একটি ছাতার গল্প

কবির সুমন
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। গুঁজে থাকা শার্ট ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমি। শার্টের কলারটা ঠিক ঠাক আছে। মেয়েরা পরিপাটি ছেলে পছন্দ করে শুনেছি। হরেক রকম চেন সাথে কলার উঁচিয়ে টি-শার্ট পরা ছেলেদের তারা ডাকে ফালতু। তবে- ব্রেসলেট পরি ছোট বেলা থেকেই, এটা নতুন নয় পুরোনো শখ আমার। কতো মেলা, কতো দোকান থেকে যে, কিনেছি তার ইয়াত্তা নেই।
ইউনিভার্সিটি গেটের দিকে তাকিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়ালাম। বুকের হার্ট বিট ক্রমশই বাড়ছে। ঈদের লম্বা ছুটির পর দেখা হবে ভাবতে অন্যরকম লাগছে। অন্য দিনের তুলনায় আজ তার ক্লাস আগে শেষ হওয়ার কথা। বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি। তিরিশ মিনিট পার হয়েছে কবে, আসছে না কেনো?? এসব ভাবনার মধ্যে হঠাৎ “মেঘ না চাইতে বৃষ্টি “চলে এলো সে!
কেনো যেনো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ভয় হয়। এই ভয় জড়তা আমার আগের অভ্যাস; ভয়ের জন্য নামটি ও জানা হয়নি। রাগী রাগী ভাব আছে তার চেহারায়। হঠাৎ যদি সামনে এসে প্রশ্ন করে
“ এই যে মিস্টার, মতলব টা কি আপনার? প্রতিদিন দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখেন?”
এমন কোনও প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। আজ আকাশে মেঘ জমেছে খুব। খানিক পর বৃষ্টি নামবে। বিদ্যুৎ চমকাতেই আকাশের দিকে তাকালাম। খানিক আগের রৌদ্রজ্জ্বল আকাশটি কালো মেঘে ঢেকে গেছে। ভাগ্যিস আসার সময় ছাতা নিয়ে বের হয়েছিলাম। প্রকৃতির ওপর ভরসা করা যায় না। ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়।
বৃষ্টি নামতেই ছাতা খুললাম। আশে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো ছুটছে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। হাতে ছাতা থাকার পরেও আমি দাঁড়িয়ে ভিজছি। ছাতার কয়েক জায়গায় ফুটো হয়ে আছে, ফুটোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস, ইঁদুরগুলো বড্ড বেশি জ্বালাচ্ছে। আর ইঁদুরের কাজ তো কাটাকুটি..
ঘাড় ফিরে তাকাতেই হার্টবিটের মাত্রা জানান দিল মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে গজ দুয়েক দূরে। ছাতা আনা হয়নি তার, হাতে থাকা ভ্যানেটি ব্যাগই ভরসা। বৃষ্টির জলেতে চুলগুলো লেপ্টে আছে গালে, মেয়েটি দেখতে আহামরি সুন্দরী না, শ্যাম কালো বর্ণের, চোখগুলো ডাগর ডাগর, লম্বাটে চেহারা। শিল্পীর তুলির চোখে দেখলে নিখুঁত। তবে সব কিছু মিলিয়ে একটা আছে, যে মায়ার টানে ছুটে আসি।
নিজের ওপর রাগ উঠছে খুব। ছাতা ফুটো করার আর সময় পেল না, ফুটো ছাতা হাতে নিয়ে মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়ালে নিশ্চিত হেসে ফেলবে। একবার ভাবলাম ছাতা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজি, সাহস হচ্ছে না, তা দেখেও যদি হেসে ফেলে?
- আপনি তো দেখছি ভালো অভদ্র ।
মিষ্টি একটি কণ্ঠ কানে আসতেই তাকালাম, মেয়েটি আমার পাশেই দাঁড়িয়ে।
আমি হাবার মতো তাকিয়ে আছি মেয়েটির দিকে। মেয়েটি উত্তর না দিয়েই ছাতার ভেতর ঢকলো, আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে আছি। এমনটি হতে পারে জানা ছিল না।
- আপনি তো ভালোই অভদ্র, দেখে তো বোঝা যায় না।
- বুঝলাম না,
- ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন, মেয়েটি বৃষ্টিতে ভিজছে। সৌজন্যতা বোধ দেখানো যেতো না?
কিছু না বলে নিচে তাকিয়ে আছি আমি। ছাতার ওপরে ফুটোগুলোর দিকে চোখ গেলে নিজেকে বোকা মনে হয়। ভদ্রতা না দেখানোর পেছনে কারণটা তাকে বলি কিভাবে?
