বড় চাচা

সা’দ সাইফ
আফিল উদ্দীনের মা, সাইকেলটা কই গেল? গোসল থেকে ফিরে আমিন উদ্দীন সাহেব শব্দগুলো বললেন।
বারান্দা থেকে সাইকেলটা উঠানের পাশে লাগোয়া পেয়ারা গাছে হেলান দিয়ে রাখেন তিনি। প্রতিদিন সকালে গোসল সেরে সাইকেল নিয়ে বাগআঁচড়ায় যান। সেখানে তাঁর কাপড়ের ব্যবসা। ফেরেন সন্ধ্যার পরপরই।
-‘কে আর নিবে? সাইফুল নিয়েছে হয়ত!’
ফিরোজা বেগমের স্বাভাবিক ভঙ্গিমা। আমিন উদ্দীনের সহধর্মিণী তিনি।
সাইফুল হল আমিন উদ্দীনের ভাইপো। ছোট ভাইয়ের বড় ছেলে। বয়স আট কী নয়!
সাইকেল চালানো শেখা তার বাতিক। প্রতিদিন যখনই সে সাইকেলটা পেয়ারা গাছের সাথে হেলান দেওয়া দেখে, তার চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
যদিও সাইকেল চালানো সে রপ্ত করতে শেখেনি, তারপরও সাইকেলটা বগলদাবা করে দৌড়ানোর মাঝে সে সাইকেল চালানোর আনন্দ পায়। আজ সাইকেলটা নিয়ে গেছে কিন্তু ফেরার নামগন্ধ নেই সাইফুলের।
ইতোমধ্যে তাঁর চাচা গোসল শেষ করে খেতেও বসে গেছেন। খাওয়াদাওয়া শেষ করার মিনিট দশেক পর সাইকেল নিয়ে বান্দা হাজির। বাজারে যেতে দেরি হওয়ায় আমিন উদ্দীন সাহেবের কিছুটা রাগান্বিত চেহারা ফুটে ওঠে ভাইপোর ওপর।
ছোট্টো সাইফুলও বুঝতে পারে আজ সাইকেল নিয়ে ফিরতে তার একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে। তাই রাগের কারণ বুঝতে পেরে তার মুখটা কিঞ্চিৎ কালো হয়ে যায়।
আমিন উদ্দীন সাহেব সেদিনকার মতো বাজারে চলে গেলেন। রাতে ফিরলেন রূপচাঁদা মাছ নিয়ে। যখন রাতের খাবার গ্রহণ করার জন্য দস্তরখান বিছালেন, ছোট্ট করে ডাক দিলেন, ‘বাবা সাইফুল্লাহ’ তিনি আদর করে সাইফুলকে সাইফুল্লাহ বলে ডাকেন। অন্যদিন সাইকেলের বেলের শব্দ শুনেই সাইফুল তাঁর চাচার পাশে এসে ঘুরঘুর করতে থাকে, আজ হয়ত অভিমানে চাচার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। চাচাও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আদর করে ডেকে ওঠেন।
-‘আয় বাবা, পাশে বস।’ ‘আফিল উদ্দীনের মা, ওরে ভাত দাও।’ তারপর চাচা ভাইপো একসাথে খেতে শুরু করে। খেতে খেতে শুরু করে দিলেন নানা কিছিমের গল্প। ছোট্ট সাইফুলের মুখে তখন জরিদার আনন্দ!
আমিন উদ্দীন সাহেবের একটা অভ্যাস, বাজারে নতুন কোন সবজি বা মাছ উঠলে সেটা তিনি খরিদ করে বাসায় আনবেন, পরিমাণ অল্প হলেও। আর খেতে বসার সময় ভাইপো তাঁর নিত্যসঙ্গী। এর এদিকসেদিক হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
এভাবেই দিন যেতে লাগলো। সাইফুলও ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো। তৃতীয় থেকে চতুর্থ এবং পঞ্চম শ্রেণিতে উন্নীত হলো।
সময়ের কালক্রমে, একটা সময় সাইফুল দেখতে পেল তাঁর চাচা আর বাজারে যান না। খাওয়াদাওয়াও সেভাবে করেন না। মুখটাও কেমন যেন বসে গেছে। আগের মতো আর কারও সাথে কথাবার্তা সেভাবে বলেন না।
সকালবেলা ফজরের নামাজের পর যে সুললিত কণ্ঠে তিনি কোরআন তেলওয়াত করতেন, সেটাও ইদানীং বন্ধ হয়ে গেছে। সাইফুলের ছোট্ট মনে কৌতূহল দানা বাঁধতে শুরু করে। কী এমন হলো তাঁর চাচার সাথে। সেই আগ্রহ থেকে বাড়ির লোকজনের থেকে জানতে পারে তাঁর চাচার মুখে ঘা হয়েছে। এজন্য তিনি খেতে পারেন না।
এটা শোনার পর সাইফুল ভেতর থেকে ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। তার ভেতরকার কষ্ট সে কাউকে বোঝাতে পারে না। না নিজেকে, না অন্য কাউকে।
একটা সময়ে আমিন উদ্দীন পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। মুখের ঘা’য়ের কারণে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতে পারেন না এমনকি কিছু খেতেও পারেন না পানীয় ছাড়া।
-‘সাইফুল আব্বা, বড়চাচা তোকে ডাকছে।’
সাইফুল তাঁর বড় চাচার ডাক শুনতে পায় না, তার মা তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বড় চাচার পাশে এসে বসে সে। আস্তে করে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে ভাইপোকে জিজ্ঞাসা করে, ‘সমাপনী পরীক্ষায় ফলাফল কী?’ এত অসুস্থতার মধ্যেও যে তিনি ভাইপোর পরীক্ষার কথা ভোলেননি, সেটাই অবাক করে দেয়।
-‘প্রথম বিভাগ ‘ শুনেই চাচার মুখে অস্ফুট হাসি ফুটে ওঠে।
এটাই চাচার সাথে সাইফুলের শেষ আলাপ।
ধীরে ধীরে আমিন উদ্দীন আরও দুর্বল হতে থাকেন। দেখলে মনে হবে শুকনো একটা কঙ্কাল।
শুক্রবার। মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা এলো, একটি শোক সংবাদ।
মরণঘাতী ক্যানসারের সাথে লড়াই করে সাইফুলের চাচা হার মেনেছেন। চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সেদিনকার আকাশ বাতাসও গুমোট হয়ে এসেছিল মৃত্যুর সংবাদে। চারপাশ থেকে দলে দলে মানুষজন আসছিল আমিন উদ্দীনকে শেষ দেখা দেখার জন্য।
মৃত্যুর সময় সাইফুল তাঁর চাচার পাশেই ছিল। চারপাশে যখন কান্নার রোল, সে তখন কীভাবে কাঁদতে হয় তাও ভুলে গেছিল। হয়ত তাঁর চাচার প্রাণহীন দেহই তাকে বারবার বলেছিল, ‘মৃত্যু দেখে কাঁদতে নেইরে বাবা, এ তো নতুন জীবনযাত্রা।’ নবজীবন।