কবি শামসুর রাহমানের কবিতা প্রকরণ

আহমদ মতিউর রহমান
বাংলা কবিতার ঐতিহাসিক পরিক্রমায় অনন্য সাধারণ এক জন কবি শামসুর রাহমান। কি বিষয় বিভায় কি কাব্য প্রকরণে তিনি দ্যুতিময়। তিনি কবিতায় সমসাময়িক বিষয়কে এনেছেন নানা প্রতীকের আশ্রয়ে। তিনি মনের কথা গোপন রাখেননি। তিনি উদ্ভাসিত করেছেন পাঠককে, কখনো বা নৈরাশ্যের আঁধারে ডুবিয়েছেন। তাকে বলা হয় ‘বাংলা কবিতার শুদ্ধতম ধারার গর্বিত উত্তরাধিকার।’ তিনি বাংলা কবিতার পথ-পরিক্রমায় তিরিশের আধুনিকতা পেরিয়ে চল্লিশের অভিনবত্বে স্নাত হয়ে পঞ্চাশের দশকের বাতাবরণে নিজেকে নির্মাণ করেছেন একজন স্বতন্ত্র কবিকন্ঠ হিসেবে। এই যাত্রায় তিনি আমাদের আরেক জন বড় কবি আল মাহমুদের সহযাত্রী। তবে আল মাহমুদের কবিতায় লোকজ উপাদান, পল্লী বাংলা যেভাবে এসেছে, শামসুর রাহমান সে পথে হাঁটেননি। কারণ তিনি ‘নাগরিক কবি’। কবি শামসুর রাহমান তার কবিতায় উপমা উৎপ্রেক্ষাসহ নানান রসের ব্যবহার করেছেন কবিতার বাক নির্মিতির প্রয়োজনানুসারে। তিনি ব্যবহার করেছেন নানা প্রতীক। তার কবিতায় আছে বীর বসের ব্যবহার। তিনি ইউরোপীয় মিথের যথেচ্ছ ব্যবহার যেমন করেছেন তেমনি প্রাচ্যের পুরাণ ও প্রতীকও ব্যবহার করেছেন।
শামসুর রাহমানের জন্ম ২৩ অক্টোবর, ১৯২৯। অল্প সময়ের ভেতরেই দুই বাংলায় ( তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম বাংলায়) কবি হিসেবে পরিচিতি পান। কলকাতায় কবি বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় ‘রূপালি স্নান’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে কবি হিসেবে শামসুর রাহমান সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন । পরবর্তীতে উভয় বাংলাতেই তার শ্রেষ্ঠত্ব এবং জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি নাগরিক কবি হিসেবে খ্যাত, তবে নিসর্গ তার কবিতায় খুব কম ছিল না। তিনি ১৭ আগস্ট, ২০০৬ সালে ইন্তিকাল করেন। তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৭০ টি।
শুদ্ধ ধারার কাব্যচর্চায় নিয়োজিত শামসুর রাহমান এক সময় মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাচেতনায় বা ব্যক্তি নির্ভর অভিজ্ঞতা ও আবেগের উচ্চারণে আবদ্ধ ছিলেন। নাগরিক কবি হিসেবে আমরা তাকে পাই তখন। এই কাব্য সংলগ্নতা থেকে বের হয়ে তিনি হয়ে ওঠেন পুরাণ নির্ভর। এভাবেই এসেছে ইউরোপীয় পুরাণ। পরিবেশ- প্রতিবেশ ও পৃথিবীর সাথে নিজেকে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করায় তার কবিতা বিষয়- বৈচিত্রে সমৃদ্ধ হয়ে আত্মমগ্নতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে সমাজমুখী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে তিনি কবিতায় বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের ইতিকথা অত্যন্ত মমতার সাথে কবিতায় উপস্থাপন করেছেন। তার কাব্যভা-ারে সঞ্চিত হয়েছে যুদ্ধের ক্ষতি-ধ্বংস, মন্বন্তর কবলিত মানুষের আর্তনাদ-ক্রন্দনধ্বনি, দেশ-বিভাজনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। ভাষা-আন্দোলন ও ঊনসত্তরের শহীদদের কথাও পাই। বেশি করে পাই স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালির স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের দুঃষহ যন্ত্রণা, প্রত্যাশা ও অচরিতার্থতার বেদনা। শামসুর রাহমানের কাব্য-ভুবন নির্মিত হয়েছে এসব পরিবর্তিত বাস্তবতায়। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে অস্থির রাজনীতি, নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়ের অন্তরালে তিনি নির্মাণ করেছেন আশাবাদী কাব্য-প্রকরণ।
