ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে আল মাহমুদের কবিতা

ড. ফজলুল হক তুহিন
বাংলা অঞ্চলে উপনিবেশের অধীনে উনিশ শতকের জাতীয়তাবাদী রেনেসাঁ থেকে তিরিশোত্তর আধুনিকতাবাদী সাহিত্যধারা পর্যন্ত বাংলা কবিতা প্রধানত পশ্চিমাকরণের পথে বিস্তৃত ও প্রবাহিত হয়। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের মাঝে প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য, পাশ্চাত্যের উদার মানববাদ ও ইরানের সুফিবাদী ধারার মোহনা সৃজন-মননের বিপুল পৃথিবী নির্মাণ করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে রবীন্দ্র-মায়া জগৎ ভেঙে যে নতুন যুগের আবির্ভাব ঘটে তা ধারণ ও প্রকাশে কাজী নজরুল ইসলাম অপরিহার্য কালোজ ও কালোত্তীর্ণ স্রষ্টারূপে হাজির হন ধূমকেতুর মতো। নজরুল-পূর্ব যুগ পর্যন্ত ভারতীয় জাতিবাদ মূলত সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ ও উপনিবেশিক ক্ষমতা-কাঠামোর সহায়ক শক্তি হিসেবে ছিলো কার্যকর। নজরুল প্রথম এই ক্ষেত্রে হয়ে উঠলেন অদ্বিতীয় প্রতিভূ। জাতপাতশ্রেণিবর্ণ ও সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে মানববাদের নিশান সর্বোচ্চ শিখরে স্থাপন এবং উপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল-অধীনতা থেকে প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। বাংলা কবিতার বি-উপনিবেশের এই তুমুল আন্দোলনে চল্লিশের দশকে ডান ও বাম পন্থার আদর্শবাদী দুটি ধারা কথিত আধুনিক সভ্যতা ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ, দেশভাগ-স্বাধীনতা, দাঙ্গা, মন্বন্তরের অভিঘাতে জর্জরিত সমাজ-বাস্তবতার মাঝে এশিয়ার এক মৌলিক ও শক্তিমান কবি হিসেবে আবির্ভাব ঘটে কবি আল মাহমুদের (১৯৩৬-২০১৯)। বি-উপনিবেশের পথে এই কবি শেকড় ও স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলা আমাদের নিয়ে আসেন পশ্চিমা আধুনিক সভ্যতার বদলে আবহমান দেশজ গ্রাম-সভ্যতায়। এই মনোভঙ্গি কবিকে সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থানে ও স্বাধীন চেতনায় উজ্জীবিত করেছে।
কবি নিজ সমাজের যেমন বাসিন্দা, তেমনি মানসিক দিক থেকে বিশ্বনাগরিকও। আপন সমাজচৈতন্যকে আলোড়িত করার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনাবলীও তাকে সমানভাবে ভাবায়। সংবেদনশীল কবি মাত্রই বৈশ্বিক সমাজের চলমান ভাবধারায় নিজেকে একাত্ম করেন। আর কবির সমগ্রতাও অর্জিত হয় ব্যক্তিসত্তা ও সমাজসত্তার সম্মিলনেই, সে-সমাজ দৈশিক ও বৈশ্বিক উভয়ই। বাংলা কাব্যে কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম সচেতনভাবে এই আন্তর্জাতিকতা নিয়ে আসেন; আর রাজনৈতিক চেতনা চল্লিশের দশকে সক্রিয় ও বিস্তৃত হয়; সমকালীন বিশ্বের সাথে মানসিক যোগযোগ গড়ে তোলেন। বিশেষভাবে বিশ্বের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত ও জোয়ারের পটভূমিকায় আদর্শবাদী মনোভাবের অধিকারী কবিবৃন্দ এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখে, বায়ান্নোত্তর কবিরাও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক চেতনা ধারণ করে কবিতা লেখেন। আল মাহমুদ মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নে বারবার চেতনাকে জাগ্রত এবং প্রতিবাদী ভূমিকায় নিজেকে অবতীর্ণ করেন। এক্ষেত্রে নিজ জন্মভূমি ও ভিন্ন দেশের মানুষের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য বিবেচনায় আনেননি। ফলে পৃথিবীর যে প্রান্তেই মানবাধিকার লংঘন এবং স্বাধীনতা বিপন্ন হয়েছে সেখানেই কবি কবিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। আল মাহমুদ তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে অঙ্গীকারবদ্ধ।
