জীবনঘুড়ির আকাশ দেখা

সাজজাদ হোসাইন খান
আবার স্কুল কামাই। বাসাবদলের ঝক্কি-ঝামেলাতো থাকবেই। যদিও কলোনীর ভিতরেই ঘুরাফেরা। কেবল পুব সীমা থেকে পশ্চিমে। হাঁটাপথে পাঁচ সাত মিনিট, বড়জোর। তারপরও মাথায় বাড়ি সময়ের। খাট-পালঙ টানা হেঁচড়া। কপাল-পিঠ ঘামে চপচপ। তাই একদিনের ফুরসৎ। আবার আরামবাগ-ফকিরাপুল সীমানা থেকে বাস। দশ পয়সার টিকিটে মেডিকেলের গেইট। এমনটাই প্রতিদিনের রুটিন। আবার নয় ক্লাস পার করছি। তাই মনের ভিতর আলাদা ফখর। ফখর কারণ, সব স্কুলেই নাইন ক্লাসের ছাত্ররা সরদার। স্কুলের সব অনুষ্ঠানে নবম শ্রেণীর ছাত্ররাই আগে আগে। স্যাররাও খাতির যত্ন করেন। সলাপরামর্শ করেন। একটা অন্যরকম দিন যায়। নতুন রং নিয়ে সূর্য ঝলমল। নব নব চেহারায় নবকুমার এসে হাজির হয়। তেষট্টি সালতো চলে গেল। চৌষট্টিও যায় যায়। সময় বসতে চায় না। কেবলই হাঁটে। এই হাঁটার শেষ যে কই কে জানে। বইপত্রেও কোনো গাঁও গেরামের নাম লেখা নাই। এই গেরামে এসে হাঁটার ইতি। ঘুরেফিরে আসে সকাল। তারপর ঘুটঘুটে আন্ধার। একবার সকালের কাছে গিয়ে দেখা করে সূর্য। গল্পসল্প শেষে পা বাড়ায় জঙ্গলের গভীরে। যেখানে ছোপ ছোপ কালি। এভাবেই হাঁটছে সময়। যাচ্ছে সময়। নবকুমারও হয়ে যাচ্ছে অন্যরকম। ছাত্ররাও পুরানে নতুনে আউলা ঝাউলা।
খেলাধুলায় খুব নামডাক নবকুমারের। বিশেষভাবে ফুটবলে। ইন্টারস্কুল চ্যাম্পিয়ন। বলতেই নবকুমার। ফি বছর। এই জন্য হামিদ স্যার জিন্দাবাদ। তামাম দেশ খুঁজে পেতে ভালো ভালো ফুটবলার জোগাড় করতেন তিনি। তারপর স্কুলে ভর্তি করতেন। এরা তখন নবকুমারের ছাত্র। খেলায় নবকুমারের সামনে সব স্কুল বিড়াল। বাঘের হালুম হালুম শুরু হলে বিড়ালের মিউ মিউ ঝরতো মাঠে।
আমাদের ক্লাসেই পড়তো খোকন। ভালো ফুটবল খেলে। ওর আরেক ভাইয়ের নাম বাবুল। পড়ে টেন ক্লাসে। দারুণ খেলে। ওরা দু’ভাই নবকুমার টিমের খেলোয়াড়। খোকনের সাথে খুব ভাব আমার। ওর বাসায়ও গেছি বার কয়েক। আলীয়া মাদরাসা পার হলেই খোকনদের বাসা। ওরা ভাই-বোন খেলাধুলায় সবার আগে আগে। খুব নাম-ডাক। আমিও খেলা-টেলায় একটু আধটু লাফঝাঁপ দেই। তাই খোকনের সাথে খাতিরটা ভালোই জমে গেছে। স্কুলে পৌঁছেই দেখি অন্যরকম ভাবসাব। হালীমকে জিজ্ঞেস করলাম কিরে এতো আনন্দ কিসের। হালীম বললো তুই জানিস না? আজতো সেমি ফাইনাল। আজকের খেলা জুবলী স্কুলের সাথে। আমি ভুলেই বসে ছিলাম। কানের কাছ দিয়ে উড়ে গেলো একঝাঁক গরম বাতাস। সে বাতাসে ভয় না আনন্দ বসে আছে কে জানে। আগের