উত্থান

মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন
জিপটা গ্রামের রাস্তা দিয়ে ঘন-ঘন আসে আর যায়। দ্রুত গতির কারণে কাঁচা রাস্তায় ধুলো ওড়ে ধোঁয়ার মতো। সে ধুলোয় এক দল পোলাপান গাড়ির পিছু পিছু দৌড়ায়। ধুলোবালির জন্যে রাস্তায় চলা মুশকিল। পথচারী নাকে-মুখে কাপড় গুঁজে দেয়। কেউ কেউ নাক-মুখ মাস্ক দিয়ে ঢাকে; যদিও দেশ এখন করোনামুক্ত। গাড়ির নম্বর-প্লেটখানা ঝাপসা হওয়ায় শুধু ‘লট-নং’ কথাটার পাঠ উদ্ধার করা যায়। লট-নং দেখে বোঝা যায় নিলামে-কেনা গাড়ি। আজকাল গাড়িটার আনাগোনা বেশ বেড়েছে। মাঝে মাঝে গাড়িতে গ্রামের পরিচিত লোকজনকে লিফ্ট দিতেও দেখা যায়। এতে তারা খুব খুশি। আর খুশি হবেই-না কেন? গ্রামের গরিব লোক, মামুলি পোশাক, সস্তা দামের বিড়ি-সিগারেট যাদের সম্বল, তাদেরকে যদি দয়া করে গাড়িতে চড়ানো হয় বা আপন গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া হয়Ñ তাহলে তারা তো খুশি হবেই। তাই তারা এ-গাড়ির মালিকের নাম দেয় আনচার আলীÑ যদিও তার আসল একটি নাম আছে।
গ্রামের নাম ইছাপুর। গ্রামের বয়োবৃদ্ধরা আনচার আলীর উত্থান সম্পর্কে ভালো জানেন। সে উত্থানের কিঞ্চিৎ ইতিহাসও আছে বটে। সেটা অনেক যুগ আগের কথা। আনচার আলীর বাবা এ গ্রামে বহিরাগত। তার পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিলো উপকূলীয় এলাকায় নদী-পয়স্তি চরাঞ্চলে। সমকালে তার বাবার নাকি বেশ নাম-ডাকও ছিলো। তিনি ভাড়ায় খাটতেন। তখন ছিলো জমিদারি প্রথার অন্তিম সময়। ‘মিয়া’ নামের এক শ্রেণির দাপুটে জমিদার তখন সমাজে বাস করতেন। সেরকম এক ‘মিয়া’র লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান ছিলেন আমাদের আনচার আলীর শ্রদ্ধাভাজন আব্বা। এক পর্যায়ে মিয়াদের জৌলুস কমে এলে আনচার আলীর বাবা হয়ে পড়েন বেকার। ছেলেপিলে নিয়ে বিরাট সংসার তার। বেকার অবস্থায় সংসার চলে না। তাই তিনি বেছে নেন ভিন্ন পথ। সমাজে তার মতো আরো কিছু বেকারকে সাথে নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন একটি গ্যাং। গ্যাং-এর অনেক কাজ। এ গ্যাং এলাকা চষে বেড়ায়। সবার ব্যবহার্য খাল ও নদী দখল, নতুন জেগে ওঠা চর দখল, নানা অজুহাতে চাঁদা আদায় ইত্যাদি আরো কাজ। তা ছাড়া এলাকার প্রবাসী বাড়িগুলোর প্রতি তাদের একটা ভিন্ন আকর্ষণও ছিলো। এ গ্যাং-এর দাপটে গ্রামে অনেকে হয়েছেন নিঃস্ব। টাকা-পয়সা, সহায়-সম্পদ কোনো কিছুরই নিরাপত্তা ছিলো না কথিত গ্যাং-এর কারণে। তাই এক পর্যায়ে গাঁয়ের লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে গ্যাং-এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। শুরু হয় সংঘবদ্ধ গাঁয়ের লোকের সাথে গ্যাং-এর লড়াই। শেষ পর্যন্ত গ্যাং হয় পরাজিত। গ্রামবাসী তাদের করে ভিটে-ছাড়া। আনচারের বাবাও তাদের একজন। তাই আনচার আলীর বাবা তল্পি গুটিয়ে সপরিবারে পালিয়ে আসেন উপকূল থেকে দূরে সরকারি রিজার্ভ পাহাড়ি অঞ্চলে। তখন থেকেই আনচাররা বসত গাড়ে ইছাপুর গ্রামে।
