শনিবার ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

কবিতা ও আধুনিক কবিতা

আবদুল হালীম খাঁ

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা। দীর্ঘকাল সংগ্রাম করে রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষাকে আমরা রাষ্ট্র ভাষাতে মর্যাদায় উন্নীত করেছি। এ সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এটা আমাদের গর্বের বিষয় যেমন, তেমনি বাংলা সাহিত্য চর্চায় আমাদের 

অনুপ্রাণিত করে।

সাহিত্য একটি জাতীয় দর্পণ। তেমনি বাংলা সাহিত্যে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি জীবনাদর্শ অঙ্কিত হোক এটাই আমরা চাই। আমাদের স্বকীয় পরিচয় নির্ধারণে, আত্মমর্যাদাবোধ উজ্জীবনে জীবনের মহত্তম প্রেরণা সৃষ্টিতে এ জাতীয় লক্ষ্য পরিপূরণে আমাদের কবি সাহিত্যিকগণ এদিকে এগিয়ে আসবেন এটাই আমাদের আশা।

এ উদ্দেশে বাংলা কাব্যকে আমরা কেমন দেখতে চাই, কি রূপ পেতে চাই, কেমন হওয়া চাই এটা আমাদের মনের একান্ত আশা। বাংলা কাব্য কেমন হলে বিশ্ব সভায় আমাদের মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পাবেÑ এটা আমাদের চিন্তার বিষয়। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মধ্যে মানব মনে কবিতার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। একটি ছোট্ট কবিতা বা ছড়া দিয়েশলাইর কাঠির মতো। বারুদভরা। যে কোনো একটি বিষয়কে ছন্দবদ্ধভাবে প্রকাশ করলে ছন্দের দোলা ও ঝংকার শিক্ষিত অশিক্ষিত ছোট বড় সকল শ্রেণির মানুষের হৃদয় দারুণভাবে দ্রুত স্পর্শ করে। গদ্য রচনায় তা সম্ভব হয় না। আর ছন্দবদ্ধ বাণী মুখস্থ হয় খুব সহজে। সত্যি বলতে কি ছন্দসুরে রয়েছে আশ্চর্য রকম মোহ ও যাদুশক্তি। এ কারণে সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগের মধ্যে কবিতার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।

কবিতার জন্ম ছন্দবদ্ধভাবে। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদগুলো সবই ছন্দবদ্ধভাবে রচিত। ছন্দ ও সুর শুধু মানুষের মনে নয় পশুপাখির মনকে মুগ্ধ করে। চর্যাপদের মূল বিষয় মানব হৃদয়ের চিরন্তন আকুলতা, প্রেম, ধর্মভাব, দুঃখ-কষ্ট, বিরহ-বেদনা ছন্দবদ্ধভাবে এমন সুন্দর হৃদয়স্পর্শী ভাষায় ব্যক্ত করেছেন হাজার বছর পরও আমাদেরকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করছে। পাঠ করলে মনে হয় হাজার হাজার বছর আগে কবিগণ আমাদের মনের গোপন কথাগুলো বলে গিয়েছেন। সে কথাগুলো গদ্যে রচনা করলে আমাদের হৃদয় স্পর্শী করতো না।

এ জন্য আমাদের কবিতা নিয়ে ভাবার বিষয় রয়েছে। আমাদের কবিতায় যেন আমাদের জীবনের আশা-আকাক্সক্ষা উদ্দেশ্য এবং জাতীয় আদর্শ-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়। কবিতা যেন মহত্বের দিকনির্দেশনা হয়। কবিতা যেন হয় প্রাণ সঞ্চার আবে হায়াত। কবিতা যেন হয় অন্যায় অনাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী। কবিতা যেন না হয় শুধু মনের খেয়াল-খুশির তাড়না ও অপ্রয়োজনীয় আবর্জনা। কবিতা যেন পাঠকদের অন্ধকারের দিকে না টেনে নিয়ে আলোর দিকে টেনে নেয়। কবিতা যেন না হয় পান্তাভাতের মতো পানসে তৃপ্তিহীন। কবিতা অবশ্যই হতে হবে প্রিয়জনের চিঠির মতো আকর্ষণীয়।

