ডান পায়ের চিকিৎসাও করবে সে। পঙ্গু হাসপাতালের ডাক্তার একখানা অপারেশন করতে বলেছিল। টাকার অভাবে করতে পারেনি সে। এখন ছেলে যদি নজর দেয়। আল্লা মোস্তফার ভালো করুক। পথের ফকিরকে কেউ বাবা বলে ডাকে। আর তহির মাস্তান। দেখা যাক। খোদা চায় তো ওরও ব্যবস্থা হবে।
প্রতি মঙ্গলবার কালামপুরে বড় হাট বসে। রাতে সিদ্ধান্ত হয়েছে। হাটে যেতে হবে কোরবানকে। ধান, চাল, গরু, মহিষ কতকি কেনা হবে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় চালান দেয়া হবে এসব মালামাল। তার কোম্পানির নাম হল ‘মোস্তফা জালাল’ সাপ্লায়ার্স। সকাল থেকে সাজসাজ রব। মোস্তফার কড়া নির্দেশ। আজ বাবাকে নিয়ে প্রথম কেনাকাটা। কোনদিকে যেন একটুও ত্রুটি না হয়। নির্দেশ শুনে কর্মচারীরা ভয়ে অস্থির। না জানি কখন কোন ভুল হয়ে যায়। ব্যবসার বিভিন্ন সেকশনে কাজ করছে জাদরেল সব ম্যানেজার।
ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে বিশ পঁচিশ খানা। বাজারে আগেভাগে পজিশন নেয়া হয়েছে। ডেকোরেশন থেকে দামি আসবাব ভাড়া নেয়া হয়েছে। সকালে গোসল করেছে কোরবান। সকালেই হয়েছে তার মানানসই সাজসজ্জা। পায়জামা, পাঞ্জাবি, নকশাদার টুপি, হাজি গামছা, চামড়ার চটিজুতা, সৌদি ছাতা, মোটাদানার হাতির দাঁতের তসবি এবং এন্ড্রয়েড মোবাইল সেটে তাকে একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী মোস্তফা জালালের অরিজিনাল বাবা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। অত্যন্ত তাজিমের সাথে হাটের অস্থায়ী গদির সংরক্ষিত আসনে তাকে বসানো হল। টেবিলের চারপাশে দশখানা দামি কুশন চেয়ার। হাটের বড় বড় ব্যবসায়ীর সাথে বাবার পরিচয় করিয়ে দিলেন মোস্তফা। বাবা আজ নিজেই এসেছেন বাজারের অবস্থা দেখতে। কমছে কম দশ হাজার মন চাল নগদ ক্যাশে খরিদ করা হবে। পরিচয় পর্বের পর লাকি পারচেজ শুরু হল। রাশভারি ম্যানেজার পাকা খাতায় লিখে রাখছে সব। মোবাইলে বিভিন্ন মোকামের সাথে কথা বলছে মোস্তফা। ট্রাক ভর্তি মাল যাচ্ছে মোকামে। মাল এডজাস্ট করার পর পেমেন্ট। বাবা আজ নিজ হাতে পেমেন্ট করবেন। ঘন ঘন পরিবেশন করা হচ্ছে চা কফি ও ফলমূল।
চলছে পান, সুবাসিত জর্দা, কোকাকোলা। মোস্তফার বাবাকে পেয়ে সবাই খুশি। এরকম মালদার পার্টি কালামপুরে আসা শুরু হলে ব্যবসার গতিই পরিবর্তন হয়ে যাবে। বাইরের খরিদ্দার না এলে বাজার তো ওঠে না। আর ছেলেটা কত অমায়িক। আদর যতেœ পিতাকে কেমন ডুবিয়ে রেখেছে। এমন না হলে জীবনে কেউ বড় হয়। শেষের দিকে আপ্যায়নের মান আরও উন্নত হতে লাগল। কর্মচারীদের কাজকর্মের কড়া নির্দেশ দিয়ে মোস্তফা কার নিয়ে গরুর হাটটা একটু দেখতে বের হল। একটা ইন্ডিয়ান গাই কিনতে হবে। বাজারের দুধ বাবা একটুও পছন্দ করে না। বড় লোকদের কারবারই আলাদা। এসব কথার জাবর কেটে আড়তদাররা মুখরোচক খাবারে মশগুল হয় থাকল।
গরুর হাটে গিয়ে মোস্তফা জালাল লাপাত্তা। চোখ মেলে কোরবান দেখে তার পাশে কেউ নেই। বয়, বেয়াড়া, কেরানি, ম্যানেজার সবাই সরে পড়েছে। পেমেন্ট নেয়ার জন্য ব্যবসায়ীরা টেবিলের চারদিকে অপেক্ষা করছে। তাকে বারবার চাপ দিচ্ছে টাকা দেয়ার জন্য। টাকা সে কোথায় পাবে। টাকা দেবে তো মোস্তফা। গরু কিনে এসে সবার টাকা পাইপাই করে বুঝে দেবে। এখনই সে এসে পড়বে। রাত দশটা পার হয়ে গেল। মোস্তফা এবং কর্মচারিরা ফিরে এল না। সবাই বুঝতে পারল টাকা পরিশোধ করতে কেউ আসবে না। অতএব এই বুড়ো বাবার কাছে টাকা আদায় করতে হবে। কিন্তু সে তো আসল বাবা না। নকল বাবা। ফুটপাত থেকে সংগ্রহ করা একদিনের প্রহসনের বাবা। চাপের মুখে কোরবান সব বলে দেয়। সে সরল মনে এখানে এসেছে। ভেতরে যে এত নাটক ছিল সে কী করে জানবে। একজন তার মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে দেখে সেটা অকেজো। আর যায় কোথায়। এতগুলো উত্তেজিত মানুষের কিল-ঘুষি একটাও মাটিতে পড়ল না। যে যতটা পারল তার বাবা হওয়ার সখ ইচ্ছেমতো মিটিয়ে দিল। হাটখোলার বিশাল চত্বরে সারারাত অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকল সে। মারের চোটে ডান পায়ের জোড়া লাগা পুরনো ভাঙ্গাটা গেল ছুটে। যারা তাকে হাসপাতালে রেখে গেছে মাবুদ তাদের ভালো করুক।
একটু সুখের জন্য কোরবান অচেনা পথে পা বাড়িয়েছে। এখন সে প্রত্যক্ষ করছে তার সামনে বয়ে যাওয়া দুঃখ নদীর শতবাঁক।