কবি মতিউর রহমান মল্লিকের কবিতায় দেশপ্রেম

ড. ফজলুল হক তুহিন
ঘন দুর্যোগ পথে দুর্ভোগ তবু চল তবু চল
পাহাড় বনানী পেরিয়ে সেনানী ভাঙ মিথ্যার জগদ্দল
মজলুমানের মৃত্যু-তুহিন হৃদয়ে
আন আশ্বাস রক্তসূর্য উদয়ে
হেরার গুহার উদ্ভাসে সে জাগা জনতার প্রাণ অতল।
- মতিউর রহমান মল্লিক
মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। সমাজকাঠামোর সমবায়ে রাষ্ট্র গঠিত, মানুষ সেই রাষ্ট্রের নাগরিক; রাষ্ট্র পরিচালিত হয় রাজনীতি দিয়ে। মানুষের জন্যে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র নামের এই অপরিহার্য সংগঠন পরিচালনার নীতিই রাজনীতি। আধুনিককালে রাজনীতি ব্যক্তিজীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। অনেকাংশে রাজনীতির দ্বারা ব্যক্তিজীবন নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। ব্যক্তিজীবন এ ব্যাপারে সচেতন থাকুক আর না-ই থাকুক, রাজনীতিই ব্যক্তির অবস্থান ও সীমা-পরিসীমা নির্ধারণ করে দেয়। আধুনিককালে প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র যতো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, ব্যক্তিজীবন ততো নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ফলে পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় ব্যক্তির অবস্থান অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত। প্রতিটি নাগরিকের সঙ্গে সঙ্গে জনসমাজ প্রত্যক্ষ বা পর্ক্ষোভাবে রাজনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশে রাজনীতির মূল সমাজ, সিভিল সোসাইটি (civil society) বা জনসমাজ। বাংলা অঞ্চলে রাজনৈতিক চিন্তা উনিশ শতক থেকে এই জনসমাজকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। সেইসাথে কবিতাও প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছে রাজনীতির ঢেউয়ে। বাংলা কবিতায় নজরুল প্রথম রাজনীতিকে কবিতার সার্থক উপাদান করে তোলেন। পরবর্তীকালে এই ধারা গতিশীল হয় আরো।
আধুনিককালে রাজনৈতিক চেতনা বলতে যে বোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি নির্দেশ করে, তার প্রকাশ একান্ত আধুনিক যুগেই। প্রাচীন বা মধ্যযুগের চিন্তা-চেতনা থেকে তা সম্পূর্ণ পৃথক। উনিশ শতকে ব্রিটিশ উপনিবেশের চিন্তাবিপ্লবের সূত্রে এই চেতনার জন্ম। অস্থির ও উত্তপ্ত আশির দশকে কবি মতিউর রহমান মল্লিক (১ মার্চ ১৯৫৪-১২ আগস্ট ২০১১) বাংলাদেশের কাব্যজগতে প্রবেশ করেন; বহুমুখী সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারি কবি সৃষ্টি করেন অসাধারণ কাব্য ‘আবর্তিত তৃণলতা’ (১৯৮৭)। তিনি আজীবন যুগপৎভাবে দৈশিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে মানুষের অধিকার, সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও স্বাধীনতার কবিতা রচনা করেন। আশির দশকে প্রবল স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের সময় কবিরা রাজনীতিচেতন হয়ে ওঠেন কালধর্ম অনুসারে। প্রায় সকল কবি সে সময় রাজনৈতিক কবিতা লেখেন। মতিউর রহমান মল্লিকের মতো মানবতাবাদী, সমাজ-রাজনীতিচেতন কবি স্বাভাবিকভাবে প্রচ-ভাবে রাজনীতিক্রান্ত হয়ে ওঠেন। একদিকে কবি স্বৈরাচারি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কলম সৈনিক; অন্যদিকে মানুষের গুণগত পরিবর্তনের জন্য এবং সার্বিক মুক্তির জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠেন। পরবর্তী কালে কবি আরো বেশি রাজনীতির কবিতাচর্চা করেন মানবিক মুক্তির লক্ষ্যে। প্রথম কাব্যে কবির উচ্চারণ:
একটি কাফেলা জনতার মনে
অবশেষ সম্বল
একটি কাফেলা মিছিলে মিছিলে
অবিরাম চঞ্চল
একটি কাফেলা নতুনের চোখে
সূর্যের ইংগিত
একটি কাফেলা রণাঙ্গনের
তা তা থৈ সংগীত
একটি কাফেলা আগুনের ঝড় তুলে
আমাকে করেছে বিপ্লবে উৎসুকী।
[‘কাফেলা’, আবর্তিত তৃণলতা]
কবি প্রবলভাবে আদর্শিক আন্দোলনের অগ্রযাত্রার ধারাকে চিহ্নিত করে সেই প্রবাহকে এগিয়ে নিতে আগ্রহী। দেশের মানুষের মুক্তির জন্যে কাফেলার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন নানা উপমায়। আদর্শিক বিপ্লবের মাধ্যমে মানবতার মুক্তির নিশান উড়াতে চান। তবে দেশি ও বিদেশি শক্তি দেশের সর্বনাশে সমস্বরে ষড়যন্ত্রে নানা তৎপরতায় ক্রিয়াশীল।
