বিচার

জোবায়ের রাজু
সারাবাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও রিনা ফুপুকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বাবা সকল আত্মীয়ের বাড়িতে ফোন করে খবর নিয়ে জানলেন তার অতি আদরের ছোট বোন রিনা কোথাও নেই। রিনা ফুপুর আকস্মিক এমন গায়েব হবার ঘটনায় আমাদের পুরো পরিবারে যখন এক তীব্র শোকের শুরু হতে যাচ্ছে, তখন মা আবিষ্কার করলেন রিনা ফুপুর ঘরে টেবিলের উপরে বিষাদ সিন্ধু বইটার পাশে একখানা ভাঁজ করা চিঠি।
চিঠিতে রিনা ফুপু লিখেছেÑ‘ভাইজান, তুমি আমার অমতে মিযান নামের যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছো, আমি সে ছেলেকে জীবনেও গ্রহণ করতে পারব না বলে দুলালের কাছে চলে গেলাম। দুলালের সাথে আমার তিন বছরের প্রেম। তাকে ছাড়া আর কারো গলায় ঝুলতে পারব না বলে রাতের অন্ধকারে চলে গেলাম। স্টেশনে দুলাল আমার অপেক্ষায়। শেষ রাতের ট্রেন ধরে আমরা শহরে চলে যাব। তারপর কোন এক কাজী অফিসে গিয়ে...। অভিশাপ নয় ভাইজান, আমাদের জন্য দোয়া করো।’
চিঠিখানা পড়ে বাবা বাড়ি কাঁপিয়ে কাঁদলেন। কী করেননি এ বোনের জন্য তিনি! আমার দাদাজান যখন মারা যান, রিনা ফুপুর বয়স তখন সাত বছর। পিতৃহারা বোনটাকে বাবা নিজের সন্তানের মতো আদর সোহাগে বড় করেছেন। সুÑশিক্ষায়ও করেছেন শিক্ষিত। আসছে এগার তারিখে মিযান নামের পাশের গ্রামের এক স্কুল টিচারের সাথে রিনা ফুপুর বিয়ে হবার কথা। কিন্তু তার আগেই রিনা ফুপু সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কাল রাতের অন্ধকারে কোথাকার কোন দুলালের সাথে..। আমাদের এ সচেতন পরিবারের কেউ কখনো বুঝতেও পারেনি রিনা ফুপুর অন্তরে দুলাল নামের কেউ একজন তিন বছর ধরে বাস করেছিল। এমন কি তার সাথে রিনা ফুপুর কখন কবে কোথায় দেখা হয়েছে এবং সে দেখা ধীরে ধীরে প্রেমে পরিণত হয়েছে, কেউ জানতেও পারেনি, অথবা রিনা ফুপু কাউকে
বুঝতেও দেয়নি।
২. এই ঘটনার বেশ কয়েকদিন পার হয়ে গেল, মা সকাল সন্ধ্যা তার একমাত্র বান্ধবীর মতো ননদের জন্য বিলাপ করে কাঁদেন। বাবা তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে সারাক্ষণ মনমরা করে বারান্দায় বসে থাকেন। সব মিলিয়ে সারা বাড়িময় একটা শোক শোক আমেজ, যা আমার ভালো লাগে না। এত চিন্তার কী আছে! রিনা ফুপু তো আর কবরে যায়নি। ভালোবেসে প্রেমিকের সাথে ঘর বাঁধতে গেছে। সুখে আছে হয়তো দুজনে। এই সরল ব্যাখ্যা বাবা কেন বোঝেন না!
