গোধূলি এবং বাঘ ছানার বন্ধুত্ব

শ্যামল বণিক অঞ্জন
রহিম মিয়ার পোষা রাম ছাগলের বাচ্চাটা দেখতে খুবই সুন্দর! একবার দেখলেই যেন মন ভরে যায়, মায়া বসে যায় ওর উপর! সাদা কালো তুলতুলে পশমে ঢাকা শরীর, লম্বা দুটো কান, টিংটিঙে পা অদ্ভুত সৌন্দর্যে গড়া এই ছাগল ছানাটি ! খুব চঞ্চল প্রকৃতির ছাগল ছানাটি, থেকে থেকে তিড়িংবিড়িং করে লাফায়। রহিম মিয়া ওর চমৎকার একটা নামও দিয়েছেন! গোধূলি!
গোধূলিকে রহিম মিয়া যেন সন্তান স্নেহেই লালন পালন করার চেষ্টা করছেন, রোজ দুই বেলা নিজের হাতে ফিডার ভরা দুধ খাইয়ে দেন গোধূলিকে, কোলে নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরাঘুরিও করেন! গোধূলিও যেন নিজের মালিককে পিতার মতোই ভরসার স্থল মনে করে। একটু ভয় পেলেই দৌড়ে এসে রহিম মিয়ার কোলে উঠার চেষ্টা করে, কাছে এসে লুকাতে চেষ্টা করে।
বয়স অল্প হলেও ভীষণ চালাক গোধূলি! ভাবেসাবে মনে হয় রহিম মিয়ার সকল কথাই যেন ও বুঝতে পারে। গোধূলি গোধূলি বলে ডাক দিলেই দৌড়ে চলে আসে রহিম মিয়ার কাছে! আরো অনেক অনেক কথাও গোধূলি খুব ভালো করেই বুঝতে পারে!
এভাবেই রহিম মিয়ার ঘরে তার পরম আদর যতেœ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে গোধূলি। নিজে নিজে খাবার খেতেও শিখে গেছে। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে মনের সুখে কচি কচি ঘাস লতাপাতা খেয়ে বেড়ায়। প্রতিদিনের মতো সেদিনও গোধূলি ঘুরে ঘুরে খাবার খাচ্ছিলো, হাঁটতে হাঁটতে কখন যে বনের গভীরে চলে এসেছে সেটা একটু বুঝতে পারেনি গোধূলি! এমন সময় আকাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার করে শুরু হয় প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে গোধূলি! এরকম অবস্থায় কি করবে সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলো না সে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। গোধূলি ঠিক করলো রাতটা কোন একটা উঁচু গাছে উঠে কোন রকমে পার করে দেওয়ার! যে ভাবনা সেই কাজ, গোধূলি এবার বনের মধ্যে সব থেকে উঁচু গাছটার সন্ধানে হাঁটা আরম্ভ করলো এবং এক সময় পেয়েও গেলো! এদিকে রহিম মিয়া তাঁর আদরের গোধূলিকে খুঁজে না পেয়ে তো অস্থীর হয়ে উঠলো! ঝড় বৃষ্টি থেমে যাবার পর থেকেই গোধূলি গোধূলি বলে উচ্চস্বরে ডাকতে লাগলো, কিন্তু কোন সাড়া পেলো না। অনেকেই জিজ্ঞেস করলো- তোমরা কি আমার গোধূলিরে দ্যাখছো? সকলেরই সেই এক কথা -- না, দেহি নাই।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে কাঁদতে লাগলো রহিম মিয়া।
এমন সময় ওখান দিয়ে এক লাকড়ি কুড়ানো বুড়ি মা হেঁটে যাচ্ছিলেন। রহিম মিয়ার এরকম কান্না দেখে থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন-- তুমার কি অইছে বাবা? এই রহম কইরা কানতাছো ক্যা? তুমার কি কেউ মরছে নাহি?
রহিম মিয়া কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো- আরে নাহ্ কেউ মরে নাই,আমার আদরের গোধূলিরে পাইতাছি না, কোথায় জানি হারাইয়া গ্যাছে!
বুড়ি মা বললেন-অহ্ তুমার মাইয়া হারাইছে? কও কি বাপু! তা হের বয়স কতো?
রহিম উত্তেজিত হয়ে বললো- আরে ধুর! গোধূলি আমার মাইয়া না আমার পোষা ছাগল। বুড়ি বিস্মিত হয়ে বললেন - ছাগলের নামও আবার গোধূলি অয় নাহি? আর হের লাইগাও এমুন কান্দা! তা বাপু তুমার ছাগলটা দ্যাখতে কেমুন?
রহিম মিয়া বললো, সাদা কালো মিশাইন্না রঙের,কান দুইডা লম্বা।
তুমি কি দ্যাখছো হেরে?
বুড়ি মা বললেন, আমি এই রহম একটা ছাগল অনেকক্ষণ আগে দ্যাখছিলাম অই জঙ্গলে মাইদ্যে যাইতে।
চিন্তা কইরো না বাবা পাইবা, ঠিকই পাইবা! বলতে বলতে বুড়ি মা হাঁটা শুরু করলেন, রহিম মিয়াও তার বাড়ি ফিরে গেলেন।
বনের ভেতর উঁচু একটা গাছে আশ্রয় নিলো গোধূলি! রাত গভীর হতে লাগলো, সাথে চারদিকে অন্ধকার নেমে এলো। সারাদিনের ধকলে ভীষণ ক্লান্ত গোধূলিও ঘুমিয়ে পড়লো গাছের উপরেই।
হঠাৎ একটা হুঙ্কারের শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙে গেলো তার। চোখ মেলে দেখলো নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাঘের ছানা। গোধূলি মনে মনে কিছুটা ভয় পেলেও পরক্ষণেই আবার নিজের বুদ্ধিতে শাণ দিতে লাগলো। মনে মনে বাঁচার কৌশলও নির্ধারণ করে রাখলো। আর এদিকে তো বাঘের ছানাটি হুঙ্কার দিয়েই যাচ্ছে! বলতে লাগলো, কেরে ওখানে? ওখানে কে?
