জীবনঘুড়ির আকাশ দেখা

সাজজাদ হোসাইন খান
ইলিয়াসের ঘণ্টা বাজলো হঠাৎ। ঢং ঢং ঢং। আজকের আওয়াজটা যেনো কেমন কেমন। অন্যরকম। ভাবনার পর্দা এফোঁড় ওফোঁড়। হৈ হৈ রৈ রৈ করে ক্লাসের বাইরে সব। দরজা বেঞ্চি ওলটপালট। আমার কব্জিতে লিনুর হাত। বললো বাসায় যাবি না? কি হলো তোর! তাইতো? এদিক ওদিক নজর ফেলে দেখি সব ফাঁকা। কেবল খুুশিরা লাফাচ্ছে। আর দাঁড়িয়ে আছি আমরা চারজন। যাই যাই করছেন স্যাররা। হাতে ছাতা, ব্যাগ। গম গম সড়ক। ছুটির পর এমনটাই হয় হররোজ। রেললাইন বরাবর হাঁটছি। আলীয়া মাদরাসার কোণায় আসতেই ডাইনে ঘুরলো মাহিবুর। এ পথ গেছে হোসনি দালান ঘেঁষে। মেডিকেলের গেইট নিশানায় আমরা তিনজন। হালিম লিনু আমি। রেললাইন পার হলেই মেডিকেলের সীমানা শুরু। রাস্তায় শুয়ে আছে ছায়া ছায়া রোদ। দুই পাড়ে কড়ুই গাছের সারি। পাতায় পাতায় ঝুলছে বাতাস। বিশাল মাঠ মেডিকেলের গেইটের উল্টা পাড়ে। তারপর দালান লাল লাল রং। অনেকটা মসজিদ মসজিদ লাগে। তবে মসজিদ না। মনসুর জানিয়েছিল এটি কলেজ না বিশ্ববিদ্যালয় বলতে পারছি না। মনসুরের চাচা এখানে পড়ান। শিক্ষক। বাসাও লাগুয়া। সে বাসায়ই নিয়ে গিয়েছিলো একদিন মনসুর। তাই চেনা চেনা। ওদেরকে সেই খবর জানালাম। একটু আাগে পা ফেলতেই গেইট। ডানপাশ ঘেঁষে। নাক বরাবর রাস্তা শহীদ মিনার ছুঁই ছুঁই। শেষমেষ আমরা ভাগ হয়ে গেলাম। হালিম রেল কলোনি। ওর বাসার দিকে। কার্জন হলের অন্য পাড়ে। লিনু আর আমি হাঁটছি। শহীদ মিনারের উল্টা পাড়ের পথ ধরে। গলি মতো। সামনে বিশ্ববিদ্যালয়। লাইব্রেরি। আছে মহিলা হোস্টেল। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় গাছ। ঝুরঝুর ঝরছে পাতা। পায়ের তলায় মচ মচ। বাতাস দৌড়াচ্ছে এদিক সেদিক। একটা দু’টা রিকশা চলছে। গাড়ির দেখা নাই এ পথে। বলতে গেলে শুনশান। লিনুকে বললাম আমরা যাচ্ছি কোথায়। লিনু চুপচাপ। একটি বড় দালানের দিকে ইশারা করলো। সাদা রং। আশেপাশে আরো দু’একটি দালান ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। সব সাদা।
আশপাশে বিশাল বিশাল গাছ। সবুজ সবুজ পাতা উড়ছে ফরফর। কিছু কিছু ডাল ঝুলছে দালান ঘেঁষে। জানালা ঘেঁষে। লিনু আগে আগে। বড় সড়ক পার হয়ে ঘাসে ভরা মাঠ। তারপর দালানের সিঁড়িতে আমরা। লাল ইটের। দু তলার দিকে উঠে গেছে। নিচে বারান্দা চত্বরে আড্ডা দিচ্ছে জনাকয়েক। ডাইনে ঘাড় ঘুরাতেই দেখি বিশাল ময়দান। আমি চিনি এ ময়দান। যার নাম ঘোড়দৌড়ের ময়দান। এ ময়দানে ঘোড়া চক্কর দেয়। সাপ্তাহে একদিন। কাঠের ঘের দেওয়া তামাম ময়দান। আমিও এসেছি ঘোড়দৌড় দেখতে। বেশ ক’সপ্তাহ। প্রতি শনিবার হয় এই আনন্দ উৎসব। এক লম্বা ঘর গেলারি মতো। সেখানে বসে বসে দেখা যায় ঘোড়া। ঘোড়ার দৌড়। শাহাবাগ বরাবর এই ঘর। সেখানেই জমে ঘোড়ার