আনচার আলী সাত ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোটো। নিজের বিপথগামিতা বুঝে আনচারের পিতার সখ হয় ছোট ছেলেকে অন্তত কুরআনে-হাফেজ বানাবেন; কারণ সকলেই চায় নিজে ভালো হতে না-পারলেও তার উত্তরসূরি যেন ভালো হয়। সে উদ্দেশ্যে ছেলেকে ভর্তি করান স্থানীয় হাফেজখানায়। কিন্তু আনচারের বাবা ছেলের হাফেজ হওয়া দেখে যেতে পারেন নি। একদিন হঠাৎ দমবন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। এদিকে পড়ার চেয়ে নানা অপকর্ম করাই হয়ে উঠে আনচার আলীর নেশা। এক বছরের মধ্যে শৈশবের আনচার আলী হয়ে ওঠে হাফেজ-খানার ত্রাস। ওস্তাদ তাকে শাসন করতে গেলে তিনি নিজেই আক্রান্ত হন। ফলে আনচারের ওপর নেমে আসে ভয়ানক শাস্তি। শেষে তিষ্ঠাতে না-পেরে এক পর্যায়ে কয়েকজন সতীর্থ মিলে হাফেজখানা থেকে আনচার আলী পালিয়ে যায়। ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে হাফেজি-পড়ুয়া এই পলাতক কিশোরদের জীবন। সে কৈশোরেই আনচার আলী পাড়ি জমায় গ্রাম থেকে শহরে। আশ্রয় নেয় পূর্বপরিচিত এক লোকের সাথে বস্তিতে। শুরু হয় নতুন পথচলা।
শহরে এসে কিশোর আনচার হয়ে ওঠে আরো বেপরোয়া। এক পর্যায়ে তার ডাকসাইটে ভাব জনৈক রাজনৈতিক নেতার নজর কাড়ে। তিনি তাকে ভিড়িয়ে নেন তার দলে। দলে ভেড়ার পর তার নাম বদলে রাখা হয় বাবুল মিয়া। শহরে বাবুল মিয়া নামেই তাকে সবাই চেনে।
গাঁয়ের আনচার আলী ওরফে শহুরে বাবুল মিয়ার এখন অনেক কাজ। ফুটপাথের হকারদের থেকে চাঁদা তোলা, নির্মাণাধীন নতুন বিল্ডিং-মালিকদের কাছ থেকে নেতার জন্য বখরা আদায়সহ সকল কাজের কাজি আমাদের শহুরে বাবুল মিয়া। বোধহয় এত দিন পর বাবুল মিয়ার আসল কাজ জুটেছে। তার আদায়কৃত ‘মাল’ থেকে তার ‘বস’ তাকে টু-পার্সেন্ট দিয়ে দেয়। এভাবে সে ধীরে ধীরে বেশ মালদার হয়ে ওঠে। তার বয়স বাড়ার সাথে সাথে পদোন্নতিও হয় যথাসময়ে। আগে যেখানে নেতার জনসভায় সে স্টেজ সাজাতো, টুল-চেয়ার-বেঞ্চ ঠিক করতো; এখন সে আর এগুলো করে না; বরং তার অধীন টোকাইদের দিয়ে তা করায়। এমন সাফল্যের জন্য বস তাকে আরো কাছে টেনে নেন। দূর-দূরান্তের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বস তাকে একখানা ‘পালসার’ মোটর সাইকেল উপহার দেন।
উপহার পেয়ে বাবুল মিয়ার দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। মোটর সাইকেলের কালো ধোঁয়া ছেড়ে বিকট আওয়াজে বাবুল মিয়া শহরের অলিগলি চষে বেড়ায়। বসের কাছে নিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর ও লাভজনক সব তথ্য। এদিকে বসও বেশ প্রতাপশালী। বসের এলাকায় তার কথায় সবাই উঠ্বস্ করে।