তার কবিতায় প্রাচ্য-প্রতীচ্যের পুরাণের ব্যবহার থাকলেও তিনি পাশ্চাত্য তথা গ্রীক পুরাণের ব্যবহারে অধিকতর আগ্রহী ছিলেন। নিঃসঙ্গ শেরপা গ্রন্থে ড. হুমায়ুন আজাদ দেশাত্মবোধক কবিতা হিসেবে শামসুর রাহমানের টেলেমেকাস কবিতাটিকে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। কালের সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এভাবেই কবি শামসুর রাহমান বীরের কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেছেন। নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থের ‘টেলেমেকাস’ কবিতায় অসাধারণভাবে গ্রীক পুরাণের সাথে সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যমলা বাংলার জনগণের সংগ্রামকে প্রতীকায়িত করেছেন। এ কবিতায় অবরুদ্ধ ও সংক্ষুব্ধ বাংলার চিত্র ফুটে উঠেছে। সমকালীন বাংলাদেশের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির উজ্জ্বল স্বাক্ষর রয়েছে।
বীর-বন্দনার এই রীতি শামসুর রাহমান সম্ভবত চল্লিশের কবি ফররুখ আহমদের (১৯১৮-’৭৪) কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন বলে অনেকে অভিমত দিয়েছেন। যদিও একটি অভিঘাতের মধ্য দিয়ে গেছে সময়টি, কিন্তু শামসুর রাহমান তার পূর্বসূরীকে বিস্মৃত হননি। আমাদের একজন প্রধান কবি ফররুখ আহমদ একটি বিশেষ জাতির পুনরুজ্জীবন কামনা করলেও উপকথার ‘সিন্দবাদ’কে তিনি যেভাবে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার আকুল আহ্বান জানিয়েছেন শামসুর রাহমানও গ্রীক পুরাণের অডিউসকে আহ্বান করেছেন তেমনিভাবে। যেমন -
রয়েছি দাঁড়িয়ে
দরজা আগলে, পিতা, অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়।
এখনো কি ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্তুল তোমার
বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ুধ
আবার অভিজ্ঞ হাতে? তুলবে না ধনুকে টঙ্কার? [টেলেমেকাস, নিরালোকে দিব্যরথ]
ফররুখের সাথে শামসুর রাহমানের বীর-বন্দনার সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয় Ñ
তুমি জাগো, কখন সকালে ঝরেছে হাসনাহেনা
এখনো তোমার ঘুম ভাঙলো না? তবু, তুমি জাগলে না?
দুয়ারে সাপের গর্জন শোনো নাকি?
কত অসংখ্য ক্ষুধিতের সেথা ভিড়,
হে মাঝি! তোমার বেসাতি ছড়াও, শোনো,
নইলে যে সব ভেঙে হবে চৌচির। (সাত সাগরের মাঝি, সাত সাগরের মাঝি) । ‘সিন্দবাদ’ কবিতায় ফররুখ আহমদ আরো চমৎকারভাবে বলেছেন-
ভেঙে ফেলো আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ
দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাঁধ
ছিঁড়ে ফেলে আজ আয়েশী রাতের মখমল অবসাদ,
নতুন পানিতে হাল খুলে দাও হে মাঝি সিন্দবাদ। [সিন্দবাদ, সাত সাগরের মাঝি]
কবি শামসুর রাহমানের এই বীর বন্দনার সাথে ভাষাগত সাদৃশ্য রয়েছে ফররুখ আহমদের। তবে তিনি কবিতায় পুরাণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধারা অনুসরণ করেছেন।
শামসুর রাহমানে ইকারুসের আকাশ (১৯৮২) গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় পুরাণ বা মিথ ব্যবহার করা হয়েছে। ডেডেলাসের পুত্র ইকারুস আত্ম-আবিষ্কারের নেশায় এবং তারুণ্যের স্পর্ধায় মোমের পাখা নিয়ে উঁচুতে উড়তে গিয়ে প্রখর সূর্যতাপে পাখা গলে গিয়ে নির্মম মৃত্যুবরণ করেছিল। ইকারুসের এই পরিণতি শামসুর রাহমান নিজ সত্তায় অনুভব করেছেন এভাবে-
জেনেও নিয়েছি বেছে অসম্ভব উত্তপ্ত বলয়
পাখা মেলবার, যদি আমি এড়িয়ে ঝুঁকির আঁচ
নিরাপদ নিচে উড়ে উড়ে গন্তব্যে যেতাম পৌঁছে
তবে কি পেতাম এই অমরত্বময় শিহরণ? [ইকারুসের আকাশ, ইকারুসের আকাশ]
ইকারুসের তারুণ্য দীপ্ত মন এবং ট্র্যাজিক পরিণামের মধ্যে শামসুর রাহমান মূলত নিজেকে আবিষ্কার করেছেন। ‘ডেডেলাস’ কবিতায় ইকারুসের মৃত্যুর জন্য পিতা ডেডেলাস শোকার্ত হৃদয়েই পুত্রের স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেÑ
‘পরিণাম বিষয়ে কেমন
উদাসীন, ক্রূর, রৌদ্রঝলসিত, সাহসী, স্বাধীন।’ [ডেডেলাস, ইকারুসের আকাশ]
ডেডেলাসের মধ্য দিয়ে মূলত কবি শামসুর রাহমান তারুণ্যকে আহ্বান করেছে এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