আড্ডা। লাফঝাঁপ। দর্শকদের হৈ চৈ। বড় বড় সব ঘোড়া। দৌড় শুরু হতেই চিৎকার। ছুটছে ঘোড়া। বাতাসের উড়না ছিঁড়েছুড়ে। আমার নজর ময়দানে। সেখানে বাতাসের দাপাদাপি। মনে হচ্ছে ঘোড়ার ডাক। খুড়ের ঠকঠক আওয়াজ। উড়ে উড়ে আসছে। বালি ঘাস সব। তাকিয়ে আছি তো আছিই। লিনুর ডাকে উড়লো ঘোড়া, পঙ্খিরাজ। ময়দান ফকফকা। অনেকেই উঠেছে উপড়ে। আমরাও উঠলাম। ভিতরে ঢুকতেই অবাক। কোথায় নিয়ে এলো লিনু। যেদিকে নজর ঘুরাই বই আর বই। বড় বড় আলমারি বইয়ে ঠাসা। লিনুর চোখে চোখ রাখলাম। জিজ্ঞাসার নজর। এই দালানের নাম পাবলিক লাইব্রেরি। লিনু জানালো। ফিসফিস করে। দেখলাম এখানে সেখানে পড়ছে অনেকে শব্দহীন। এই পাঠশালায় নাকি এমনটাই নিয়ম। লিনু জানালো। চারদিকে টেবিল চেয়ার। যেখানে সুবিধা বসছে। বই ঘাটছে। কিন্তু শব্দ নাই। আমরাও বই আনলাম খুঁজে। তবে কষ্ট হয় না খুঁজতে। আলমারি, তাকের মাথায় মাথায় লেখা আছে বইয়ের ঠিকানা। বড়দের বিভাগ আছে। আছে শিশু-কিশোর বিভাগ। কতো বই। কতো কথা। কতো চিন্তা। টেবিলে টেবিলে বসে আছে। আলমারিগুলো যেনো ডাকছে আমাকে। কি পড়বে আগে। গোয়েন্দা বই চাও ? ছড়া কবিতা চাও ? ইতিহাস ভূগোল। এই দেখো আমার বুকভরা হাসি, আনন্দ। তোমার জন্যই খুলে রেখেছি জ্ঞানের কপাট। ভাসছে সারা কামরা জুড়ে চিন্তার সুগন্ধি। জ্ঞানের সুগন্ধি। আমার মাথা ঘুরছে। মগজে লাফাচ্ছে বইয়ের পৃষ্ঠা। আমি কেবলি সাঁতার কাটছি বইয়ের সাগরে। কথার সাগরে। কুলের দেখা নাই। কোথায় তীর। সে সাগরে শুধু ¯্রােত। যাচ্ছেতো যাচ্ছে। বসে আছি বেভোল। লিনু ডাকলো। কীরে এই পড়ার ছিরি! এখনো এক পৃষ্ঠায় বসে আছিস। অন্য বই দেখবি কখন? এই দেখ তোর বাহারাম আর মোহনের বাপ। বাপ মানে, জানতে চাইলাম। লিনুর ঠোঁটে হাসির পাপড়ি কাঁপছে। বইটির নাম রবিন হুড। লেখকের নাম লেখা আছে হাউয়ার্ড পেইলি। ইংরেজিতে লেখা। এই বইয়ের ভাব চুরি করেই তোর কাশেমরা জমজমাট টাকা কামাছে। রবিনহুডও একজন লুটেরা, ডাকু। ধনীদের ধন লুট করে এনে গরীবের বন্ধু সাজে। তোর বাহরামরাও তো এই পথেই হাঁটে। গরীবকে বিলায় মুঠো ভরতি। তোমরা কি খাও? তোমাদের জীবন চলে কার পয়সায়। সেই লুটের পয়সার বড় ভাগটা থাকে রবিনহুড-বাহরামদের জেবে। গরীবের বন্ধু সাজা। একধরনের বাটপারী। ভন্ডামী। লিনু আমার কথার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলো। এ নিয়ে ভাবনা পরে হবে। বললো চল বাসায় যাই। এমনিতে সময় কবার অনেক। সূর্য নোমে যাচ্ছে নিচে। আর একদিন আসা যাবে। চোখের পাতায় বসে আছে পরীক্ষা। বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে গেলো। সূর্য তখন ডুবু ডুবু। লিনু বাসাবোর দিকে। আর আমি ঢুকলাম মতিঝিল অফিসার্স কলোনীতে। চোখে শুধু ভাসছে বই। বড় বড় আলমারি। বই ভরতি তাক। (চলবে)