এক দীর্ঘস্থায়ী ও রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম ফিলিস্তিনী ভূ-খ-ে এখন পর্যন্ত অব্যাহত। ১৯৬৭ সালের ইহুদি আগ্রাসনের পর থেকে হাজার হাজার ফিলিস্তিনীকে অত্যন্ত অমানবিকভাবে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। ইসরাইল পাখি শিকার করার মতোই টার্গেট করে করে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে বহু ফিলিস্তিনী নেতা ও সাধারণ ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছ। একবিংশ শতাব্দীর এই তথ্য-প্রযুক্তির যুগে এসেও ফিলিস্তিনীরা তাদের ন্যায্য অধিকার, নিজেদের বসতভিটা, নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ফিরে পাচ্ছে না।
কৈশোরে আল মাহমুদ কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিবাদী ও বিদ্রোহীমূলক কবিতাবলী দ্বারা প্রভাবিত হন। এছাড়া তুর্কি কবি নাজিম হিকমতের কবিতার সাথে পরিচয় ঘটেÑ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদের মাধ্যমে। যৌবনে তিরিশের দশকের বিষ্ণু দে, চল্লিশের সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও মঙ্গলাচরণের প্রতিবাদী কাব্যজগতের অধিবাসী হন। তবে অন্য কবিদের থেকে বিষ্ণু দেণ্ডর মননধর্মীতা ও আঙ্গিকশৈলী তাকে বেশি আকৃষ্ট করে। এইসব কবির চেতনাগত প্রভাবে তিনি সমাজ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করেন-
সমাজের যে বিষয়ে আমি মানুষকে আনন্দ দিতে চাই, ধাবিত করতে চাই, দুঃখ বা ব্যথিত করতে চাই কিংবা ক্ষোভ জাগিয়ে দিতে চাই- রাজনৈতিক ক্ষোভ, সমাজ পরিবর্তনের ক্ষোভ- এগুলো সবকিছু সচেতনভাবে করি। কারণ আমি মনে করি যে, একটা দায়িত্ব আমার অবশ্যই আছে। যখন দেশ চাইছে মঙ্গলের দিকে, অগ্রগতির দিকে, প্রগতির দিকে অগ্রসর হতে তখন আমার কাজ হবে একে ত্বরান্বিত করা।
[আল মাহমুদ: সাক্ষাৎকার, ঢাকা: ২০০৩]
সূচনাকাল থেকেই কবি আল মাহমুদ দেশজ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল সম্পর্কে ছিলেন সচেতন। অন্যায়ের প্রতিবাদে ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ব্যাপারে ছিলেন অগ্রগামী দ্রোহী লেখক। সেইসাথে ঐতিহাসিক ও বিশ্বাসগত আবেগ কাজ করেছে।
সকালে সংবাদপত্র, রাজনীতি, ক্ষুব্ধ খোঁচাখুঁচি
যা কিনা রক্তাক্ত শার্টের মতো পরে আছে আমাদের ভয়ার্ত শতকÑ
এসবের ঊর্ধ্বে আজ বিনাবাক্যব্যয়ে
কী করে থাকেন?
জানি না, দেশের খবর কিছু পান কিনা,
কী ঘটবে এশিয়ায়Ñএ নিয়ে তর্ক করে আপনার যাওয়ার পর
পৃথিবীর সবকটি শাদা কবুতর
ইহুদি মেয়েরা রেঁধে পাঠিয়েছে মার্কিন জাহাজে।
[‘আত্মীয়ের মুখ’, সোনালি কাবিন]
অনিষ্টকর অন্ধকারে যখন পৃথিবী
আচ্ছন্ন হয়ে যায়। চারদিকে ডাইনীদের
ফুৎকারের মতো হাওয়ার ফিসফাস,
আর পাখিরা গুপ্ত সাপের আতঙ্কে
আশ্রয় ছেড়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দেয়
ঠিক তখুনি, ইহুদিরা হেসে ওঠে।
... ... ...
