মিলান কুন্ডেরা কেন এতো প্রাসঙ্গিক

আহমদ মতিউর রহমান
বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক মিলান কুন্ডেরা গত ১১ জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসে পরলোক গমন করেছেন। তিনি তার লেখায় গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। দেশে দেশে এখন চলছে গণতন্ত্রহীনতা, কর্তৃত্ববাদী শাসন। এই মুহূর্তে মিলান কুন্ডেরা যেন আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। তার লেখা পাঠকদের জন্য গবেষকদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক যে সময়টাতে, সেই সময়টায় তার এই প্রস্থান অবশ্যই দুঃখের। তবে তার বইগুলো তার উপস্থিতির জানান দেবে। তার বই চল্লিশটিরই বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি এখনো সমানভাবে পঠিত হবেন। তিনি তার দেশ চেক প্রজাতন্ত্রের কমিউনিস্ট শাসকদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন, যেমনটা হয়েছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সেরা লেখক আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিন। এ কারণে কুন্ডেরার দেশে থাকা সম্ভব হয় নি। তিনি পাড়ি জমান স্বাধীন দুনিয়ায়। ১৯৮১ সালে তিনি ফরাসি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। তৎকালীন চেকোশ্লোভাকিয়া সরকার ১৯৭৯ সালে তার চেক নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। ৪০ বছর পর ২০১৯ সালে তার চেক নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয়। ততদিনে অনেক পরিবর্তন এসেছে তার দেশে এবং গোটা বিশে^। চেকোশ্লোভাকিয়া ভেঙে দুটি দেশ হয়েছে চেক প্রজাতন্ত্র ও শ্লোভাকিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে হয়েছে পনেরটির মতো স্বাধীন দেশ, কমিউনিস্ট শাসনের অবসান হয়েছে। এটা ১৯৯০ সালের দিকের ঘটনা। চেক প্রজাতন্ত্রেও এসছে গণতন্ত্র। তারই ফল হিসেবে মিলান কুন্ডেরা ফিরে পান তার দেশের নাগরিকত্ব। কুন্ডেরার সবচেয়ে পরিচিত কাজ হল দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং। ১৯৮৯ সালের ভেলভেট বিপ্লবের আগে চেকোস্লোভাকিয়ার ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি তার বইগুলো নিষিদ্ধ করেছিল। তিনি একটি লো-প্রোফাইল জীবন যাপন করতেন এবং খুব কমই মিডিয়ার সাথে কথা বলতেন। তাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের একজন কনটেন্ডার বা পাবার যোগ্য লেখক বলে মনে করা হতো এবং অন্যান্য পুরস্কারের জন্যও তিনি মনোনীত হন। তিনি নোবেল না পেলেও ১৯৮৫ সালে জেরুজালেম পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে ইউরোপীয় সাহিত্যের জন্য অস্ট্রিয়ান রাষ্ট্রীয় পুরস্কার এবং ২০০০ সালে হার্ডার পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০২১ সালে তিনি স্লোভেনিয়ার প্রেসিডেন্ট বোরুত পাহোরের কাছ থেকে গোল্ডেন অর্ডার অফ মেরিট পুরস্কার পেয়েছিলেন।