একদিন বসের বাসার পাশেই ভীষণ গোলাগুলী হয়। এতে বস বেশ ভয় পেয়ে যান। সহসা ডাক পড়ে বাবুল মিয়ার। বস জানতে পারেন তার প্রতিপক্ষের ক্যাডাররাই এই গোলাগুলীর হোতা। অবস্থা বেগতিক দেখে বস বাবুল মিয়াকে ডেকে ‘অটোমেটিক গান’ হাতে দিয়ে বলে, ‘এর সদ্ব্যবহার’ করো। সেদিন থেকে বাবুল মিয়ার দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। “বাপ-কা ব্যাটা”র প্রমাণ রাখতে গিয়ে সেও গঠন করে এন্টিগ্যাং। দোর্দ- প্রতাপে চলতে থাকে বাবুল মিয়ার দৌরাত্ম্য। এলাকায় পান থেকে চুন খসলেই সে যথেচ্ছ ব্যবহার করে আগ্নেয়াস্ত্রের। ফলে তার বিরুদ্ধে খুন-জখমের আধা-ডজন মামলা জমা পড়ে থানায়; কিন্তু বরাবরই উপরের নির্দেশে সে মামলা থেকে খালাস পায়।
কিছুদিন আত্মগোপনে চলে যায়। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে বাবুল মিয়া আত্মগোপন থেকে কচ্ছপের মতো মুখ বের করে দিনের আলোয়। তবে এবার শহরে নয়; খোদ নিজ গ্রামে। খোলস পাল্টে সে সহসা জনদরদি হয়ে ওঠে। আশ্রয় নেয় স্থানীয় উপজেলা ক্যাডারের কাছে। আর নেতার সুবাদে গাড়ি হাঁকিয়ে দুহাতে টাকা ওড়ায় নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে।
নেতা আবার এমপি ইলেকশন করবেন। তাই তারও দরকার বাবুল মিয়ার মতো বিশ্বস্ত একজন লোকের। নেতার সুবাদে একদিন বাবুল মিয়া সরকারি রিজার্ভ বনভূমি নিজের দখলে নেয়। এক বছরের মধ্যে নিজস্ব বনায়ন, মৎস্যঘের ও ডেইরি ফার্মে মুখর হয় বনাঞ্চল। গ্রামের লোকেরা তখন তাকে ‘বনের রাজা’ বলে সমীহ করে চলে। বাবুল মিয়ার এবার চোখ পড়ে গ্রামের একমাত্র ক্ষীণধারা খালের ওপর। সে সিন্ডিকেট করে খালের বালুমহাল দখল করে নেয়। ফলে বাবুল মিয়া রাতারাতি পরিণত হয় ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’। বাবুল মিয়ার অবস্থা এখন খুবই বাড়-বাড়ন্ত।
বাবুল মিয়া ওরফে আনচার আলী কোনো উপলক্ষ ছাড়াই মাঝে-মধ্যে ঘটা করে মেজবানির আয়োজন করে। মেজবানির দাওয়াতে তল্লাটের ধনী-গরিব, অভিজাত, নীচুজাত কেউই বাদ যায় না। এজন্য তার নাম-ডাক সংশ্লিষ্ট এলাকা ছাড়িয়ে বহুদূর ছড়িয়ে পড়ে। গরিবের জন্য তার জান কুরবান।
বালুমহাল থেকে শুরু করে মৎস্যঘের, ডেইরি ফার্ম ও বিশাল বনভূমির মালিক আনচার আলী। এজন্যেই তিনি এত দিলদরিয়া। খালি হাতে কেউ আনচার আলীর দেউড়ি থেকে ফিরেছে এমন নজির নেই। গরিব-মিসকিন তো বটেই; সমাজের অনেক অভিজাত লোকও আনচার আলী থেকে মূল্যবান উপঢৌকন না নিয়ে ফিরেছেন বলে জানা নেই। যার যার যোগ্যমতো উপঢৌকন সবাই পেয়েছে। তাই গ্রামে আনচার আলীর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। পরবর্তী সময়ে চেয়ারম্যান ইলেকশন করবেন তিনি।