বর্তমানে বিশ্বে যেমন অস্ত্রের যুদ্ধ চলছে। তার চেয়ে বেশি জোরে চলছে আদর্শের যুদ্ধ। মতাদর্শের যুদ্ধ। এক মতাদর্শের উপর আরেক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। অস্ত্রের যুদ্ধটা মূলত মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জয়ী হবে কারা? যারা সচেতন এবং শক্তিশালী। বিশ্ব আবাদ করবে তারাই। আগমাী বিশ্ব হবে তাদের। আমরা বর্তমানে এক প্রান্তিক অবস্থায় অবস্থান করছি। পৃথিবীতে যত দ্বন্দ্ব সংঘাত চলছে যত রকম মতাদর্শের টানাটানি, শান্তি ও কল্যাণের জন্য যত মতাদর্শের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে তাতে একটি ভালো দিক ফুটে ওঠছে তা হলো এই, বিশ্বের মানুষ এখন আর মানুষের তৈরি মতাদর্শে সুখ-শান্তি পাচ্ছে না তা বুঝতে পারছে। যারা এখনো অন্ধ হয়ে যায়নি, যাদের চেতনা এখনো জাগ্রত রয়েছে, তারা দেখতে পাচ্ছে এবং বুঝতে পাচ্ছে, সবার উপরে একটি আদর্শ আজো জ্বলজ্বল করছে। সেই উজ্জ্বল আদর্শের দিকে সবার দৃষ্টি। আর সেটি হলো ইসলামী জীবনাদর্শ। বর্তমান বিশ্বের দিকে দিকে এত সংগ্রাম চলছে তা একদিকে মানব রচিত জীবনাদর্শ অন্যদিকে ইসলামী জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এ সংগ্রাম চলছে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে, কাব্য সাহিত্য-সংস্কৃতির মাধ্যমেও।

সংগ্রামের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো সাহিত্য-সংস্কৃতি। বাংলা কবিতা বিশ্বমানের সমৃদ্ধ কবিতা। বাংলা কবিতার রয়েছে স্বীকৃতি। এ কবিতার অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি কবিদের হাতে। কিন্তু সকল কবিদের বোধ বিশ্বাসও রুচি এক রকম নয়। পাঠকগণও এক রকম নন। কেউ ডানে, কেউ বামে। এ জন্য কাব্য বিচারের একটি মানদণ্ড অবশ্যই আমরা চাই। আর সেটি হওয়া চাই ইসলামী আদর্শের মানদণ্ডে । 

বর্তমান বিশ্বে আমরা কি দেখছি হাওয়া পাল্টে গেছে। চারদিকে জাগরণ শুরু হয়ে গেছে। দেশে দেশে মুক্তির আন্দোলন চলছে। কেউ বসে নেই। কেউ নীরব নেই। কবিদের কবিতাই এ আন্দোলন শুরু করেছে নাকি জনতার আন্দোলনে কবিরা প্রভাবিত হচ্ছেন?

কবিতা সবচেয়ে সচেতন ও জাগ্রত। তাদের হৃদয় বীনায় আগে আগে বেজে ওঠে যে, জাগরণের সুর তাই ছড়িয়ে জনমনে ও আকাশে-বাতাসে বর্তমান বিশে^ দেশে দেশে যেসব মুক্তির আন্দোলন চলছে তা সবই ইসলামী আদর্শ চেতনায়। ফিলিস্তিনকে অভিশপ্ত ইহুদিদের হাত থেকে মুক্ত করার মুসলিম নরনারীরা জীবনবাজী রেখে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। কাশ্মীরে মুসলিম মুজাহিদরা চালিয়ে যাচ্ছেন আন্দোলন। আরো কত দেশে চলছে এ আদর্শের আন্দোলন। পুঁজিবাদী ও সমাজবাদীদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইরানীরা ইসলামী বিপ্লবকে সফল করেছেন। অস্ত্রশক্তি ও দমন-পীড়ন তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। কবিদের কলমে কালো কালির বদলে লাল কালি ঝরছে। বিশ্বের সচেতন কবিদের শিরায় শিরায় তপ্ত রক্ত টগবগ করছে। তাই তো কবিরা লিখছেন : ‘আমার এখন ইচ্ছে করে যুদ্ধ যেতে,

