শাপলা বিলে দুই বন্ধু

নুশরাত রুমু
সেদিন ছিলো শুক্রবার। ছুটির দিন। পড়াশোনার চাপ নেই। সকালের নাস্তা শেষ করেছে পুলক। মাকে কাজে ব্যস্ত হতে দেখেই টুক করে বেরিয়ে গেল সে। খেলার মাঠে এসে দেখল ওর বন্ধু জিহান আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছে। পাশাপাশি বাড়ি ওদের। দুই বন্ধুতে খুব ভাব। দু’জনেই এবার পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে। কিন্তু আজ ওরা মাঠে খেলার সুযোগ পেল না। এলাকার বড় ভাইয়েরা ক্রিকেট খেলছে সেখানে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। একে অপরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে। কি করা যায়। ছুটির দিনে খেলার মজাটা পাওয়া হলো না। বাড়ি ফিরে যাবারও ইচ্ছে নেই। পুলক সরল ছেলে, মাথায় বুদ্ধি কিছু কম। জিহান আবার বেশ চটপটে। যেকোন কাজের বুদ্ধিতে তার জুড়ি নেই। যদিও তার বেশির ভাগ বুদ্ধি সুফল বয়ে আনে না। আজও সে সময় কাটানোর বুদ্ধি বের করে ফেলল।
চল আমরা আজিজ চাচার ছোট নৌকাটা নিয়ে বিল দেখতে যাব।
কিন্তু উনিতো নৌকা দেবেন না। আগেও দুবার মানা করেছিল।
ধুর, ওনাকে কে বলতে যাচ্ছে। উনি বাড়ি নেই।
কেন?
গতকাল বিকেলে রানু বুবুর শ্বশুরবাড়ি গেছে, আমি দেখেছি। বিকেলের আগে ফিরবে না।
তাহলে দারুণ সুযোগ!
যা বলেছিস, জলদি চল।
দু’জনেই আজিজ চাচার বাড়ির পাশে খালের দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে সবসময়ই তার ডিঙি নৌকাটা বাঁধা থাকে। তিনি মাছ ধরেন। শাপলা তোলেন। সাবধানে পা টেনে নৌকায় উঠল পুলক। বইঠা হাতে নিল। জিহান দ্রুত নৌকাটা ঠেলে নিজেও লাফিয়ে নৌকায় উঠে বসল। চারদিকে সতর্ক চোখে তাকিয়ে বলল তাড়াতাড়ি চালা। কেউ দেখার আগে খালটা পেরুতে হবে। নৌকার এক কোণে একটা হুঁকোর কলকে রাখা। জিহান সেটা নেড়ে দেখল। নাহ্ তামাক নেই। পানের ছোট ডিব্বাটাও একেবারে খালি। কিপটেটা এক টুকরো সুপারিও রাখেনি। পুলক একটু বিরক্ত হলো, রেখে দে এসব।
সামনে তাকিয়ে দেখ --
খাল পেরিয়ে ওরা নৌকা নিয়ে বিলে গিয়ে পড়লো। সকালের রোদের ঝলকানিতে বিলের পানি ঝিকমিক করছে। একটু দূরেই রাশি রাশি শাপলা ফুটে আছে। অনেক জায়গা অব্দি ফুলগুলো দেখা যাচ্ছে। গোলাপি, সাদা এমনকি বেগুনি শাপলাও দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। রঙের এমন বাহারে দু’জনেই অবাক হয়ে গেল। যেন চোখের পলকই পড়ে না। জিহান আরেকটু ভালো করে দেখার জন্য উঠে দাঁড়াল। তাতে ছোট ডিঙিটা বেশ দুলে উঠল। ভয় পেয়ে গেল পুলক।
আরে আরে কি করিস!
তুই একটা ভীতুর ডিম। ওদিকে আরেকটু এগিয়ে নে। এসেছি যখন কিছু শাপলা তুলি। মা দেখলে খুশি হবে। ফুটন্ত শাপলার একেবারে কাছে গিয়ে নৌকাটা থামাল পুলক।
জিহান টেনে টেনে লাল শাপলাগুলো তুলতে লাগল। পুলকও বসে রইল না। সে বেছে বেছে সাদা শাপলা তুলতে লাগল। একটু দূরে যেন কিছু একটা নড়ে উঠল। জিহান বইঠা দিয়ে দ্রুত নৌকাটা সেদিকে নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু পুলক বাধা দিলো।
ওদিকে যাবার কি দরকার?
আরে মনে হয় কেউ জাল বসিয়েছে। মাছের শব্দ। মাছের সাথে সাপও থাকতে পারে। পুলকের স্বরটা কেঁপে গেল। শুনে জিহান হেসে ফেলল। জালের কাছে নৌকা পৌঁছাতেই মাছের দাপাদাপি বেড়ে গেল। অনেকগুলো কই মাছ আটকেছে জালে।
জিহানের চোখে খুশির ঝিলিক। টপাটপ সে মাছগুলো খুলে নিতে লাগলো। ইয়া মোটা এক ঢোঁড়া সাপ আটকেছে জালে। সাপের নড়াচড়া দেখে পুলক ভয়ে নৌকাটা ঘোরাতে চাইল। তাড়াহুড়োতে নৌকার কোণাটা জালের ছিদ্রতে আটকে গেছে সেটা সে বুঝতেই পারেনি। ক্রমাগত বইঠা চালিয়ে এগোনোর চেষ্টা করছিল। জিহান উল্টোদিকে মাছ সামলাতে ব্যস্ত। সাপটা মাথা বাড়াতেই পুলক ভয়ে চিৎকার করে নৌকা থেকে পড়ে গেল। নৌকাও কাত হয়ে শেষে উল্টে গেল। পড়ে গেল জিহানও। বকতে লাগল সে পুলককে।
কি করলি এটা? সাপটাতো আটকেই আছে, তোকে খেয়ে ফেলত নাকি, বোকা কোথাকার!
এদিকে মাছগুলো সুযোগ পেয়ে পানিতে পালিয়ে গেল। জিহান নানারকম চেষ্টা করে একটি মাছও রাখতে পারলো না। ভেসে গেল শখের শাপলাগুলো। ভাবলো দু’জনে মিলে নৌকাটা সোজা করবে। হঠাৎ খেয়াল করল আরেকটা নৌকা এদিকেই আসছে। ওরা মাছ চুরি করছিলো জালের মালিক হয়ত টের পেয়েছে। নৌকা রেখে প্রাণপণ সাঁতরানো শুরু করলো ওরা। ডাঙায় উঠে একেবারে শুয়ে পড়ল জিহান।
পুলক হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগল -- এজন্যই গুরুজনেরা বলে লোভ করা ভালো নয়। বেশি লোভের কারণেই সব বিলের জলে গেল।