মমতার সংসার

শাহানাজ শিউলী
শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে রেণুর। মমতা রাগের স্বরে বলল,”কিরে মুখপুড়ি এই গরমে কোথায় গিয়েছিলি? জামা ভর্তি ছোট ছোট আমের কুশি দেখালো রেণু। মমতা বলল,”এগুলো কি করবি? রেনু উত্তর দিল,”ঝাল আর সরিষা বাটা দিয়ে মাখিয়ে খাব। আর বাকিগুলো তুমি ডাল দিয়ে রান্না করবে।। মমতা বলল, এ ছাড়া আর কি খাওয়াতে পারি আমি তোদের? সেইতো আলু আর ডাল। কতটা মাস গেল—- এক টুকরা মাছ, মাংসের মুখ দেখাতে পারলাম না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হাঁসফাঁস করে মমতার জীবন। স্বামীর মৃত্যুর পর মমতার সংসার খুব কষ্টে চলে। মেয়ে দুটোকে নিয়ে সে অসহায় হয়ে পড়ে। ছোট্ট মেয়ে বেনু গর্ভে থাকা অবস্থায় স্বামী চলে গেলেন ওপারে। সেই থেকেই মমতার সংগ্রাম জীবন শুরু। বড় মেয়ে রেণু ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ে। বেণুর বয়স দুই বছর। মমতাকে দেখে আহাজারি করার লোকের অভাব নেই। কিন্তু বাস্তবতা অনেক নির্মম ও কঠিন। অভাব অনটনের সংসারে মমতা স্বামীর সাথে সুখেই ছিল। স্বামী বেঁচে থাকতে কখনো বুঝতে পারিনি সংসারের এত যন্ত্রণা। কত স্মৃতি কত কথা মনে করে সবার অগোচরে চোখের পানি ঝরতে থাকে মমতার।
এভাবে কষ্টের সাথে দিনাতিপাত করতে না করতেই জ্বরে পড়ল বিনা। মমতার দুশ্চিন্তার কোন শেষ রইল না। কি করে মেয়েকে সুস্থ করে তুলবে? কোথায় পাবে টাকা পয়সা? মমতা দর্জির কাজ করে। ঘরে বসেই পোশাক তৈরি করে যে টাকা পায় তা দিয়ে কোনরকম সংসার চলে। কিছু টাকা ধার করে বিকালে সে মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার কিছু ওষুধ দিয়ে বললো এই ওষুধগুলো খাওয়ালে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ৫ দিন চলে যাওয়ার পরেও বেনুর কোন উন্নতি হলো না। মমতার আরো দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল। কোথায় টাকা পাবে? বাবার বাড়িতেও পাওয়ার কিছু নেই। বাবার যে ছয় বিঘা জমি ছিল তিনি মারা যাওয়ার আগে দুই ভাইয়ের নামে লিখে দিয়ে যান। এক বুক অভিমানে মমতা আর বাবার বাড়ি কখনো যায়নি। মমতার একমাত্র বৃদ্ধ মাকেও ভাইয়েরা দেখাশোনা করে না। অন্য উপায় না পেয়ে মমতা ফজল সাহেবের বাসায় যায়। ফজল সাহেব পৌর মেয়র। বয়স ৫৫ -৬০ হবে। ফজল সাহেব আপাদমস্তক মমতাকে একবার দেখে নিল। মমতা দেখতে বেশ সুন্দরী। অল্প বয়সেই বিধবা হয়েছে। মমতা ফজল সাহেবকে বলল,”“ভাই সাহেব আমাকে কিছু কাজ দেবেন? আমার মেয়েটা খুবই অসুস্থ তাকে ডাক্তার দেখাতে হবে। এক অস্বাভাবিক চাহনিতে মেয়র বলল,” তুই আমার বাসায় কাজ করবি? তোকে খাওয়া পরা দেবো আর মাসে এক হাজার করে টাকা দেব। মমতা তাতে রাজি হয়ে গেল। মমতা খুব মনোযোগ দিয়ে দায়িত্বের সাথে ফজল সাহেবের বাসায় কাজ করতে লাগলো। প্রায় প্রায় ফজল সাহেব প্রয়োজনে -অপ্রয়োজনে মমতাকে ডাকে। সেদিন মমতাকে ডেকে বলল,”মমতা এই ৫০০ টাকা লও। তোমার মেয়েকে ডাক্তার দেখাও। সেদিন কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি এসে গিয়েছিল মমতার। কিন্তু তার অন্তরালে যে এত হীনমনোবৃত্তি লুকিয়ে ছিল মমতা বুঝতে পারিনি। এখন সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। পরের দিন মমতা একটু আগেই কাজ করতে বেরিয়ে গেল ফজল সাহেবের বাসায়। সে ভেবেছিল আজকে একটু তাড়াতাড়ি কাজ করে মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। সে জানতো না মেয়র সাহেবের স্ত্রী তার বাবার বাড়িতে বেড়াতে গেছে। তিনি একাই বাড়িতে আছেন। কাজ করতে করতে মমতার হঠাৎ চোখ পড়ল মেয়র সাহেবের দিকে। মমতার বুকের ভিতর ছপছপ করে উঠলো। আজ মেয়র সাহেবকে একদম আলাদা দেখাচ্ছে।। লোলুপদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মমতার দিকে। মনে হচ্ছে অনেক দিনের ক্ষুধার্ত হায়েনা শিকারের অপেক্ষায় ছিল। মমতা বলল,” সাহেব আমি তাড়াতাড়ি বাসায় যাব আজ। আমার মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব এই বলে সে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল। মেয়র সাহেব বলল,” হ্যাঁ বাসায় তো যাবেই। আমাকে এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও। মমতা পা বাড়ানোর সাহস পাচ্ছিল না। দুরু দুরু করে তার বুকটা কাঁপছিল। ফাজল সাহেবের চাহনিটা একদমই ভালো ছিল না। তবুও মনে মনে শক্ত হওয়ার চেষ্টা করছিল মমতা। সে ভাবল,না আমাকে কিছুতেই দুর্বল হলে চলবে না। আমাকে শক্তি, সাহস নিয়ে এগোতে হবে। যদি তেমন কিছু হয় আমাকেই মোকাবেলা করতে হবে। নিজেকে রক্ষা করার প্রস্তুতি হিসেবে মেয়র সাহেবের টেবিলের উপর থেকে একটা কলম নিয়ে পিছনে রাখল এবং পানি আনতে গেল। মমতা পানি দিতে গেলে মেয়র সাহেব মমতার হাতটি টেনে ধরল। মমতা রেগে বলল, আরে এ কি করছেন? হাত ছাড়ুন। কিন্তু ফজল সাহেব কোন কথাই কর্ণপাত করলো না। তারপর মমতাকে জাপটে ধরল। মমতা কৌশলী এবং বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে বাহুডোর থেকে নিজেকে মুক্ত করে কলমটা চোখের ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। মেয়র সাহেব মাগো বাবা গো বলে চিৎকার করে উঠল। মমতা হাঁপাতে হাপাঁতে বাসায় ফিরে তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। মেয়ে দুটোকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল।
মমতার আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ল। স্বামীর মৃত্যুর সাথে সাথে এই বিশাল আকাশটাও যেন তার কাছ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।