সব খেলায় জিতে জিতেই তো সেমি ফাইনাল পর্যন্ত আসা। তাই ভয়টয় সব লাফিয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়লো। তারপরও বলাতো যায় না। হালীম মুহিবুররা আমার ভয়ের কোনো পাত্তাই দিলো না। বললো আমাদের টিমে সেলিম আছে, আফতাব আছে। আর কী লাগে। তুফানের মতো খেলে। গত খেলায় তো সেলিম একাই দুই গোল দিলো। গালগপ্প মারতে মারতে পল্টন ময়দানে এসে পৌঁছে গেলাম। আজকের খেলা এ ময়দানে। বিশাল ময়দান। কত রকমের খেলা যে হয় এ মাঠে হিসাব করতে গেলে আঙ্গুলের কড়া সব শেষ। স্টেডিয়ামের পাশের টিকেই বলে পল্টন। সভা-টভার সাথে খেলাও জমে। নবকুমার আর জুবলী স্কুলের ছাত্র স্যারদের ভিড়ে জমজমাট পল্টন ময়দান। রেফারির বাঁশির সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো খেলা। বাতাসে উড়ছে হই হই রই রই শব্দ। দুই স্কুলের ছাত্র দু’পাশে। কাতারবন্দি। স্যাররা একসাথে। বল ঘুরছে এক পা থেকে অন্য পায়ে। সেলিমের ঘূর্ণি শর্টে বল গিয়ে আছড়ে পড়ল জুবলি স্কুলের গোলপোস্টের জালে। আর যায় কই। আমরা লাফিয়ে উঠলাম তা ধিন ধিন।
জমে উঠেছে খেলা। যেনো বাঘে মহিষে কামড়া কামড়ি। জুবলী স্কুলও কম না। বাতাস ফাঁক করে যেনো দৌড়াচ্ছে দুই স্কুলের খেলোয়াড়রা। খেলা শেষ হয় হয়। সময়ের কাঁটা চান্দি ছুঁই ছুঁই। এক গোলে আগে নবকুমার, বুক ঢিপ ঢিপ করছে। কি জানি কি হয়। জুবলীর খেলোয়াড়রা মাঠ কাঁপাচ্ছে। ঠিক এমন সময় সেলিমের উড়ন্ত শর্ট। চিলের মতো গুত্তা দিয়ে জুবলী স্কুলের জালে আছড়ে পড়লো। তখন পল্টন জুড়ে হৈ হৈ রৈ রৈ। চারদিকে নবকুমার জিন্দাবাদ। এই যখন অবস্থা তখনই রেফারি বাজালো শেষ বাঁশি। দেখলাম হামিদ স্যার আমাদের মতো ধেই ধেই নাচছেন। হ্যাড স্যার উঠে এসে হামিদ স্যারকে জড়িয়ে ধরলেন। খেলোয়াড়দের মাথা পিঠে হাত বুলালেন। বিশেষ করে সেলিমকে বুকে টেনে নিলেন। সারা ময়দান জুড়ে ঝরছে খুশি আর আনন্দের জুঁই-চামেলি। সূর্য তখন ঢলে পড়েছে পশ্চিমে অনেকটা। এবার ফাইনালের জন্য তৈরি।
যখন বাসায় ফিরলাম সূর্য তখন আকাশের কিনারে লটকে আছে। অন্যদিন এর অনেক আগেই হাজির হই। তাই বড় বড় চোখে তাকালেন আব্বা। বললাম খেলা ছিলো স্কুলের। ফুটবল সেমি ফাইনাল। নবকুমার আর জুবলী স্কুলের। আব্বাও একসময় ফুটবল খেলতেন। জানতে চাইলেন জিতলো কারা। বললাম আমরাইতো জিতে ফিবছর। নবকুমার ফাইনালে উঠে গেছে। এমন খবরে আব্বাও খুশির বালিশে মাথা রাখলেন। আমার চোখের মণিতে তখন আনন্দের গোলাপ ঝুরঝুর।
(চলবে)