যুদ্ধবাজ জালিমদের অস্ত্র খেতে।’

বাংলা কবিতা প্রথম চর্যাপদ যে ছন্দের নূপুর বাজিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, দীর্ঘকাল ও পরিবেশে কবিতার ভাষা ও শরীরের নানারূপ পরিবর্তনে বর্তমান রূপে এসে পৌঁছেছে। আমাদের সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে কবিতার ভাষা, উপমা, অলঙ্কার প্রকাশভঙ্গি। বাংলা কবিতা বর্তমানে বিশে^র সকলের কাছে আদৃত ও প্রশংসিত।

কিন্তু দুঃখের বিষয় মানুষের যেমন শত্রু রয়েছে, বাংলা ভাষার কবিতারও কিছু শত্রু রয়েছে। তারা বাংলা ভাষার কবিতার অগ্রগতি, উন্নতি ও মর্যাদাকে বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। কবিতাকে তারা এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, কবিতা যেন আর পাঠকরা না পাঠ করেন। তারা কবিতা নামে কষ্ট করে কষ্টা গদ্য লাইন ছোট বড় করে লিখছেন। আবার কেউ যা লিখছেন তা সম্পূর্ণ অবোধ ছন্দ সুরের বালাই নেই। বাংলা কবিতায় এমন সব আবর্জনা যারা জমিয়ে যাচ্ছেন তাদের কেউ কেউ প্রশংসা করছেন।

তিরিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার মোড় ফেরার সময় যে কয়টি পত্রিকার প্রভাব ছিল, তাদের মধ্যে কল্লোল (১৯২৩), কালিকলম (১৯২৬), প্রগতি (১৯২৭) এবং ত্রৈমাসিক ‘কবিতা’র (১৯৩৫) নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। তখন কবি বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কবিতা রচনার ব্যাপারে কিছু নিয়ম জারি করেছিলেন। তা হলো: কাব্য ভাষার বাকরীতি উল্লেখ হবে। ভাষা হবে সুগম্ভীর সাংস্কৃতিক। তিনি কবিতা পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে ‘কবিতার দুর্বোধ্যতা’ প্রসঙ্গে আলোচনায় আধুনিক কবিতা সম্পর্কে পাঠক ও একশ্রেণির সমালোচকদের অভিযোগের উত্তরে লিখেছিলেন- পাঠকের বোধগম্যের উপর কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে এমন কথা বোধহয় শোনা যায়নি। ... কবিতা সম্পর্কে ‘বোঝা’ কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনে, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের কিছু বোঝায় না, স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে, তা বোঝা যাবে না, বোঝান যাবে না।’

ভালো কবিতা দিয়ে যদি কিছু বোঝানো না যায়, তাহলে মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমদ পর্যন্ত যত কবি যত কবিতা লিখেছেন বুদ্ধদেব বসুর কাব্য বিচারে তাদের কবিতা মোটেই কবিতা হয়নি এবং রবীন্দ্রনাথ কাব্যে নোবেল প্রাইজ যারা দিয়েছেন তাদের কাব্য বিচার সঠিক হয়নি। কবিতার উপর এমন অযথা কথা নিয়ে এ পর্যন্ত কেউ প্রতিবাদ করেননি। বরং অনেকে বুদ্ধদেব এর কথা মেনে নিয়ে অবোধ ও দুর্বোধ্য ভাষায় আধুনিক কবিতা লিখেছেন। ফলে এই একশ্রেণির সমাজ বহির্ভূত কষ্টা গদ্যের লেখক জনগণের প্রাণপ্রিয় কবিতাকে পাঠক সমাজ থেকে দূরে নিয়ে গেছেন। কবিতা স্বচ্ছন্দ গতিপথে তারা আবর্জনা হয়ে দাঁড়ায়।