নীল অজগর লকলকিয়ে আসছে ধেয়ে;
সমস্বরে শকুনেরাও উঠছে গেয়ে।
উঠছে গেয়ে ভূতেরা তেত্রিশ কোটি ;
জমছে অন্য ক্লাইভের মদের কুঠি।
[‘ঋতুর স্বভাব’, অনবরত বৃক্ষের গান]
কিন্তু মানবতার বিকাশে, মুক্তিতে ও অগ্রযাত্রায় প্রধান বাধা হয়ে আছে দেশি ও বিদেশী সা¤্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি। তারা ষড়যন্ত্র করে মুক্তির পথে প্রতিবন্ধকতা গড়ে তুলতে চায়। সেজন্য কবি সার্বত্রিক মুক্তির কথা সাহসের সাথে উচ্চারণ করেছেন। আহ্বান জানিয়েছেন ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন :
আয় শতাব্দী বিংশ এক
দুঃশাসনের রক্ত চেয়ে
একটি চরম পত্র লেখ
একটি গরম পত্র লেখ
সন্ত্রাসীদের আন পতন
আদ্ ও সামুদের মতন
অত্যাচারির ধ্বংস আন
সব পরাজয় যেমন ম্লান
স্বৈরাচারের আনরে ক্ষয়
মৃত্যু যেমন করুণ হয়
সেচ্ছাচারের স্বপ্ন সাধ
ভাঙ ভেঙে কর আর্তনাদ আয় শতাব্দী এক নতুন
এই পৃথিবীর আকাশ থেকে
তাড়িয়ে দে’রে সব শকুন
[‘শতাব্দীর গান’, তোমার ভাষায় তীক্ষè ছোরা]
নতুন শতকে কবি যাবতীয় স্বৈরতন্ত্র ও দুঃশাসনের যাঁতাকল থেকে মুক্তি চান। এই মানবতাবিরোধী অপশক্তির জুলুম-নির্যাতন-সন্ত্রাস-লুটপাট থেকে কবি উত্তরণ কামনা করেছেন; সেইসাথে মানবিক অধিকারসম্পন্ন সমাজ কায়েমের আহ্বান করেন কাব্যিক ছন্দ ও সুরে।
শাসকের পালিত শকুন
আবার উড়েছে দেখি স্বদেশের পরে
জীবনের সর্ব ও সর্বান্ত স্তরে
মানুষের অন্তরে
মৃত্তিকা-বৃক্ষ-পানি ও প্রাণী প্রত্যহ মরে!
[‘কষ্ট ৯৭’, তোমার ভাষায় তীক্ষè ছোরা]
সংবাদপত্র সমাজ ও রাষ্ট্রের আয়না। কবি পর্যবেক্ষণ করেন সংসারে এই খবরের কাগজের আগমনের সাথে সাথে সমাজের যাবতীয় নেতিবাদক ও দুঃখজনক সংবাদ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ফলে পাঠকের স্বাভাবিক মন ও মানসিকতা নষ্ট হয় ও তুমুল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কবি এই অবস্থা থেকে সুস্থ রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
অথচ কোনো সর্বোচ্চ দলীয় দাপটের একটা মাত্র অস্ত্রের ভাষাই
মুহূর্তের মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে অগণিত আগ্নেয়াস্ত্র হয়ে
এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিলো
বাংলাদেশের চৌদ্দ কোটি স্বদেশ-প্রেম
মূলত আইন হাতে তুলে নেয়ার চেয়েও
আগ্নেয়াস্ত্রের ভাষায় থাকে
গৃহযুদ্ধের মতো অসংখ্য গণহত্যার অপরাধ
[‘অস্ত্রের ভাষা’, চিত্রল প্রজাপতি]
কবি স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করেন। দেশের গণমানুষের বিশ^াসনের বিপক্ষে মানবতা, স্বাধীনতা ও সার্বোভৌমত্বের শত্রু এবং দেশের স্বার্থ হরণকারি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের হিং¯্রতা, শত্রুতা, বিদ্বেষ ছড়ানো কাজ, হত্যা-সন্ত্রাস-রাহাজানি থেকে মুক্তির জন্য কবি ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। জনবিরোধী রাজনীতি থেকে কবি আদর্শিক রাজনীতির মাধ্যমে গণমানুষের মুক্তির মন্ত্র উচ্চারণ করেন।
আবার জনতা বাঁক নেবে বলে
সমূহ ক্রান্তিকালের পার হয়ে যায় বিষিত ঘূর্ণাবর্ত
অথবা ওঁতপাতা কালো পথ।
আবার জনতা পাশ ফেরাবার উদ্যোগ নেবে বলে
সাহসের দিন রাজপথে এসে নামে।
আবার স্বদেশ মাথা উঁচু করে যেন
হায়নার চোখে তের কোটি তীর ছেড়ে।
আবার সময় ঘুরে দাঁড়াবার
প্রস্তুতি নেয় দেখোÑ
উত্তর গেট পল্টন মোড় অথবা বাংলাদেশ
শ্লোগানে শ্লোগানে আগুনের লেলিহান।
[‘২০০১’, অপ্রকাশিত কবিতা]
কবি দেশকে প্রচ- ভালবাসেন বলে দেশের স¦ার্থবিরোধী সবকিছুকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করেন। প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিপক্ষে প্রবলভাবে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-আক্রমণ সব ধরনের ভাষিক অস্ত্র চালিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে। স্বদেশপ্রেম ও স্বাদেশিক বোধ থেকে উত্থিত হয়েছে কবির দীপ্র প্রতিরোধ। কবির রাজনীতি-চেতনা আজীবন ক্রিয়াশীল থেকেছে দেশ ও দশের স্বার্থে, মানবতার পক্ষে ও সার্বোভৌমত্ব রক্ষায়। সাংস্কৃতিক রাজনীতির মুক্তিপথে তাই কবির কলম ঝলসে উঠেছে বারবার।