শুক্রবার ০১ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

বর্ষার স্মৃতিকথা

মিনহাজ উদ্দীন শরীফ

আষাঢ় মাস এলেই মনে পড়ে যায়। সেই শৈশবের কথা। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই ছুটে যেতাম কালভৈরবের বটতলায়। সেখানে বন্ধুরা মিলে ডাং-ডাং খেলা খেলতাম। আর বানরের মতো গাছের ডালে ডালে লাফালাফি করতাম। আহা! আমাদের একটা সংগঠন ছিলো "ক্ষুদ্র উদীয়মান ক্লাব"। সেই সংগঠনের  প্রেসিডেন্ট ছিলাম আমি। কারণ আমি সবার বড় ও একটু ঝগড়াটে ছিলাম বটে। আমাদের আড্ডা দেওয়ার সময় যদি বৃষ্টি হতো তাহলে তো আর কথাই নেই। চানাচুর আর মুড়ির পার্টি জমে উঠতো সংগঠনের বাজেট থেকে। চানাচুর মুড়ি খাওয়া শেষ করেই হাতে বটি নিয়ে চলে যেতাম অপূর্ব স্যারের বাড়িতে। সেখানে বিশাল বড় একটা কলাবাগান ছিল। আমরা সেখান  থেকে মোট সাতটা কলাগাছ মোটা দেখে কেটে ধরাধরি করে নিয়ে আসতাম। এইগুলো চবলা নদীর ঘাটে নিয়ে বাকল ছাড়িয়ে সুন্দর করে বড়সড় করে ভেলা বানাতাম। আমাদের দলের মধ্যে কাজে দক্ষ ও একরোখা ছিলো জয় আর মিলহান; মুন্না ও বিজয় ছিলো একটু চঞ্চল ও বুদ্ধিমান। আর আমি তো নেতা, তাই কোনো কাজ করতে হতো না। শুধু দেখিয়ে দিতাম। ভেলা বানানোর কাজে প্রায় শেষ হয়ে আসলে দাদুর রেখে যাওয়া বৈঠা'টা নিয়ে আইতে হাফিজকে বলতাম। সে আমার কথা মতো বৈঠাটা নদীর ঘাটে নিয়ে যেতো। কারণ সে ছিলো আমার পরম প্রিয় আদরের স্নেহের অনুজ। আমার কথা খুব শুনতো তাই মাঝেমধ্যে আমি অন্যদের থেকে হাফিজকেই বেশি কাজ দিতাম। যদিও হাফিজ আমার সহোদর ছিল। তারপরও আমরা বন্ধুর মতো করে চলাফেরা করতাম। কলাগাছের  ভেলা শক্ত ও মজবুত করে বানানো হয়ে গেলে সবাই মিলেমিশে ব্রিজের তলদেশ দিয়ে কালনী নদীর বুকে যেতাম। হাওর বাঁওড় ঘুরে ঘুরে শাপলা-শালুক নিয়ে আসতাম। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মালা বানিয়ে গলায় দিতাম। বাচ্চারা খুব খুশি হতো এবং প্রতিদিন সকাল হলেই আমাদের কাছে যেতো। গল্প কিংবা আমাদের দুষ্টু মধুর ঝগড়া দেখার জন্য। দুপুর বেলার তপ্ত রোদে কাঁদা-জলে ফুটবল নিয়ে আমরা ছুটাছুটি করে আনন্দে মেতে উঠতাম। পুকুরের জলে সাঁতরে এপার হতে ওপারে যেতাম। আহা! ঐইসব দৃশ্য আজও চোখে ভেসে ওঠে। গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষ আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলো। প্রতিদিন কম হলেও বাবার কাছে দশ'টার মতো নালিশ যেতো। সন্ধ্যা হলেই  বই-খাতা আলমারিতে লুকিয়ে ছুটে যেতাম বন্ধুদের আড্ডার মহলে। আম, জাম, জামরুল কার গাছ থেকে পাড়া যায় সেইসব পরিকল্পনার জন্য। একরাতে একটু দেড়ি করে বাসায় ফিরেছিলাম। তখন খেয়াল করিনি বাবা যে বারান্দায় বসে আছে। চুরি করা আম, জামরুল, লিচু ভর্তি ব্যাগটা নিয়ে ঘরে ঢুকে যাই। বাবা চুপিসারে আমার পিছু পিছু গিয়ে দেখে আমি এসব কোথায় লুকিয়ে রাখি! আমি তাড়াহুড়ো করে আমার রুমের চৌকির নিচেই রেখে দেই। দরজায় লাগাতে যেই না চৌকাঠে চোখ রাখি তখনই দেখি বাবা হাজির! তখন  আমি ভয়ে মাথা নিচু করে বিড়াল হয়ে গেছিলাম। বাবা আমার হাতে শক্ত করে ধরে মায়ের কাছে নিয়ে যায়। আমাকে কিছু না বলে বাবা মাকে অনেক বকাবকি করেছিল। গায়ে হাতও তোলার চেষ্টা করেছিল। আমি সেদিন খুব কেঁদেছিলাম বাবা মাকে আমার জন্য বকাবকি করছিল বলে। কয়েকদিন বাবা আমার সাথে কোনো কথাবার্তা বলেনি। এক সাপ্তাহ পরে বাবা আমাকে কিছু না বলে ডাইরেক্ট ঢাকা নিয়ে আসে। সেখানে নামকরা স্কুল এন্ড কলেজে ভর্তি করে হোস্টেলে রেখে বাবা চলে আসে গ্রামের বাড়িতে। সেই থেকে আর যাওয়া হয় না আষাঢ় মাসের স্মৃতিমাখা গাঁয়ে। চোখ মেলে দেখা হয় না নদীগুলো, সাগরের মতো রূপ ধারণ করে কলকল তালে জোয়ার তোলার দৃশ্য'। চড়া হয় না আর নিজেদের তৈরি কলাগাছের ভেলায়। জীবন থেকে হারিয়ে গেছে শৈশবের ঐসব দস্যি সাথীরা। মনে করতে পারি না এখন আর মেঘমালার মায়া জড়ানো নিদারুণ মুখের হাসি। দেখা হয় না গোয়াল ঘরের সেই লাল গাভীর রুগ্ন বাছুর'টা। রাস্তার মোড়ের দোকানী জসিম মিয়ার সাথে আর হয় না মন খুলে কথা। চোখে ভাসে না আর বর্ষার কদম কেয়ার মন জুড়ানো হাতছানি। শালিকের পিছু পিছু গভীর বনেও আর যাওয়া হয়না। বাদল দিনে কাদাজলে আর ফুটবল খেলাও খেলতে পারি না। জেলেদের মুখে খোকা ডাক'টা ও আর বাতাসে ভেসে আসে না। ব্যস্ত শহরে এসে প্রায় ভুলতে বসেছি আমার সেই শৈশবের মধুর স্মৃতি।

 

 

 

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