ইহুদিরা হাসুক,
তবু সম্পদের সুষম বণ্টন অনিবার্য।
ইহুদীরা নাচুক, তবু
ধনতন্ত্রের পতন আসন্ন। আর
মানুষ মানুষের ভাই।
[‘ইহুদিরা’, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না]
কবি এখানে ধনতন্ত্রের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদকে এক কাতারে নিয়ে আসেন। ধনতন্ত্রের ফলেই যে সাম্রাজ্যবাদ (ওসঢ়বৎরধষরংস) সম্প্রসারিত ও আগ্রাসী থাবা বিস্তারে সক্রিয় তার যেমন ইঙ্গিত দিয়েছেন, তেমনি এর পতনও অবশ্যম্ভাবী ও আসন্ন সেটাও বলেছেন। ফিলিস্তিন সম্পর্কে এডওয়ার্ড সাঈদের ভাষ্য হচ্ছে, ‘এ একক অদ্ভুত ধরনের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা’ (চবপঁষরধৎ ভৎড়স ড়ভ যরংঃড়ৎরপধষ বীঢ়বৎরবহপব)। কেননা, ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সত্য ছিলো ফিলিস্তিন বলে কিছু নেই। তাকে মুছে ফেলা হয়েছে; কিন্তু জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের মাঝে ফিলিস্তিন ছিলো স্মৃতি, ধারণা এবং রাজনৈতিক ও মানবিক অভিজ্ঞতা হয়ে। যার বিনাশ অসম্ভব; সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের লড়াই এই কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাম্রাজ্যবাদ ফিলিস্তিনের মানচিত্র মুছে ফেলতে এবং তাদেরকে জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছে; কিন্তু অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সংগ্রামের পথে তারা এগিয়ে চলেছে, যার নেতৃত্বে ইয়াসির আরাফাতের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। কবি তার আহ্বানে উজ্জীবিত হয়েছেন।
আর বক্তৃতা করতে উঠে দাঁড়িয়েই বললো, এই পার্বত্য উপত্যকার
প্রতিটি পাহাড়চূড়ো ও পবিত্র স্তম্ভগুলোর শপথ, শপথ
পবিত্র কাবা তাওয়াফকারী এখানে উপস্থিত প্রতিটি
নর-নারীর। যদি দলবদ্ধভাবে একবার, শুধু একবার। এমনকি
নিরস্ত্রভাবেও একবার। যদি
আমার দেশ প্যালেস্টাইন। শত্রু অধিকৃত একটা শহর। আপনাদের
প্রথম কেবলা। একবার যদি ভাইগণ।
আল কুদ্সের দিকে মুখ ফেরান, একবার।
হাতে হাত। এহরামের শ্বেতবস্ত্র সেলাইবিহীন। একবার। শুধু
হাঁটতে হাঁটতেও চলে যান। তবে
সামনেই জেরুসালেম, আমার প্রিয়নগরী,
বিজয়।
[‘মীনার প্রান্তরে ইয়াসির আরাফাত’, একচক্ষু হরিণ]
কবি এই মহান নেতার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। হারানো জন্মভূমি ফিরে পাবার লড়াইয়ে দীর্ঘকালব্যাপী সংগ্রামরত একটি জাতির মানসচেতনার সঙ্গে কবি অঙ্গীভূত; তাদের নেতার কণ্ঠস্বর আর কবির কবিতা একাকার হয়ে মিশে গেছে। ইয়াসির আরাফাতের উদাত্ত আহ্বান এবং বিজয়ের ব্যাপারে অকুণ্ঠ আশাবাদে কবি উজ্জীবিত। কারণ কবিও স্বদেশের মুক্তি সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন; অধিকৃত জন্মভূমি হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে দীপ্ত ভূমিকা রাখেন। এজন্যে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের মুক্তি-সংগ্রামের সঙ্গে কবি একাত্ম হয়ে যান।
কবি এইভাবে দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রতিবাদী হয়েছেন। ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক গতিধারায় সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে কবি তাকে অনিবার্য করে তুলেছেন। এক্ষেত্রে বিচিত্র ও বলিষ্ঠ প্রতীক-চিত্রকল্প-উপমার সাহায্যে কবি পাঠককেও উজ্জীবিত করেন।
আল মাহমুদ কাব্যকৃতিতে রাজনৈতিক চেতনাকে প্রবাহিত করেন মানবতাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে। এই মানবতা এসেছে তাঁর সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বোধ থেকে। কৈশোরে ও যৌবনে সাম্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং মধ্য বয়সে ইসলামের সাম্য ও মানবতাবাদের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা থেকে তিনি মঙ্গলচেতনায় সন্দীপিত হন। ফলে তাঁর রাজনৈতিক চেতনার কেন্দ্রে মানুষের জন্যে কল্যাণব্রতের শিল্পিত অভিব্যক্তি স্পষ্ট।