শুক্রবার ০১ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

জীবনঘুড়ির আকাশ দেখা

সাজজাদ হোসাইন খান

দশটার আগেই এসে পৌঁছলাম স্কুলে, পরদিন। নবকুমারে তখন আনন্দের ফোয়ারা। ছাত্ররা ড্রাম বাজাচ্ছে। হৈ চৈ তো আছেই। স্যাররাও খুশির দোকানের দোকান্দার। হামিদ স্যার  হেডস্যারের কামরায় আড্ডায় ব্যস্ত। মাঝেমধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে আনন্দের দমকা বাতাস। দরজার বাইরে। খুশি যেনো থামতেই চাচ্ছে না। ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে এক দেয়াল থেকে অন্য দেয়ালে। এরই মধ্যে ইলিয়াসের ঘণ্টা। আনন্দের সুতায় টান পড়লো। ক্লাসে ঢুকতেই দেখি হালিম আর মুহিবুর আমার অপেক্ষায়। লীনুও এগিয়ে এলো। চারজনের আলাপ জমতে না জমতেই স্যার হাজির। আহমদ স্যার, বাংলা পড়ান। চেহারায় ঝুলে আছে- খুশির টসটসে আঙুর। স্যার বললেন আজ কোনো পড়া নয়। কেবলি কথা-গল্প। তখন ক্লাসসুদ্ধ সবার  চোখে হাসির ঝিলিক। স্বস্তির শীতল বাতাস। এরই মধ্যে ইলিয়াস আর মোতালেব বালতি নিয়ে ঢুকলো ক্লাসে। খয়েরী রঙের ঠোঙায় ভর্তি। টিফিনতো আসে সেই দুপুরে। আমি আর হালিম চোখে চোখ রাখি। সে চোখে জিজ্ঞাসার চিহ্ন। তখনি স্যার জানালেন  হেডস্যার আমাদের সবাইকে মিষ্টি মুখ করাবেন। এ মিষ্টি নবকুমারের ফুটবল বিজয়ের মিষ্টি। এই খবরে ক্লাসজুড়ে খুশির বেলিফুল মৌ মৌ। একটি করে ঠোঙা জনে জনে। ঠোঙা ছিঁড়তেই দেখি রসোগোল্লা, একটি আমিত্তি আর একখানা নিমকি। কি মজা কি মজা। দুপুরের আগেই নাস্তা। টিফিন। দরজার অন্যপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো আরো একটি খবর। সেই খবরের পোটলায় ছুটির ঘণ্টা। খুশির ঘণ্টা। ফুটবল বিজয়ের আনন্দে আগামীকাল ছুটি ঘোষণা করেছেন  হেডস্যার। আনন্দ আর খুশিতে যেনো ঠাসাঠাসি। সারা নবকুমার। 

খুশির প্রজাপতি উড়ছে স্কুলের ভিতরে-বাইরে। ঝকমকে রোদ স্বপ্নের বাতাসে মাখামাখি নবকুমারের মাথা চোখ। এমন দিনে দীনুর দেখা নেই।  নেই কেন? সেও তো ভালো ফুটবল খেলে। বলতে গেলে ভালোদের পহেলা কাতারে। শুকতারা ক্লাবের গোলকিপার।  তাইতো। নবকুমার টিমেও সে নেই। ব্যাপার কী! চিন্তার মগজে উঁইপোকার দৌড়ঝাঁপ।

লিনুকে জিজ্ঞেস করতে জানালো সে অসুস্থ কদিন থেকে। তাছাড়া দীনুর সাথে ফুটবলের আড়ি। আড়ি কেন? বল আটকাতে গিয়ে পাঁজড়ে চোট লেগেছে। গত বছর। এরপর থেকেই ফুটবল এখন স্বপ্ন। দীনুর ব্যথাটা যেনো আমার অন্তরের মাঠে এসে ধপাস। চোখে পানি আসে আসে। হালিম মুহিবুররাও আফসোসের পুকুরে হাবুডুবু। 

লীনুরা থাকে আমাদের এলাকায়। পীরজঙ্গি মাজারের উল্টা পারে। রেল কলোনীর শেষ মাথায়। একটা দোতলা দালানের নিচ তলায়। আমরা উঠেছি পোস্টঅফিস স্কুলের লাগোয়া দালানে। তাই হাঁটাপথে তিন-চার মিনিটের পথ। লিনুই একদিন আমাকে নিয়ে গেলো তাদের বাসায়। ওরা গানবাজনা করে। ওর ছোট বোনও রেডিওর শিশুদের অনুষ্ঠানে গানটান গায়।  প্রতি রোববার। লিনুও থাকে মাঝেমধ্যে। আমি আর লিনু আড্ডা দিচ্ছিলাম ওদের নতুন বাসার মাঠে। কমলাপুর বাসাবোর মাঝবরাবর ছিল সে বাসা। এদিক সেদিক গেছে রেললাইন। কদিন আগেই লিনুরা উঠেছে এই নতুন বাসায়।  একটি ছোট্ট মেয়ে ডাকতে এলো লিনুকে। একটু বাদে। বলল মা ডাকছে। গাড়ির বাঁশি ঝকঝক আওয়াজ বাতাসে     সাঁতার কাটে। এসবের কোনো কমতি নেই। কি রাত কি দিনে। লিনুরা কি করে ঘুমায় এখানে। ভাবনার রাজ্যে পথ হারিয়ে ঘুরছি। ঠিক তখনি লিনু জানালো এর নামই শিমুল। শিমুল বিল্লাহ। ঐ যে রেডিওতে গানটান করে। মনে হলো থ্রি- ফোরে পড়ে হয়তোবা। লিনু আর আমার আড্ডার ইতি ঘটলো তখনি। পশ্চিম আকাশের কিনার বেয়ে নামছে আলতা চুবানো উড়না। আকাশে উড়াল পাখি। ওরাও  ঘরে ফিরছে কি? পাখার ঝাপটানি। চোখ ঝিলমিল। আমিও ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। 

সূর্য উঠছে, সূর্য যাচ্ছে। আকাশ জুড়ে তারার হাসি। মিটমিট। স্কুল আর বাসা। বাসা আর স্কুল। মাঝদুপুরে  কড়ইতলার আড্ডা। বাতাসে উড়ছে সময়ের কাগজ। সাথে বইয়ের পৃষ্ঠাও। যে পৃষ্ঠায় গল্প আর কবিতার ভাবনা। ঘুমঘুম। (চলবে)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