পাড়া পড়শীরাও বদনাম রটাতে শুরু করেছে। যারা আমাদের নিন্দুক, তারা আড়ালে আবডালে থেকে বলে বেড়ায়Ñ‘ছিঃ ছিঃ, রিনাটা বংশে চুনকালি দিয়ে একি করল?’ রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে এ রকম দু’চারটে কটু কথা আমার কানে আসে। আমি না শোনার ভান করে স্থান ত্যাগ করি।
৩. দুঃখ জিনিসটা কখনো স্থায়ী নয়। রিনা ফুপু চলে যাবার দুঃখ আস্তে আস্তে মুছতে থাকে বাবা আর মায়ের মন থেকে। এমন কি আমি নিজেও নিজের মধ্যে সেটা দারুণ টের পেলাম। রিনা ফুপু চলে যাবার পর প্রথম প্রথম ভাবতাম কে আমাকে ভূতের গল্প শোনাবে, মায়ের মাখানো দুধ মাখা ভাত না খাওয়ার অপরাধে মা যখন রাগে ক্ষোভে আমাকে ঠাস ঠাস করে চড় মারবে, তখন কে দৌড়ে আসবে আমাকে বাঁচাতে! এমন কি আমার চারুকলার পরীক্ষার খাতায় রিনা ফুপু ছাড়া কে রং পেন্সিল দিয়ে এঁকে দিবে ফুল পাখিদের বর্ণিল ছবি। এসব আগে ভাবলে আমি চাপা কষ্টে বার বার মূর্ছা যেতাম। আজকাল এই দুঃখবোধটুকুও আমার ক্রমশ কমে গেছে।
দিন দিন আমরা স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। বাবা তার ব্যবসায় মন দিলো। মা চুলোর ধারে বটি নিয়ে মাছ কুটতে কুটতে সাবিনা ইয়াসমিনের গান ধরেনÑ‘প্রজাপতি উড়ে গিয়ে বল না...।’ আমি রোজ স্কুলে যাই। নিন্দুকদের মুখও ততদিনে বন্ধ হয়।
সব মিলিয়ে আমরা যখন রিনা ফুপুকে মোটামুটি ভুলেই গেছি, তখনই আচমকা এক সকালে রিনা ফুপু জীর্ণ পোশাক পরে কংকালসার দেহ নিয়ে আমাদের দুয়ারে এসে দাঁড়ালো। মা ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বললেনÑ‘রিনা তুই? শরীরের এ হাল কেন?’ রিনা ফুপু কোন কথা না বলে দৌড়ে এসে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। বাবা আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই অপ্রত্যাশিত ঘটনা দেখছি। বাবার চোখ মুখ জুড়ে রাজ্যের বিস্ময়। আমি উৎসুক চোখে রিনা ফুপুর কান্না দেখছি। রূপ লাবণ্যে ভরপুর রিনা ফুপুর চেহারা আর শরীর ভেঙ্গে বীভৎস হয়ে গেছে। দেখে মনে হয় পুষ্টির বড় অভাব। কিন্তু তার এই হাল কেন? দুলাল নামে সে মানুষটিও বা কোথায়? যার জন্য রিনা ফুপু রাতের আঁধারে ঘর ছেড়েছে।
৪. আস্তে আস্তে আমরা সবাই জানলাম রিনা ফুপুর সকল দুঃখের গল্প। যে সুখ আর সখ্যের স্বপ্ন দেখাতে দুলাল রিনা ফুপুকে রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে বের করে নিয়েছিল, সে কথা রাখেনি দুলাল। দুলালের সাথে দু’চার দিন সংসার করার পরই রিনা ফুপু বুঝতে পারল তার কাঙ্খিত মানুষটার সাথে একাধিক নারীর অবৈধ সম্পর্ক আছে।
এসব সত্য কোনভাবেই মানতে পারল রিনা ফুপু। ফলে দুলালের সাথে তার প্রতিনিয়ত ঝামেলা হত। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রিনা ফুপুর গায়ে হাত তুলতো। এলোপাতাড়ি কিল ঘুষির অসহ্য ব্যথা নিয়েও দিনের পর দিন দুলালের সংসার করেছে রিনা ফুপু। কিন্তু এভাবে আর কত দিন! একদিন সকালে দুলালের সংসার ছেড়ে চলে আসে রিনা ফুপু।
