অবসান

হাসান রুহুল
পি.....পু....। ঘ্যার ঘ্যার ক্যারকেরি শব্দ। অস্পষ্ট গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। হাঁসের মতো স্যাঁতস্যাঁতে কষ্ঠস্বর। কণ্ঠতে বিষন্নতায় ভরা। অবশেষে আমরা হাঁটতে হাঁটতে মাইকের আওয়াজের নিকটে চলে এলাম।
নীরব স্তব্ধ চারপাশ। হালকা শীতের ¯িœগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিক। হেমন্তের সকাল। চাষিরা ফজরের আযানের সাথে সাথে ঘুম থেকে জেগে উঠে। খুব সকালেই জমি থেকে সব্জি সংগ্রহ করছে। ফুল কপি, বাঁধা কপি, লাল শাক, পালং শাক, মিষ্টি কুমড়া, টমেটো, বেগুন, মুলা, লাউ ইত্যাদি তুলে করতোয়া নদীতে ধুয়ে পরিষ্কার করছে। কেউ আবার আগেই রেডি করে বান্নি মেলার ব্রীজের পূর্ব পাশে অশ^থ বটের গাছের নিচে এনে অপেক্ষা করছে। এখানেই ঠিক সময়ে অটো চলে আসে। সেই অটোতে করে চাষিরা সব্জি নিয়ে যায় শহরের রাজাবাজার পাইকারি হাটে। রেল লাইনের উত্তর পাশ দিয়ে গড়ে ওঠা এই রাজাবাজার। পুরান ঢাকার মতো ঘিঞ্জি পরিবেশ হলেও সারা শহরের সব্জির চাহিদা যোগান দেয় এই রাজাবার হাট।
হাঁটতে বের হলেই অনেক পরিচিতজনের সাথে সাক্ষাত ঘটে। হাঁটার তালে তালে চলে কথা। পুরাতন কথা। নতুন কথা। নিত্যদিনের ঘটনার কথা। পত্রিকার হেডলাইন কী কী ছিল, সেই কথা। টেলিভিশনের টপ নিউজের কথা। নিজ অফিসের কথা। কত যে অজানা কথা গল্পের মাঝে এসে হাজির হয় অজান্তেই। সেই কথার শুরু আছে শেষ নেই।
হায়রে মানুষের বেঁচে থাকার কত চেষ্টা! নিজেকে ফিট রাখার কত কসরত। সকালের মধুময় আরামের ঘুম বিসর্জন দিয়ে হাঁটতে বের হওয়া কষ্টকর। তবুও নশ^র দুনিয়ায় একটু বেশি সময় সুস্থ থাকার চেষ্টা। মানে আরো কিছুদিন পৃথিবীতে টিকে থাকার বাহানা।
ফজরের পর হাঁটাহাঁটি এখন আমার নিত্যদিনে কাজ। তবে এই কাজকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে আমার স্ত্রী। আমার মতো এলোমেলো অগোছালো একজন মানুষকে সে নিয়মের রেল লাইনে তুলেছে। স্বাস্থ্য সচেতন গোছালো একজন ধন্যময় মানুষ সে।
বাসা থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে বের হই। ফুলবাড়ি বায়তুস শরফ মসজিদ থেকে নামায পড়েই দশ বারো জন এক সাথে হাঁটা শুরু করি। কখনো দৌড়। কখনো আবার লম্ফ-ঝম্ফ। কখনো শারীরিক কসরত। সরকার পাড়ার পূর্ব পাশ দিয়ে সোজা চলে আসি নদীর পাশে। নদীর তীরের আবহাওয়া অতিব নির্মল। ঝিরি ঝিরি বাতাস দেহে পরশ বুলে যায়। ভালো লাগার আমেজে শরীর শিহরিত হয়ে উঠে। মনে বিরাজ করে ফুরফুরে সতেজতা। মনের এই ফুরফুরা ভাবটা শরীরে জন্য বেশ উপকার।
ধান কাটা শুরু হয়নি এখনো। সোনালি ধানে ভরে গেছে দিগন্ত জোড়া মাঠ। হালকা কুয়াশা মুক্তার দানা হয়ে দুলছে ধানের শীষের মাথায় মাথায়। আহ! কী নয়নাভিরাম দৃশ্য। করতোয়া নদীর উপর নির্মিত বান্নি মেলার নান্দনিক ব্রীজ। এই দৃশ্যগুলো দেখলেই মন হারিয়ে যায় ছোটবেলার বাংলা বই, সমাজ বই আর কৃষি শিক্ষা বইর পাতায়। মনে হয় আমি এখনো সেই বাড়ন্ত কিশোরই রয়ে গেছি।
ব্রীজ পার হয়ে ঈসিদহ প্রাইমারি স্কুলের পাশ দিয়ে ঘেষে যাওয়া রাস্তার তিনমাথা মোড়ে এসেছি মাত্র তখনই মসজিদের মাইকের তরঙ্গ নির্ভর আওয়াজ ঠিক হয়ে গেল।
“আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় এলাকাবাসী। একটি শোক সংবাদ শুনুন, একটি শোক সংবাদ।” ‘শোক সংবাদ’ এই শব্দ দুটি শুনলেই মনোযোগী হয়ে কান পেতে থাকি মাইক থেকে ভেসে আসা শব্দের দিকে। কিন্তু আজ কেমন যেন হৃদপি- নাড়া দিয়ে উঠলো। বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে গেল। মনটা বিষাদে ছেয়ে গেলে। হাঁটার গতি কমতে কমতে থেমে যাচ্ছে। যাদের সাথে হাঁটতেছি তারা দূরে চলে গেছে। কখন যে আমি তাদের পিছনে পড়ে গেছি বুঝতে পারিনি। মনের অজান্তেই এতো কিছু ঘটে যাচ্ছে। দ্ইু পা ভারি হয়ে যাচ্ছে। পাথরের মতো ভারি। একটু আগেই কত সহজভাবে দৌড়ে এলাম। লাফা-লাফি করলাম সেই পা আর নড়াতে পারছি না। ইলেকট্রিক থাম্বা হয়ে দুই পা মাটির ভেতর গেড়ে গেছে। অনেক কষ্টে স্কুলের বারান্দায় এলাম। আমি হাঁটা বন্ধ করে থামলাম। অবশেষে ঈসিদহ স্কুল বারান্দায় বসলাম।
মনের ভেতর তোলপাড় করছে। ঘোষণাটি চির চেনা। তবু আজ হৃদয় ভিজে গেলো। ভিজায়িত পানি জলীয় বাষ্প হয়ে শিশিরের মতো টপ টপ করে চোখ থেকে বেয়ে ঝরছে অবিরাম। সারা শরীর অবশ হয়ে গেলো।
বেশিরভাগ সময় বৃহস্পতিবার অফিস ছুটির পরে বন্ধুদের সাথে সময় কাটাই। পরের দিন শুক্রবার, অফিস ছুটি, তাই হাতে একটু সময় পাওয়া যায়। পার্স থেকে মোবাইল বের করে কল দিলাম মাজেদকে। কল রিসিভ করতেছে না। আবার কল দিলাম। মোবাইলে রিং হইতেছে। রিংগিং এর শেষ সময়ে মাজেদ কল রিসিভ করলো।
- আসসালামু আলাইকুম বন্ধু কি করো?
- ওয়ালাইকুম সালাম বন্ধু, আমি ফুলের ঘ্রাণ নিতেছি।
- নিশ্চয় হাসনাহেনার ঘ্রাণ প্রিয় মাজেদ বন্ধু আমার?
- তুমি তো জানো বন্ধু, হাসনাহেনার ঘ্রাণ আমার খুব প্রিয়। সন্ধ্যায় বাসার ছাদবাগানের পাশে চেয়ারে হেলান দিয়ে হাসনাহেনার ঘ্রাণ নেই। সাথে তোমার ভাবীর হাতে বানানো চা। হাসনাহেনার ঘ্রাণ আর এক মগ চা এই দুটোর কম্বিনেশনে অসাধারণ আনন্দময় সময় কাটে। বলো বন্ধু কী জন্যে ফোন দিলে?
- চলে আসো কাফেলায় ছয়টায়।
- ঠিক আছে বন্ধু একটু ওয়েট করো আসতেছি।
- আমি জানি মাজেদের কাছে ছয়টা মানে পাঁচটা ঊনষাট। ওর সব কাজ চলাফেরা ঠিক ঠিক সময়মতো।
কাফেলা বগুড়া শহরের নামি দামি কোন রেস্টুরেন্ট নয়। সাদামাটা একটা রেস্টুরেন্ট। শহিদ খোকন পার্কের পশ্চিম পাশে ফুলের মার্কেটের সামান দিয়ে সোজা উত্তর দিকে যে নবাব বাজার রোড চলে গেছে সেই রোডের পূর্ব পাশে কাফেলা রেস্টুরেন্টের অবস্থান। মানে পিডিবি অফিসের পাশে। আধাপাকা বড় সরো একটি ঘর। বাহিরে দেখতে ভালো না হলেও রেস্টুরেন্টের ভিতরে ছিমছাম পরিষ্কার। মালিকটা ভালো। কর্মচারীরা আন্তরিক। তাই এই কাফেলার মায়ায় এখানে চলে আসি। বন্ধুদের সাথে
আড্ডা দেই।
মাজেদ এসেই বলে বন্ধু কী জন্য তলব? বলছি বলে আমার কথা শুরু করি। শিল্পআলো লিটল ম্যাগাজিনের একুশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যা নিয়ে কথা বললাম। মাজেদ ভালো আইডিয়া দেয়। দেশ ও রাজনীতি সচেতন মানুষ। প-িত মানুষ। সরকারি আযিযুল হক কলেজের ফিলোসফি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। চমৎকার পড়ায়। এখনো সিরিয়াস স্টাডিয়াস।
শিক্ষা বিস্তারের নিবেদিত মানুষ। ওর জন্মই মনে হয় শিক্ষাদানের জন্য। বয়স তো খুব বেশি নয়। চল্লিশের ঘরে পা দিতে আরো দুই বছর গুনতে হবে। আমরা তেত্রিশতম বিসিএসে অনার্স এ্যাপিয়ার্ড দিয়ে পরীক্ষা দেই। মাজেদের সৌভাগ্য, বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হয় এবং একই কলেজে প্রভাষক হিসাবে জয়েন করে। মজার ব্যাপার হলো প্রভাষক হয়ে ঐ কলেজেই মাস্টার্স পরীক্ষার ভাইভা দেয়। অর্থাৎ সবই সরকারি আযিযুল হক কলেজেই।
চায়ের ওয়ার্ডার দিতেই মাজেদ বলে ‘চায়ে মালাই ধরে দিও মামা’ বন্ধুর কমন চাওয়া। মাত্র রাতের ব্যবধানে, আজ সকালে সেই প্রিয় বন্ধু মাজেদুর এখন লাশ।