রবিবার ১০ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

মাটি ও মানুষের কবি মোশাররফ হোসেন খান

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

 ‘পাথরে পারদ জ্বলে, জলে ভাঙে ঢেউ/ ভাঙতে ভাঙতে জানি গড়ে যাবে কেউ’- এটা পৃথিবীর অমোঘ নিয়ম। ভাঙা-গড়ায় খেলায় নিজেকে সাহসী সৈনিকের আসনে বসাতে চান প্রত্যেক মানুষ। তবুও হেরে যায় অনেকেই। অনেক কবিও হেরে যায়। শুধু হারে না স্বপ্নচোখের নিশান, বিশ্বাসী চেতনার প্রশান্ত আত্মা। কবি মোশাররফ হোসেন খান সেই সারিতেই নিজেকে খাপÑখাইয়ে নিয়েছেন। তাইতো আধুনিক বাংলা কবিতার অনন্য ধারার কবি হিসেবে স্বীকৃত কবি মোশররফ হোসেন খান। মাটি ও মানুষের কবি তিনি। তাঁর লিখনীর পরতে পরতে এদেশের মাটির কথা, মানুষের কথা, বিশ্বাসের বিপ্লবী চেতনা নদীর মতো বহমান।

জীবন সংগ্রামের অনবদ্য পঙক্তিমালাই কবিতা। তাইতো কবিতা এক ধরনের অনুপ্রেরণা। সমাজ-সংসারে ঘটে যাওয়া নানা অসংগতির বিরুদ্ধে নান্দনিক প্রতিবাদ, মহামিলনের কোমল হাওয়া। কবিকে তাড়িত করে সম্বৃত-বেগ। মনোনায়ক কবিকে লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। সেই তাড়না থেকেই জন্ম হয় কবিতার অস্থিমজ্জা। এ তাড়নায় প্রায় প্রত্যেক মানুষের মনোনায়কই আপ্লুত ও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় ভালোবাসার কোমল মৃত্তিকা কিংবা বিধ্বংসী বারুদ। তাইতো প্রকৃত কবি কখনো খুঁটিবিহীন জংলাবৃক্ষের মতো হাজার ঝড়েও নূয়ে পড়েন না। সাহসের সাথে উচ্চারণ করেন, 

‘মূলত মানুষ আমি

শতাব্দীর শীর্ষচূড়া

সীমাহীন জ্যোতির উদ্ভাস।’

[পাথরে পারদ জ্বলে]। 

কবি মোশররফ হোসেন খান একজন স্বাপ্নিক কবিপুরুষ। পৃথিবীর তাবৎ স্বপ্নকে জড়িয়ে রাখেন কবিতার ভাঁজে। প্রেম, দ্রোহ, মানবতা, ইতিহাস, ধর্মবোধ, সর্বোপরি লাল-সবুজের বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মাটি ও মানুষকে চিরায়ত স্বভাবে বুকের সাথে আগলে নেন কবিতার ভালোবাসায়। ‘হৃদয় দিয়ে আগুন’ কাব্যগ্রন্থের সূচনা কবিতাতেই তিনি সাহসের সাথে উচ্চারণ করেন, ‘আমার কবিতা পড়ে যদি কোন রমণী/ প্রসব করে বসে হিং¯্র শাবক/ যদি কোন শিকারী কৃষকের গান ভুলে/ যুদ্ধের গান গাইতে গাইতে তাক করে বসে/ পাপিষ্ঠ বুক/ তবে আমার কি দোষ?’ 

দোষের কোন কারণই নাই। কবিতা তো তাই, যা মানুষকে অধিকার আদায়ে বিপ্লবী করে তোলে। সেই বৈপ্লবিক শপথেই তার কাব্যযাত্রা। সময়ের ঘাতপ্রতিঘাত এবং মানবিক সংঘাতের ধারাবাহিকতায় নেমে আসে কবিতার ঝর্ণা। নেচে ওঠা সমুদ্র, আরাধ্য অরণ্যে, বিরল বাতাসের টানে, পাথরে পারদ জ্বলে, ক্রীতদাসের চোখ, নতুনের কবিতা, বৃষ্টি ছুঁয়েছে মনের মৃত্তিকা, দাহন বেলায়, কবিতাসমগ্র, সবুজ পৃথিবীর কম্পন, পিতার পাঠশালা, স্বপ্নের সানুদেশ’ কাব্যগ্রন্থগুলো তাঁকে পর্বে পর্বে কবিসত্তার উন্নত শিখরে তুলে এনেছে। কবিতার উপমা-উৎপ্রেক্ষা, ছন্দবিজ্ঞান, অলংকার কিংবা বিষয়ের উপযোগিতায় মোশাররফ হোসেন খান অনন্য। তারুণ্যে ঝংকার তার কবিতার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। কবিতার পরতে পরতে তিনি নতুন স্বপ্নের সুবাস ছড়িয়ে যান, এখানেই মোশাররফ হোসেন খানের কাব্যনির্মাণের সার্থকতা।