রক্তের সম্পর্ককে আলাদা করা যায় না বলেই হয়তো বাবা তার বোনের সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন। কুমারি জীবন নষ্ট করে আমাদের সংসারে আবার আগের মতো পরিপাটি হয়ে উঠল রিনা ফুপু। মাকে প্রায়ই রিনা ফুপু বলতোÑ‘একদিন ওই শূয়োরটা আমাকে লাথি মেরে খাট থেকে নিচে ফেলে দিয়েছে ভাবী। আমি সারা রাত কাঁদলাম।’ মা কাতর গলায় বললেনÑ‘এসব বলিস না রিনু। কষ্ট বাড়ে।’
৫. আজ বাসায় কেউ নেই। রিনা ফুপুর কী যেন একটা অসুখ। বাবা মা দুজনে তাকে গাইনী ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছেন। বারান্দার তারে ঝোলানো আমাদের দীর্ঘ দিনের পোষা তোতার খাঁচার কাছে যখন এসে ঠায় দাঁড়ালাম, তখনই আবিষ্কার করলাম কে যেন আমাদের উঠোনে এসে কাকে যেন খুঁজছেন। ভদ্রলোকের শরীর দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি বেশ রোগাটে। কিন্তু চেহারায় আশ্চর্য মায়া। যদিও শরীর ভেঙে যাওয়াতে তার গালের মাংশে টান টান ভাব চলে এসেছে।
জিজ্ঞাসু সুরে বললামÑ‘আপনাকে ঠিক চিনলাম না।’ তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মলিন গলায় বললেনÑ‘তুমি জনি। তাই না? রিনার কাছে তোমার অনেক গল্প শুনেছি। রিনা কোথায়? ডেকে দিবে?’ বললামÑ‘বাড়িতে কেউ নেই।’ ভদ্রলোক আবার চুপ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর রুগ্ন গলায় বললেনÑ‘একটু কাগজ আর কলম এনে দিবে আমাকে?’
আমি কাগজ কলম নিয়ে এলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী যেন লিখে আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেনÑ‘রিনা এলে এটা দিও।’ বলেই তিনি চলে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই কী মনে করে আমার কাছে এসে আমাকে আলতো করে চুমো খেয়ে বললেনÑ‘তুমি খুব ভালো ছেলে বাবা। রিনা বলতো।’ আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। চলে
গেলেন ভদ্রলোক।
ভদ্রলোক কী লিখেছেন, সেটা জানতে কাগজখানা চোখের সামনে মেলে ধরলাম। রিনা ফুপুর উদ্দেশে ছোট্ট একটি চিরকুটÑ‘রিনা, আমি দুলাল। ক্ষমা চাইতে তোমার কাছে এসেছি। একদিন স্বপ্ন দেখিয়ে তোমাকে এই বাড়ি থেকে বের করে নিয়েছি। শেষ পর্যন্ত সুখী করতে পারিনি। নানানভাবে নির্যাতন করেছি কেবল। সেটা সহ্য করতে না পেরে চলে এলে ভাই ভাবীর কাছে। তারা তোমাকে কতটা ক্ষমা করেছে জানি না, তবে আমার বিচার আল্লাহ করেছেন। তোমার জীবন নষ্ট করেছি বলে আল্লাহ আমার শরীরে ক্যান্সার দিয়েছেন। উপযুক্ত বিচার। মৃত্যুর আগে তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এলাম।’
চিরকুটখানা পড়ে ভদ্রলোকের পরিচয় জানলাম। ইনিই তাহলে সেই দুলাল! রিনা ফুপুর স্বপ্ন পুরুষ। তাকে আমি আরেকটু ভালো করে দেখব।
এক দৌড়ে ছুটে গেলাম বাড়ির গেইটে। চারদিকে খুঁজতে লাগলাম সেই মানুষটাকে। না তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অসুস্থ শরীর নিয়ে এই অল্প সময়ে কিভাবে যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন, বুঝলাম না।