কবিতা তাদের শিকারে পরিণত হয়। কবিতা হয়ে পড়ে অর্থহীন দুর্বোধ্য ধোঁয়াটে কালো কুৎসিত এবং পাঠকদের নাগালের বাইরে চলে যায়। পাঠকরা কবিতার উপর হয়ে পড়েন বীতশ্রদ্ধ। তারা কবিতার বইপত্র পাগলের প্রলাপ বলে দূরে ফেলে দেন এবং বলতে শুরু করেন, কী হবে অর্থহীন শব্দ উচ্চারণ করে। অনেক উচ্চ শিক্ষিত পাঠক আধুনিক কবিতার হেঁয়ালিপনা ও কুৎসিত চেহারা দেখে ঘৃণা ও ক্রোধ প্রকাশ করেন। পত্রপত্রিকায় আলোচনা সমালোচনা হতে থাকেÑ ‘আধুনিক কবিতা বুঝি না, আধুনিক কবিতার নামে যা লেখা হচ্ছে তা আসলে কবিতা নয়, এসব বাজে কুৎসিত লেখা দিয়ে কী হবে আমাদের, কী হবে প্রয়োজন জাতীয় জীবনে?’

দুর্বোধ্য ও অবোধ্য কবিতা যে আসলে কবিতা নয় বরং বিষপিল এটা শুধু বাংলাদেশী কবিতা পাঠকদের অভিমত নয়, পশ্চিমবঙ্গ এবং পশ্চিমা কাব্য সমালোচকদেরও অভিমত। উ.ঊ. ঝরঃবিষষ এবং কবহহবঃয ণড়ঁহম ই যে শুধু কেন তারা কবিতা পড়া ছেড়ে দিয়েছেন বা কী হবে কবিতা পড়ে- এসব কথার কৈফিয়ত দিবার কথার পাঠকের নাকে মুখে অত্যাধুনিক কবিতা অশ্বের পাছাপায়ের উল্লম্ফিত লাথির কথা বলতে গিয়ে সেগুলোকে উঁষষ ৎঁননরড়য নাম দিয়েছেন এবং বলছেন এসব এখন আর কেউ পড়ে না।

প্রমথনাথ বিশি বলেছেন, হাওয়া বদলে যাচ্ছে, পশ্চিমা কবিগণ এখন আর দুর্বোধ্য কবিতা লিখছেন না, তাদের দুর্বোধ্যতার মোহ কেটে গেছে।’

আধুনিক কবিতার জন্মদাতা কবি বোদলেয়ার বলেছেন : ‘কবিতা হবে এমন বস্তু যার সবটুকু হবে কাব্যময়। প্রতিটি পঙক্তি হীরার টুকরোর মতো জ্বলজ্বল করবে, আর প্রত্যেকটি কবিতা হবে এক একটি মনিহার।’ চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা বলেছেন : কবিতাকে হতে হবে রুটির মতো যাতে সবাই তার স্বাদ পায়Ñ শিক্ষিত অশিক্ষিত ও চাষা....কবিতা হবে অগণিত সদস্য বিশিষ্ট মানব পরিবারের জন্য।’ নেরুদার এই ধরনের মনোভাব শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা প্রভাবিত করেছিল তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর কবিদেরকেও। পাবলো নেরুদার উত্তরসূরী আধুনিক জার্মানীর বিশিষ্ট কবি এন্জেন জবার্গ আর একধাপ অগ্রসর হয়ে বলেছেন : কবিতা হবে বাসন পেয়ালা চামচের মতো নিত্য ব্যবহার্য ঢ়ড়বসং ভড়ৎ ঢ়বড়ঢ়ষব যিড় ফড়হ’ঃ ৎবধফ ঢ়ড়বসং. অকারণ সাজগোজ ও অনাবশ্যক অলংকারের বাহুল্য থাকবে না কবিতায়, থাকবে না ভাবের বিলাসিতা ও শব্দের অনর্থক বাকচাতুরী, কবিতা শুধু নীলিমা বিহারী না হয়ে সে থাকবে জনগণের নিত্যদিনের সাথী হয়ে তাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের সমস্যাবলীর বাস্তব প্রতিবিম্ব হয়ে।’