কবির হাতে কথাসাহিত্য বেমানান হয় না কখনো। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পকে এ ক্ষেত্রে উপমার স্থানে নেয়া যেতে পারে। উপমার খাতিরে কবি আল মাহমুদ, কবি আবুবকর সিদ্দিকসহ অনেকেই প্রোজ্বল হয়ে আছেন। ১৯৯০ সালে প্রচ্ছন্ন মানবী প্রকাশের মধ্যদিয়ে কথাসাহিত্যে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন কবি মোশাররফ হোসেন খান। কবি থেকে পরিচিত হন গল্পকার হিসেবে। মাত্র চার বছর পরে ১৯৯৪ সালে পাঠকের হাতে ধরা দেয় সময় ও সাম্পান। এখানে তার কথাসাহিত্যের বিশ্বস্ততাকে আরো পাকাপোক্ত করেছেন। ২০০১ সালে প্রকাশিত ডুবসাঁতার প্রকাশের মধ্যদিয়ে তিনি সত্যিকারভাবে কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে পাঠকের হৃদয়সাগরে ডুবসাঁতার দিয়ে অনন্য হয়ে উঠেছেন। প্রতিটি গ্রন্থ কথাসাহিত্যের সিঁড়ি নির্মাণের একেকটি ধাপ।

কবি মোশাররফ হোসেন খানের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘প্রচ্ছন্ন মানবী’। গ্রন্থটি তাঁকে ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত করিয়ে দিয়েছে। সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে তাঁর কথাশিল্পের প্রতিভা। জীবনঘনিষ্ঠতার প্রবাহমান ¯্রােত বয়ে গেছে এখানকার ছোটগল্পগুলোতে। ভাষাশৈলী এবং প্রকাশভঙ্গীতে কথাসাহিত্যের পূর্ণতাই ফুটে উঠেছে। বিষয়বস্তুর দিক থেকেও ভিন্ন আঙ্গিক ফুটে উঠেছে। সামাজিক শ্রেণিবৈষম্যের এক অনন্যচিত্র অংকন করেছেন এ গল্পগ্রন্থে। মানবিক মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক জয়-পরাজয় এবং জীবনবোধ ও বিশ্বাসের আবহে দোলায়িত তাঁর এ গল্পগ্রন্থ।

‘শকুন’ গল্পে উঠে এসেছে সামাজিক ব্যবধানের অনবদ্য চিত্রকল্প। আধুনিক রঙিন স্বপ্নময় সমাজে নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য হিসেবে ছোট চাকরিজীবী মানুষের কষ্ট আর বঞ্চনার ছবি ফুটে উঠেছে এখানে। সমাজপতি কিংবা সমাজের উচ্চশ্রেণির বিত্তশালী মানুষের প্রতি এক ধরনের ক্ষোভ উঠে এসেছে সাধারণ চাকরিজীবী রউফের চরিত্রের মধ্যদিয়ে। ‘সাগরের উপাখ্যান,’ ‘দেয়াল’ ‘অন্তর্গত’ ‘অন্তহীন যাত্রা’ ‘আয়না’ প্রভৃতি গল্পগুলোতেও নাগরিক যন্ত্রণা, শূন্যতাবোধ এবং যাপিত জীবনের অন্তহীন বাস্তবতা ফুটে উঠেছে স্পষ্টভাবে। ‘সাগরের উপাখ্যান’ গল্পে আধুনিক সংগ্রামী জীবনের সমস্যাবহুল নানা জটিলতার সমীকরণ উঠে এসেছে। গ্রন্থের সর্বশেষ গল্প ‘আয়না’। নিজের চেহারা দৃশ্যমান হবার সাথে সাথে আয়নায় যেভাবে অন্তর্লোক ও অন্তর্দাহকে প্রস্ফুটিত করে তুলেছেন তা গল্পকারের কারিশমাটিক দক্ষতা বলেই মনে হয়েছে। সত্যিকার অর্থে সামাজিক মূল্যবোধের নান্দনিক রসে জীবনের আখ্যান নির্মাণে সফল হয়েছেন কথাশিল্পী মোশররফ হোসেন খান।