বৃষ্টি মাত্রা কমেছে অনেকটা। এখন আর পড়ছে না, তবে মেঘ জমছে আকাশে। আমি হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটি মিটিমিটি হাসছে।
- একটা রিক্সা ডেকে দেওয়ার ভদ্রতাটুকু ও শিখিয়ে দিতে হবে? মুচকি হেসে বলল মেয়েটি।
আমি ছাতা হাতে ধরিয়ে হাঁটা ধরলাম। রিক্সা একটা পেলে হয়, হার্টবিট যে হারে লাফাচ্ছে যে কোনো সময়ে ফেল করতে পারে।
মেয়েটি রিক্সায় উঠে বসলো। আমি ফুটো ছাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
- ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকবেন?
হাবার মতো মাথা এপাশ ওপাশ দোলালাম। মেয়েটির মুখে সেই মুচকি হাসি।
- ফুটো ছাতা হাতে নিয়ে ঘুরে লাভ নেই, বৃষ্টি নামবে আবার। রিক্সায় উঠুন।
লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার অবস্থা।
- কোথায় উঠুন
দ্বিতীয় বার তাগাদা পেয়ে রিক্সায় উঠে বসলাম। মেয়েটি এখনও হাসছে। আমি চুপ চাপ বসে আছি, কোনও ভাবে যদি নামতে পারি, এই মেয়েটার সামনে আর আসছি না।
- গত সাত দিন কোথায় ছিলেন?
আমার অবাক হওয়ার কথা কিনা জানি না, তবে অবাক হয়েছি খুব। সাত দিন আসা হয়নি, সে লক্ষ্য করেছে??
- অসুস্থ ছিলাম
- কি হয়েছিল?
ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো সে,
আমি মাথা নিচু করে আছি। অসুস্থতার কারণ বলা যাবে না, কারণে শুনলে এবার হয়তো খিল খিল করে হাসবে।
- বললেন না?
- এমনি অসুস্থ ছিলাম।
মেয়েটিকে আবার হাসতে দেখে রাগ হচ্ছে। এইভাবে কেউ কথায় কথায় হাস্তে?
- হাসার মতো কিছু ঘটেছে?
- না
- তাহলে হাসছেন কেনো?
- প্রতিদিন হাবলার মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে কি করেন? দিনের বেলায় তারা গুনেন নাকি?
এই হইছে! যেটা মনে মনে ভেবে ভয়ে ছিলাম সেটাই হলো, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সাহস নেই।
- চুপি চুপি দেখা, পিছু পিছু হাঁটা আমার পছন্দ না।
- তাহলে কি পাশে এসে হাঁটবো?
- বলেছি?
- না
- পাশে হাঁটতে হলে অনুমতি নিতে হয়।
- সাহসের অভাব
- প্রেমে পড়ার আগে ভাবা উচিত ছিল।
উত্তর দেওয়ার ভাষা নেই। কিছু একটা বলা যায়, কি বলবো ভাবছি। বলার আগেই রিক্সাওয়ালা বললো
- স্যার নামুন
- নামবো কেনো?
অবাক হয়ে বললাম আমি,
- কারণ আপনার গন্তব্য চলে এসেছে।
হেসে বলল মেয়েটি।
নিজেই গালে চড় বসাতে ইচ্ছে হচ্ছে। দ্রুত নামার জন্য ভুল ঠিকানা বলেছি, একটু দূরে বললে কি হতো!
- নামটা জানা হয়নি।
— আমি হিমি, আপনি?
— হীমু
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রিক্সা থেকে নামলাম। ভ্যানিটি ব্যাগে গুঁজে রাখা মেয়েটির ছাতা বের করে বললো
- এই ছাতায় ফুটো নেই।
- আমার ছাতা?
- ফুটো ছাতায় বৃষ্টি পড়ে, ভিজে থাকলে জ্বর বাঁধাবেন।
- জ্বরে আমার অসুবিধা নেই।
- আমার আছে
- কেনো, কেনো?
- সাত দিনের সময়টা অনেক দীর্ঘ,
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। রিক্সার হুড তোলার আগে হিমির মিষ্টি হাসি ভাসছে চোখে। চলে যাওয়া রিক্সার দিকে তাকিয়ে আছি আমি। বিদ্যুৎ চমকাতেই আকাশের দিকে তাকালাম। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। হাতে থাকা ছাতাটা খুললাম। বৃষ্টি তে ভেজা যাবে না, সাত দিনের জ্বর বাঁধালে হিমি হয়তো রাগী রাগী চেহারা নিয়ে বলবে
“বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধালেন কেনো? এই নিন আপনার ফুটো ছাতা। খবরদার আমার পাশে হাঁটবেন না।”