মিলান কুন্ডেরার জন্ম ১ এপ্রিল ১৯২৯ চেকস্লোভাকিয়ার (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্র) ব্রানোতে। তার পিতা লুডভিক কুন্ডেরা (১৮৯১-১৯৭১) একজন বিশিষ্ট চেক সঙ্গীতবিদ ও পিয়ানোবাদক ছিলেন, যিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ব্রনোতে জান্যাচেক মিউজিক একাডেমির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে জানা যায়। মিলানের মা মিলাদা কুন্দেরোভা ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ। ফলে বাবা মা উভয় দিক থেকে সুকুমার চর্চার তালিম তিনি পেয়েছেন। মিলান তার বাবার কাছ থেকে পিয়ানো বাজাতে শিখেছিলেন এবং পরে মিউজিকোলজি ও মিউজিক্যাল কম্পোজিশন অধ্যয়ন করেন। সঙ্গীততাত্ত্বিক প্রভাব, রেফারেন্স এবং স্বরলিপি তার কাজ জুড়ে পাওয়া যায়। যৌবনে সঙ্গীত শিক্ষায় তার পিতার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে তিনি একজন সুরকার হিসেবে দক্ষতা প্রমাণ করছিলেন। সেই সময়ে তার একজন শিক্ষক ছিলেন পাভেল হাস। মিলানের বাবা পিয়ানো বাজানো শিল্পে খুব বেশি সফলতা লাভ করতে না পারায় এক সময় মিলান কুন্ডেরার কাজও থেমে যায়। তিনি প্রাগের চার্লস ইউনিভার্সিটিতে সঙ্গীত ও সুরারোপের উপর লেকচার দেন। তবে কিছু দিন পরই তিনি চলচ্চিত্র অধ্যয়নের জন্য প্রাগের একাডেমি অফ পারফর্মিং আর্টস এর ফিল্ম অ্যান্ড টিভি স্কুলে চলে যান। স্নাতক হওয়ার পর ফিল্ম ফ্যাকাল্টি কুন্ডেরাকে ১৯৫২ সালে বিশ্ব সাহিত্যের একজন প্রভাষক নিযুক্ত করে। ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় ওয়ারশ চুক্তির আলোকে আক্রমণের পর তিনি ফিল্ম ফ্যাকাল্টির চাকরি হারান। তার বাবা মারা যান ১৯৭০ সালে, তার মা ১৯৭৫ সালে।
মিলান কুন্ডেরা (১৯৪৭ সালে) চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কমিউনিস্ট সরকারের সাথে মতানৈক্যের জন্য তিনি দেশ ত্যাগ করেন। এরপর চল্লিশ বছর তিনি ফ্রান্সে বসবাস করেছেন। উল্লেখ্য ১৯৫০ সালে তাকে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টি থেকে তার বহিষ্কারের কাহিনী জান ট্রেফুল্কা তার উপন্যাস ‘প্রসেলো জিম স্টিস্টি’ (ইংরেজি নাম ‘লাক রেইনড অন দেম’, ১৯৬২) তে বর্ণনা করেছেন। কুন্ডেরা তার উপন্যাস দ্য জোক (১৯৬৭) এর মূল বিষয়বস্তুর জন্য বহিষ্কারকে একটি অনুপ্রেরণা হিসেবেও ব্যবহার করেছিলেন। যেখানে তিনি ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টিকে উপহাস করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে কুন্ডেরাকে পুনরায় দলে নেয়া হয় কিন্তু ১৯৭০ সালে দ্বিতীয়বার বহিষ্কার করা হয়।
যাই হোক কুন্ডেরা চেকোস্লোভাক কমিউনিজম সংস্কারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন এবং সহকর্মী চেক লেখক ভ্যাক্লাভ হ্যাভেলের সাথে লেখালেখির মাধ্যেমে প্রবলভাবে বিতর্ক করেছিলেন। ১৯৬৮ সালে যে বছর চেক সরকার তার বই নিষিদ্ধ করেছিল, তিনি সে বছর প্রথম বার প্যারিসে যান। তার লেখা পান্ডুলিপি ‘লাইফ ইজ এলসহোয়্যার’ চেকোস্লোভাকিয়ায় প্রকাশ সম্ভব হয়নি, তিনি দেশের বাইরে এ পা-ুলিপি পাচার করেছিলেন। ফ্রান্স থেকে তা প্রকাশিত হয়। ১৯৭৫ সালে তিনি ফ্রান্সে চলে যান।
মিলান কুন্ডেরা প্রধানত চেক ভাষায় লেখালেখি করেন। তবে তার কিছু বই ফরাসিতেও লেখা। তার রচিত প্রথম উপন্যাস দি জোক (The Joke)। উপন্যাসের শিল্পরূপ (Art of the Novel) ফরাসি ভাষায় লেখা একটি ননফিকশন বই। কুন্ডেরা বারবার জোর দিয়েছিলেন যে তিনি রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত লেখকের পরিবর্তে একজন ঔপন্যাসিক হবেন। বৃহত্তর দার্শনিক বিষয়বস্তু ছাড়া ‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’ প্রকাশের পর তার উপন্যাস থেকে রাজনৈতিক ভাষ্য সবই অদৃশ্য হয়ে যায়। কুন্ডেরার কথাসাহিত্যের শৈলী, দার্শনিক ডিগ্রেশনের সাথে জড়িত, রবার্ট মুসিলের উপন্যাস এবং নিটশের দর্শন দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। দ্য জোক ছাড়া লিখেছেন আরও অনেক উপন্যাস। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং (১৯৮৪), লাইফ ইজ এলসহোয়্যার (১৯৭৩), ইম্মরটালিটি (১৯৯০), আইডেন্টিটি (১৯৯৮), ইগনোরেন্স (২০০০), স্লোনেস (১৯৯৫) ও দ্য ফেয়ারওয়েল ওয়াল্টজ (১৯৭২)। আর ছোটগল্প সংকলনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লাফেবললাভস (১৯৬৯)। প্রবন্ধের বইয়ের তালিকায় আছে দ্য আর্ট অব নভেল (১৯৮৬), টেস্টামেন্টস বিট্রেইড (১৯৯৩), দ্য কারটেইন: অ্যান এসে ইন সেভেন পার্টস (২০০৫), কবিতাসংগ্রহের মধ্যে রয়েছে ম্যান: আ ওয়াইড গার্ডেন (১৯৫৩), দ্য লাস্ট মে (১৯৫৫) এবং মনোলগ (১৯৫৭)। নাটকও লিখেছেন কুন্ডেরা। উল্লেখ করার মতো নাটকগুলো হলো দ্য ওনারস অব দ্য কিজ (১৯৬২), টু এয়ারস টু ওয়েডিংস (১৯৬৮), দ্য ব্লান্ডার (১৯৬৯) ও জ্যাক্স অ্যান্ড হিজ মাস্টার (১৯৮১)।
কুন্ডেরার কবিতা, নাটক বা নন-ফিকশন বই নিয়ে পাঠকদের অত বেশি আগ্রহ নেই, যতটা আছে তার উপন্যাস ও গল্প নিয়ে। কিন্তু তার লেখা ফিকশনেও গল্প বলার চেয়ে তিনি বেশি জোর দিয়েছেন নিজের দার্শনিক চিন্তার প্রকাশে। বিশেষত দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং এবং দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং এই দুই বহুল জনপ্রিয় উপন্যাসে মূলত রাজনৈতিক চরমপন্থার আমলে মানুষের জীবনবাস্তবতাকে দেখানোর পাশাপাশি নিজের দর্শনচিন্তা প্রকাশের প্রয়াসও নিয়েছেন তিনি। আগেই বলেছি, প্রায় প্রতি বছরই সাহিত্যে নোবেল প্রাইজের সময় তার নাম আলোচনায় থাকতো, তবে তিনি পুরস্কার পাননি। তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য জোক’ এ তিনি কমিউনিস্ট যুগের টোটালিটারিয়ানিজমকে ব্যঙ্গ করেছেন। আগস্ট ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক দখলের পরে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত আক্রমণে সমালোচনার ফলে চেকোস্লোভাকিয়ায় তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয় এবং তার বই নিষিদ্ধ করা হয়।
কুন্ডেরার দ্বিতীয় উপন্যাস লাইফ ইজ এলসঅয়্যার প্রথম প্রকাশিত হয় ফরাসি ভাষায় ১৯৭৩ সালে এবং চেক ভাষায় ১৯৭৯ সালে। লাইফ ইজ এলসহোয়ার কাল্পনিক কবি জারোমিলের একটি ব্যঙ্গাত্মক প্রতিকৃতি, যিনি একজন তরুণ এবং অত্যন্ত নির্বোধ আদর্শবাদী যিনি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত হন। উপন্যাসের জন্য কুন্ডেরা একই বছর প্রিক্স মেডিসিস পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে কুন্ডেরা ফ্রান্সে চলে গেলে সেখান থেকে ১৯৭৯ সালে দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং প্রকাশিত হয়। এটিতে উপন্যাস, ছোটগল্পের সংগ্রহ এবং সঙ্গীতের একটি অস্বাভাবিক মিশ্রণ ঘটেছে, যা নির্বাসনে তার কাজগুলোকে চিহ্নিত করতে পেরেছিল। কীভাবে চেকরা বিভিন্ন উপায়ে কমিউনিস্ট শাসনের বিরোধিতা করেছিল তা এই বইতে তুলে ধরা হয়েছে। মিলান কুন্ডেরার স্যাটায়ার ও কবিতার মতো গদ্য লেখনী জীবনের বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক দিককে পাঠকের সামনে উন্মোচন করেছে। ভিন্নমত প্রকাশের জন্য তিনি চেক নাগরিকত্ব হারিয়েছিলেন। এ অভিজ্ঞতার বিষয়টি তার লেখনীকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। আর এনে দিয়েছে বিশ্ব খ্যাতি।