লক্ষ্যণীয়, পাশ্চাত্যের কাব্য মতবাদগুলো কবিতার এই সহজ সুন্দর সনাতনী ঐতিহ্যের সুস্থ ও নিটোল দেহে অহরহ তার গরল বিষ ঢেলে যাচ্ছে আর আমাদের কাব্য কর্মীরা অনায়াসেই তা গলাধঃকরণ করে বলছেন এবং কেউ কেউ করে যাচ্ছেন আত্মঘাতী ওকালতি। ফলে কবিতা হয়ে পড়েছে দুর্বোধ্য, অবোধ্য ও যৌনতা, অবক্ষয়, হতাশা এবং নৈরাজ্যের প্রতীক। কবিতার শরীরে পচন ধরেছে। রুচিশীল পাঠকগণ কবিতাকে ঘৃণা করছেন। কবিতার বইপত্র দেখে তারা দূরে ফেলে দিচ্ছেন। পাঠকদের এখন আধুনিক কবিতার সাথে সম্পর্ক নেই। এ সময়ে শুধু কবিতা নয়, জনজীবন ও সমাজের অবক্ষয় ও অস্থিরতার বাস্তব চিত্র অংকন করেছেন কবি ফররুখ আহমদ তার এক সনেটে।

স্বপ্নের অধ্যায় শেষ। দু’স্বপ্নের এ বন্দী শিবির

সাত কোটি মানুষের এ বধ্যভূমি। দেখ এ বাংলার

প্রতি গৃহে অপমৃত্যু ফেলে ছায়া তিক্ত হতাশার

দুর্ভিক্ষের বার্তা আসে, আসে নিরন্ধ্র রাত্রির।

বাষট্টি হাজার গ্রাম উৎকণ্ঠিত, নিভৃত পল্লীর

প্রতি পথে ওঠে আজ হাহাকার তীব্র বুভুক্ষার

চোখে ভাসে চারদিকে অন্ধকার- কালো অন্ধকার;

ক্ষুধা, মৃত্যু ভাগ্য আজ স্তিমিত এ প্রান্ত জাতির!

এ মুহূর্তে কী উজ্জ্বল রাজধানী! নতুন শহর

অত্যুগ্র যৌবন- মদে মত্তা যেন নটিনী চঞ্চল

কাটায় উল্লাসে তার জীবনের উদ্দাম প্রহর।

উপচিয়া পড়ে যায় পানপাত্র ফেনিল, উচ্ছল;

নির্লজ্জের রঙ্গমঞ্চে অকল্পিত বিলাসের ঘর,

দুচোখ-বাঁধানো রূপে, নগ্ন, মেকী ঐশ্বর্যে উজ্জ্বল।

কবিতার সঙ্গে দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি নির্ভরশীল। এক সময় কবি ও কবিতা মুসলিম স্পেনের অত্যন্ত সমাদরের বস্তু ছিল। রাজ দরবার থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকগণ পর্যন্ত যত্রতত্র কবিতা ব্যবহার করতেন। ঐতিহাসিক ওমর আব্বাস লিখেছেন : ‘সাহিত্য সম্বন্ধে এতোটুকু বললে যথেষ্ট হবে যে, কবিতা লোকের কথা ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সকল শ্রেণীর লোকই আরবীতে কবিতা রচনা করতো। উপস্থিত ক্ষেত্রে রচিত বা কোনো বিখ্যাত কবির কাব্য হতে কণ্ঠস্থ কবিতাংশ উদ্ধৃত করতে না পারলে কোনো বক্তৃতা বা অভিনন্দন পত্রই পূর্ণাঙ্গ বলে বিবেচিত হতো না। খলিফা হতে আরম্ভ করে কৃষক ও মাঝিমাল্লা পর্যন্ত সকলেই কবিতা রচনা করতো। আন্দালুসিয়ায় কবির সংখ্যা এতো অধিক ছিল যে, কেবল তাদের নাম লিখতে গেলেই একখানা বিরাট গ্রন্থের প্রয়োজন।’

বর্তমানে শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বে মানবতার দুর্ভিক্ষ চলছে। চলছে হিংসা, ঘৃণা, হানাহানি, ভেদাভেদ, যুদ্ধ, সন্ত্রাস, অনাচার অবিচার। মানুষের এ সকল পশু প্রবৃত্তি দূর করা সম্ভব একমাত্র কাব্য রস ঢেলে। কাব্যের মাধ্যমে মানুষের মানবতাবোধ জাগ্রত করা সম্ভব। কবিতার মধ্যে রয়েছে ধর্ম ও মহৎ আদর্শ চেতনার বাণী। অশান্ত পৃথিবীকে একমাত্র কবিরাই মানব প্রেমের বাণী শুনিয়ে শান্ত করতে পারেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