শুক্রবার ০১ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

সন্ধ্যার ছায়া নামে

জোবায়ের রাজু 

এই পড়ন্ত বিকেলে অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ পথে জ্যাম তুলনামূলকভাবে কম, জহির সাহেবের কাছে বিষয়টি বেশ ভালো লাগছে। রাজপথ ধরে ছুটে চলছে বাস। জহির সাহেব সে বাসে চড়ে লক্ষ্মীপুর থেকে নোয়াখালী ফিরছেন। একা নন, পাশে বসে আছে তার ছেলে সামির। ছেলেকে নিয়ে তিনি গত পরশু বন্ধু ওহাব আলীর বাড়ি লক্ষ্মীপুর গেছেন। ফিরছেন আজ। 

চলন্ত বাসের জানালা দিয়ে জহির সাহেব বাইরের পরিবেশ দেখছেন আর চশমার ফাঁক দিয়ে চোরা চোখে ছেলেকে দেখছেন। সামির একমনে ফেসবুকে মগ্ন। ছেলেটা যেভাবে দিন দিন ফেসবুক নির্ভর হয়ে উঠেছে, তা আমলে নিচ্ছেন না জহির সাহেব। টাইমÑটেবিল না মেনে, নাওয়াÑখাওয়া ভুলে, এমনকি অনেক সময় লেখাপড়াকে ফাঁকি দিয়ে সামির ফেসবুকে ডুবে থাকে। রাতভর ফেসবুকের আড্ডা শেষ করে ভোররাতে বিছানায় যাওয়াটা আজকাল স্বভাবে পরিণত হয়েছে সামিরের। ছেলেকে ফেসবুক থেকে ফেরাতে অনেক বকাঝকা করেও উন্নতি কিছুই পাননি জহির সাহেব। তিনি মনে করেন ফেসবুক ওপেন করা মানেই অযথা সময় নষ্ট করা। খবরের কাগজে প্রায়ই তিনি পড়েন ফেসবুক নিয়ে নানান কেলেংকারিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনৈতিক অনেক কিছুই হচ্ছে। সেসব খবর পড়ে ছেলেকে তিনি শাসনের সুরে ফেসবুক থেকে অব্যাহতি নিতে বলেন। কিন্তু সামির বাবার কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং বিজ্ঞের মতো বাবাকে বোঝায়, ‘ফেসবুক খারাপ, এ ধারণা ভুল আব্বু। এটা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম।’ জহির সাহেব ছেলের কথায় বাঘের মতো গর্জে উঠে বলেন, ‘আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস!’ ফলে চুপসে যায় সামির। বাবাকে বোঝানো যাবে না, মনে মনে ভেবে স্থির হয় সে। 

চলন্ত বাস হঠাৎ করে থেমে গেলো। হেলপার জানালো পেছনের চাকা পাংচার হয়ে গেছে। গাড়ি আর সামনে এগোবে না। যাত্রীরা হতাশ হয়ে বাস থেকে নেমে পড়ে। ড্রাইভার নত গলায় জানায়, যে যেভাবে পারেন, কষ্ট করে গন্তব্যে ফিরে যান। 

ছেলেকে নিয়ে বাস থেকে নেমে পড়েন জহির সাহেব। আচমকা এ ঘটনা ঘটবে, কেউ প্রত্যাশা করেনি। এখন কী হবে! এই মেইনরোডে অন্য গাড়ি পাওয়াটাও সহজ কথা না। লক্ষ্মীপুর থেকে নোয়াখালীর দূরত্ব অবশ্য বেশি না। ভাগ্যক্রমে একটি সিএনজি পেয়ে যান জহির সাহেব। অল্প বয়সের ড্রাইভার তরুণ ছেলেটিও ন্যায্য মূল্যে নোয়াখালী ভাড়া নিতে প্রস্তুত। সিএনজিতে চেপে বসেন জহির সাহেব। সাথে সামিরও। 

২.