কিশোর সাহিত্যে এক বিশাল ক্যানভাস নির্মাণ করেছেন কবি মোশাররফ হোসেন খান। কিশোর কবিতা-ছড়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের কিশোরদের সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে তার গাল্পিক প্রবন্ধ। গল্পের ঢঙে তিনি প্রবন্ধসাহিত্যকে কিশোর পাঠকের হাতে যুতসইভাবে তুলে দিয়েছেন। সরল শব্দ গাঁথুনি তাঁর প্রবন্ধের ভাষাকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। ইতিহাসের কঠিন বিষয়কে সাহিত্যের রসদে নান্দনিক ভাষায় উপস্থাপনে পারঙ্গম তিনি। ‘সাহসী মানুষের গল্প’ লিখে সারাদেশের কিশোরদের মাতিয়ে তুলেছেন। কিশোরকণ্ঠে দীর্ঘদিন তিনি লিখেছেন কায়েস মাহমুদ নামে। ১৯৯৪ সালে সাহসী মানুষের গল্প প্রথম খ- প্রকাশিত হবার পরে সকলের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। পাঁচটি খ-ে সাহসী মানুষের গল্প এখন মননশীল কিশোর পাঠকের ঘরে ঘরে শোভা পাচ্ছে। এ ছাড়াও রহস্যের চাদর, অবাক সেনাপতি, দূর সাগরের ডাক, কিশোর কমান্ডার, ছড়ির তরবারি, জীবন জাগার গল্প, সুবাসিত শীতল হাওয়া, আগুন নদীতে সাঁতার, অবাক করা আলোর পরশ, ছোটদের বিশ্বনবী কিশোরসাহিত্যকে সমৃদ্ধির দিকে টেনে নিয়ে গেছে। পাশাপাশি হাজী শরীয়তুল্লাহ, সাইয়েদ নিসার আলী তিতুমীর, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মুনশী মোহাম্মদ মেহেরউল্লাহসহ সংগ্রামী বীর এবং মণীষীদেরকে কিশোর পাঠকের কাছে পরিচিত করেছেন তিনি দক্ষতার সাথে।

কিশোর উপন্যাসে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তৈরি করেছে ‘সাগর ভাঙার দিন’। স্কুল ও কলেজ পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীদের ভীষণ প্রিয় এ উপন্যাসটি। কৈশোরের প্রাণচঞ্চল হৃদয়ে মননশীলতার এক বৈপ্লবিক আবহ ছুঁয়ে যায় এ উপন্যাসের পরতে পরতে। সেইসাথে ‘বিপ্লবের ঘোড়া, ‘ঝিমায় যখন ঝিকরগাছা, ‘কিশোর উপন্যাসসমগ্র, ‘স্বপ্নের ঠিকানা, ‘বাঁকড়া বিলের বালিহাঁস প্রভৃতি গ্রন্থগুলো কিশোর সাহিত্যে এক অনবদ্য সংযোজন।

সম্পাদনার জগতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন মোশাররফ হোসেন খান। পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা শুধু নয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকী ও বিশেষ সংখ্যা সম্পাদনা করেছেন দক্ষতার সাথে। মূলত, লেখালেখি এবং সম্পাদনাই যেনো জীবনের অপর নাম। স্বপ্নের ঘোরেও তিনি সাহিত্যের তরীই বাইতে থাকেন। তার প্রতিটি সৃষ্টিকর্ম জাতির কল্যাণে। ইংরেজি, আরবী, উর্দু, ফারসী, হিন্দী, গুজরাটী, অহমিয়া, রুশÑভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে গেছে তার কাব্যসম্ভার। তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ কর্মদক্ষতার প্রেক্ষিতে কবি আল মাহমুদ তার সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘মোশাররফ হোসেন খান একজন অত্যন্ত শক্তিমান আধুনিক কবি। কবিতা ছাড়াও তিনি কথাসাহিত্য, গদ্য সাহিত্য, জীবনীগ্রন্থ, বিশেষ করে শিশু সাহিত্যের খুব সফল একজন লেখক। তার প্রতিটি গ্রন্থই আমাকে মুগ্ধ করেছে।’ 

কাব্যকলা, ছোটগল্প, কিশোর উপন্যাস, জীবন কাহিনী, সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাস এবং সম্পাদনাসহ সর্বক্ষেত্রে তিনি বিশ্বাসের বাতাসে পাল উড়িয়েছেন। যেখানে বিশ্বাসের আড়ালে বিষাক্ত সাপ সেখানে তিনি নোঙর ফেলতে নারাজ। মূলত বিশুদ্ধতার টানে বৈরী বাতাসে লাগাম টানতে টানতে তিনি ব্যয় করে চলেছেন জীবনের সমস্ত বাসন্তী সৌন্দর্য। স্বদেশের মাটিতে বিশ্বাসী মানুষেরা যেদিন মানবিক মূল্যবোধের বিজয় নিশান উড়িয়ে প্রশান্তির হাসি হাসবে সেইদিন কবিও হাসবেন পরিতৃপ্তির হাসি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