এ্যাই কথা বলছিস না কেন? কে ওখানে?
আতঙ্কিত না হয়ে গোধূলি সাবলীল ভাবেই জবাব দিলো: আমি গো,আমি! আমি রাম ছাগল ছানা নাম গোধূলি। বাঘের ছানা কিছুটা হেসে--- হা হা হা,
ছাগলের নাম আবার গোধূলি হয় নাকি?
গোধূলি বললো, হয়, রাখলেই হয়, যেমন আমারটা হয়েছে! আমার মালিক রেখেছেন।
বাঘের ছানা বললো, তা তুই এতো রাতে এখানে কি করসিছ, তোর ভয় করছে না? নিচে নেমে আয়, আয় বলছি। গোধূলি মোটেও নিজের প্রাণের মায়া না করে সাথে সাথে নিচে নেমে এলো। বাঘের ছানা গোধূলির সৌন্দর্যে যেন মুগ্ধ হয়ে গেলো! ভিতরে ভিতরে মায়া অনুভব করলো। নরম সুরে বললো, এখন বল, এখানে কিভাবে এলি? গোধূলি বললো আসলে আমি প্রতিদিন ঘুরে ঘুরে কচি ঘাসপাতা খাই, আজো প্রতিদিনের মতোই খাবার খেতে বের হই, কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে কখন যে জঙ্গলের এতো ভিতরে চলে এসেছি সেটা টেরই পাইনি! আর তার উপর আবার শুরু হয়ে গেলো ঝড় বৃষ্টি! কোন উপায়ান্ত না দেখে নিরাপদে রাতটা কাটিয়ে দেওয়ার জন্য অবশেষে এই উঁচু গাছটিতেই আশ্রয় নেই! গোধূলির কথাগুলো শুনে বাঘ ছানার ভীষণ মায়া হলো। বললো, কিছু যদি মনে না করো তাহলে একটা কথা বলতে চাই! গোধূলি বললো, না না ঠিক আছে বলো।
বাঘছানা বললো আমি তোমার বন্ধু হতে চাই! গোধূলি পুলকিত মনে বললো এটা তো খুব ভালো কথা! বাঘের ছানা বললো যদি সত্যিই আমাকে বন্ধু ভেবে থাকো তাহলে আরো একটা কথা বলবো শুনবে কি? গোধূলি বললো- নির্দিধায় বলে ফেলো বন্ধু। এখানে থাকাটা তোমার জন্য মোটেও নিরাপদ নয়, তাই আমি বলছিলাম কি আজকের রাতটা যদি আমাদের গুহায় গিয়ে থাকতে, তাহলে তোমার জন্যই বেশ ভালো হতো। বাঘছানার মুখ থেকে এরকম কথা শুনে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো গোধূলি। খুশি হয়ে বললো, এতে আপত্তির কি আছে! অবশ্যই যাবো তোমাদের ঘরে! গোধূলি বললো, তোমাদের ঘরে আর কে কে আছে বন্ধু? বাঘছানা বললো, আমার ঘরে কেবল আমার মা-ই আছেন। গোধূলি বললো, তোমার বাবা নেই? বাঘছানা বিমর্ষ হয়ে জানালো, নাহ্! আমার বাবা নেই। মায়ের কাছে শুনেছি আমার জন্মের পরেই নাকি শিকারীদের গুলিতে আমার বাবা প্রাণ হারান, কথাগুলো বলতে বলতে বাঘ ছানার দুচোখ জলে ভিজে গেলো। গোধূলি প্রসঙ্গ পাল্টে বললো- কি হলো! চলো এবার যাওয়া যাক।
বাঘছানা বললো- হ্যাঁ চলো তবে যাওয়া যাক। হাঁটতে হাঁটতে নানান রকম গল্পগুজব করতে করতে ওরা পৌছে গেলো গুহার কাছে। কারো পায়ের খচখচ আওয়াজ শুনে গুহার ভিতর থেকে বাঘ ছানার মা বললো, কেরে? খোকা এলি নাকি? বাঘছানা বললো, হ্যাঁ মা! তবে আমি একা আসিনি বলতে বলতে ওরা দুজন গুহার মধ্যে ঢুকে গেলো! এই দ্যাখো মা সাথে কাকে নিয়ে এসেছি। গোধূলির সৌন্দর্যে এবার মা বাঘিনীটিও বিস্মিত হলো, বললো ও মা কি সুন্দর মিষ্টি চেহারা গো তোমার মা! তা মেয়েটি কে বাবা? ওকে কোথায় পেলি। বাঘ ছানা বললো, সব বলছি তোমাকে, তার আগে আমাদের জন্য জলদি খাবারের ব্যবস্থা করো। মা বললেন, ঠিক আছে আমি তোদের খাবারের ব্যবস্থা করছি। খেতে খেতে সকল কথাই মাকে খুলে বললো।
পরম মমতায় বুকের কাছে আগলে রেখে রাত কাটালো বাঘিনী মা। সকাল হতেই ছেলেকে বললোথ যা এবার ওকে নিরাপদে ওর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়। মায়ের কথা মতো ওরা বেরিয়ে পড়লো গোধূলির বাড়ির উদ্দেশ্যে।