সক্রেটিস ২ কবিতায় দার্শনিক সক্রেটিস হয়ে উঠেছেন কবির প্রিয় একজন Ñ
এবং সত্যের মুখ দেখেছিলেন ব’লেই তিনি,
সক্রেটিস, সয়েছেন নির্যাতন, অকাতরে পান
করেছেন হেমলক-এই আত্মাহুতির পুরাণ
চিরঞ্জীব; বিশ্বচরাচরে এভাবেই ছিনিমিনি
খেলা খেলে যুগে যুগে পরাক্রান্ত কবন্ধ সমাজ
চক্ষুষ্মানদের নিয়ে। আপোষের ক্লিন্ন যষ্ঠি হাতে
এখানে সেখানে ঘোরা কখনো ছিলো না তার ধাতে,
তাই আজো আমাদের ভাবলোকে তিনি মহারাজ। [সক্রেটিস ২ : ইকারুসের আকাশ]
শাসকের অত্যাচার-নির্যাতন যখন বাংলাদেশের জনগণের ওপর চলছিল তখন কবি স্যামসনের মতোই আশাবাদী ভূমিকা গ্রহণ করে অপেক্ষা করেছেন সুদিনের। তিনি বিশ্বাস করেন সুদিন একদিন আসবেই; এই অত্যাচার-নির্যাতনের অবসান ঘটবে, শেষ পর্যন্ত জনগণই জয়ী হবে। কবি শামসুর রাহমান নিজের বাস্তবতা চিত্রিত করেছেন বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে (১৯৭৭) কাব্যগ্রন্থের ‘নেকড়ের মুখে আফ্রোদিতি’ কবিতায়। ডায়োমিডিসের আঘাতে যেভাবে প্যারিসকে উদ্ধার করতে গিয়ে দেবী আফ্রোদিতি আহত হয়েছিলেন, কবি নিজেকেই আহত দেবী আফ্রোদিতির সমান্তরাল । যেমন-
হে নিশীথ, আজ আমি কিছুই করতে পারবো না।
আমার মগজে ফণীমনসার বন বেড়ে ওঠে,
দেখি আমি পড়ে আছি যুদ্ধধ্বস্ত পথে কী একাকী;
ভীষণ আহত আমি, নেকড়ের মুখে আফ্রোদিতি। [নেকড়ের মুখে আফ্রোদিতি, বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে]
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুপ্রেরণাদায়ী তার দুটি কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ পাঠক মহলে সমাদৃত। তার কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্য, রূপব্যঞ্জনা বর্ণনারীতি ও আধুনিক রূপায়ণ শামসুর রাহমানের কবিতাকে করে তুলেছে দ্যুতিময়, সৌন্দর্যস্নাত। যেমন-
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
----
স্বাধীনতা তুমি
কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।
স্বাধীনতা তুমি
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন। [ স্বাধীনতা তুমি, বন্দী শিবির থেকে]
কবি শামসুর রাহমান অনেক কিছুর মাঝে পিতার কোমল জায়নামাজের কথাও ভোলেন নি।
তিনি তার কবিতায় বারবার ঘোড়ার প্রতীক এনেছেন। যা কিনা সৌর্য বীর্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যে সৌর্য তার পূর্ব পুরুষের। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুথানের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘আসাদের শার্ট ’ ও একটি ভালো কবিতা।
‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।
বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালি তন্তুর সূক্ষতায়
[আসাদের শার্ট]
শামসুর রাহমান কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে নিজস্ব কাব্যরীতি ও প্রকরণ সৃজনে সার্থক হয়েছেন। যেখানে আবহমান বাংলার প্রকৃতির রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ মিলেমিশে থাকে। আধুনিক জীবনের প্রাত্যহিকতা, মোহগ্রস্ত মনোজাগতিক জটিলতা ও বিভ্রম কবি শামসুর রাহমানকে বিচলিত করে তুলেছিল। তাই তাকে দেখা যায় তিরিশের কাব্যাদর্শ বের হয়ে নতুন কাব্যকলা ও কাব্যভাষা নির্মাণ করতে। তিনি নিরন্তর কাব্য চর্চা করে গেছেন। জীবনের হেন বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি লেখেননি। তবে তিনি উপন্যাসের দিকে তেমন একটা পা বাড়াননি, যেমনটা আমরা দেখতে পাই আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দীন আল আজাদ প্রমুখ ও পশ্চিম বঙ্গের বহু কবির মধ্যে। তার কবিতাগন্ধী গদ্যের স্বাদ কি রকম, তাহলে আমরা জানতে পারতাম। এখন বিশ^ব্যাপী কবিতাময় গদ্যের জোয়ার চলছে। কবি শামসুর রাহমান সে পথে না হেঁটে কবিতাঙ্গনেই স্থিতধি হয়েছেন। আর এ কারণে তার কবিতা প্রকরণ নানা বৈশিষ্ট্য ও প্রকরণে হৃদ্ধ। এই পাওয়া বাংলা সাহিত্যের জন্য কম পাওয়া নয়।