শনিবার ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

মায়ের স্বপ্ন 

নাঈমুল হাসান তানযীম 

জারিফ। বারো বছরের নিষ্পাপ কিশোর। চেহারায় মায়া মায়া একটা ভাব আছে ওর। খুবই বিনয়ী আর নম্র ভদ্র একটা ছেলে। আপন বলতে পৃথিবীতে দাদী ছাড়া কেউই নেই ওর। ও যখন পাঁচ বছরের শিশু তখনই কোনো এক সন্ধ্যায় কাউকে না বলে চুপটি করে চলে যান ওর মা। দাদী বলেছিলেন, মা নাকি তারার দেশে গিয়েছেন। আবারও ফিরে আসবেন। কিন্তু মানুষের কান্নাকাটি আর বিলাপ দেখে কিছুটা হলেও ও আঁচ করতে পেরেছিল, মা ওকে ফেলে অনেক দূরে চলে গিয়েছেন। যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। 

জারিফের বাবা অন্যদের বাবার মতো ছিল না। মায়ের কোনো খোঁজখবর রাখত না। দাদীকেও দেখতে আসত না। ওর কথা তো মনেই হতো না যেন। এমন পাষাণ হৃদয়ের বাবাও আছে পৃথিবীতে! জারিফের ভাবতে খুব কষ্ট হয়। ও শুধু দোয়া করে দাদীর মতো, ‘আল্লা  গো! আমার বাবাটাকে ভালো করে দাও’

দাদী বলেছেন, মা বেঁচে থাকতে নাকি খুব করে চাইতেন, ও যেন বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়। ত্রিশ পারা কুরআনের হাফেজ হয়। অভাবী দুঃখী মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। মায়ের এমনটাই স্বপ্ন ছিল ওকে ঘিরে। জারিফ দাদীর কাছ থেকে মায়ের স্বপ্নগুলোর কথা শুনে শুনে নিজেকে সেভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যেই ও ছাব্বিশ পারা কুরআন মুখস্থ করে ফেলেছে। মায়ের স্বপ্ন পূরণে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ও। ও আশা করে, একদিন সব স্বপ্ন আশা আলোর মুখ দেখবে। একদিন ও অ-নে-ক বড় হবে।

দাদীর কাছ থেকে ও শুনেছে, ওর মায়ের নাকি বড় একটা অসুখ হয়েছিল। পর্যাপ্ত টাকা পয়সার অভাবে ভালোমতো চিকিৎসাও করানো যায়নি। বাবা তো খবরই রাখেনি কোনো। ওর ইচ্ছে, বড় হয়ে ও মায়ের মতো অসহায় দুস্থ মায়েদের পাশে দাঁড়াবে। পৃথিবীর আর কোনো মায়ের যাতে এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরে যেতে 

না হয়। 

জারিফের ত্রিশ পারা কুরআন মুখস্থ হয়ে গেছে। দাদীর মনে সেকি খুশি! আজ মা বেঁচে থাকলে বোধহয় সে খুশিটুকু পূর্ণতা পেতো। আনন্দের এ খবর ছড়িয়ে পড়তো পাড়ায় পাড়ায়।

জারিফের দুচোখ ছাপিয়ে কান্না আসছে। দাদী আঁচল দিয়ে সে অশ্রু মুছে দিচ্ছেন। জারিফের আজ এ পর্যন্ত পৌঁছার পেছনে সব অবদান দাদীরই। দাদীই যে ওকে কোলেপিঠে করে মানুষ করে তুলছেন। ওর পেছনে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছেন। দাদী ওকে সান্ত¡না দেন, মা নাকি খুব ভালো অবস্থাতেই আছেন কবরে। পাড়ার মহিলারাও একই কথা বলে। আক্ষেপ করে করে বলে, ‘আহ, কতো ভালো মানুষ ছিল গো খালেদা আপা! 

পৃথিবীর সব ভালো মানুষেরাই কি শুধু তাড়াতাড়ি চলে যায়!

সেদিন রাতে হঠাৎ মাকে স্বপ্নে দেখল ও। মা দাদীকে নিয়ে ওকে দেখতে এসেছেন ওর মাদরাসায়। সাথে করে কতকিছু নিয়ে এসেছেন! আঙুর, আপেল, কমলা, লিচু আর ওর সবচেয়ে প্রিয় ম্যাগি নুডলস। মা ওকে কাছে বসিয়ে খাইয়ে দিয়েছেন সেসব। অনেকদিন পর মাকে দেখে খুশিতে যেন আত্মহারা হয়ে পড়ল ও। এরই মাঝে হঠাৎ ওস্তাদজীর ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেলো ওর, ‘এই! ওঠো ওঠো। ওজু করে পড়তে বসো।’

মায়ের মুখটা অস্পষ্ট মনে পড়ে ওর। গোলগাল সুন্দর মায়াবী চেহারা ছিল মায়ের। দিন কি রাত যখনই  মায়ের কথা মনে পড়ে ও ছুটে যায় মায়ের কবরের কাছে। সূরা ইয়াসিন সূরা ইখলাস পড়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে দোয়া করেও। ইদানীং আবার লক্ষ্য করছে, মায়ের কবরের ওপর শিউলি ফুল ফুটে আছে অনেকগুলো। শিউলির পাগল করা মিষ্টি ঘ্রাণে ভারাক্রান্ত ভাঙা হৃদয়টা ওর সজীব সতেজ হয়ে ওঠে। আর কেন যেন শুধু মনে হয়, মা খুব শান্তিতেই ঘুমিয়ে আছেন ছোট্ট কবর ঘরে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