সিএনজি চলছে নোয়াখালীর উদ্দেশে। সন্ধ্যার ছায়া নেমে আসছে। ড্রাইভার ছেলেটি হঠাৎ রাজপথ থেকে বাম দিকের অচেনা এক মেঠো পথের দিকে সিএনজি ব্রেক করতেই জহির সাহেব জানতে চাইলেন, ‘কোথায় যাচ্ছো তুমি?’ ছেলেটি হেসে বলল, ‘সামনে পথের অবস্থা ভালো না খালু। এদিক দিয়েও নোয়াখালী যাওয়া যায়।’ স্থির হলেন জহির সাহেব। এরই মধ্যে ড্রাইভার ছেলেটি কাকে যেনো ফোন করে। 

বিশাল এক বটগাছের তলে সিএনজি থামে। জহির সাহেব কিছুই বুঝতে পারছেন না। সামিরও। সন্ধ্যার আবছা ছায়ায় হঠাৎ একদল মুখোশধারী বটগাছের আড়াল থেকে বের হয়ে এসে সিএনজি থেকে টেনে হ্চেড়ে বের করে জহির সাহেব ও সামিরকে। ড্রাইভার ছেলেটি মাতালের মতো হো হো করে হাসছে। 

পরের ঘটনাগুলি ঘটলো খুব সহজে। মুখোশধারীরা অস্ত্র ঠেকিয়ে জহির সাহেবের দশ হাজার টাকাসুদ্ধ মানিব্যাগ, দামি হাতঘড়ি, মোবাইল ও সামিরের আইফোন কেড়ে নিয়ে সিএনজিতে চেপে দ্রুত পার হয়ে গেলো। জহির সাহেবের বুঝতে বাকি থাকে না যে ওই ড্রাইভার ছেলেটিই নাটের গুরু। ছল করে এখানে নিয়ে এসেছে ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে। 

ততক্ষণে সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকার। অচেনা এই গ্রামে জহির সাহেব ছেলেকে নিয়ে বিপদে পড়বেন ভাবতে পারেননি। এই ঘটনায় সামির ভয় পেয়ে বাবার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। 

সব কিছু হারিয়ে জহির সাহেব এখন কী করবেন বুঝতে পারছেন না। টাকা পয়সা ছাড়া কী হবে এখন! ছেলের হাত ধরে সামনের দিকে এগোচ্ছেন তিনি। একটা লোককে টর্চলাইট জ্বালিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। লোকটা কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো। টর্চলাইটের পরিষ্কার আলোয় অবাক চোখে তাকিয়ে লোকটি সামিরকে প্রশ্ন করে, ‘তুমি সামির না?’ সামির ও জহির সাহেব দুজনে অবাক হলেন। এখানে তো কেউ সামিরকে চেনার কথা না। কে এই লোক! 

Ñজ্বি। আমি সামির। আপনি কে?

Ñআমি তোমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। আইডির নামÑমোহাম্মদ কামাল হোসেন। 

Ñইয়ে মানে...

Ñতোমার অবশ্য আমাকে না চেনার কথা। ফেসবুকে আমি কখনো আমার ছবি দিই না। আমার বাচ্চাদের সব ছবি। তো তুমি এখানে কিভাবে! ভদ্রলোক কে?

Ñউনি আমার আব্বু। আমরা বিপদে পড়েছি।

Ñবিপদে?

কামাল হোসেন সামিরের কাছ থেকে সব শুনলেন। জহির সাহেবও একটু ভরসা পেলেন। এই অচেনা গ্রামে এভাবে বিপদে পড়বেন আর দূতের মতো কামাল হোসেনের সন্ধান পাবেন, ধারণাও ছিলো না জহির সাহেবের। 

Ñতোমরা যেহেতু বিপদগামী, আজকের রাতটা আমার এখানে থাকো। 

Ñইয়ে মানে...

Ñকোনো অজুহাত নয় সামির। চলো, সামনে আমার বাড়ি। ফেসবুকে তোমাকে অনেক আগ থেকে চিনি। বেশ ভালো ছেলে তুমি। 

কোনো কথা না বাড়িয়ে জহির সাহেব সামিরকে নিয়ে কামাল হোসেনের সাথে তার বাড়ি রওনা দেন আর মনে মনে ভাবেন, ফেসবুক কখনো কখনো উপকারই বটে। 

৩.

রাতটা কামাল হোসেনের বাসায় কাটান জহির সাহেব। বাবাকে নিয়ে সামির রাতভর গল্প করেছে কামাল হোসেনের সাথে। সকালে নাস্তা পানি খেয়ে বিদায়ের আগ মুহূর্তে কামাল হোসেন দুই হাজার টাকা দেন জহির সাহেবকে। টাকাটা না নেওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। তবে জহির সাহেব জোর করে কামাল হোসেনের থেকে একটা বিকাশ নাম্বার চেয়ে নিয়েছেন। বাড়ি গেলে টাকাটা তিনি সে নাম্বারে পাঠিয়ে দেবেন। 

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