রবিবার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Online Edition

গুলঞ্চ সাধারণ হয়েও অসাধারণ: ডেঙ্গু রোধ করে

গুলঞ্চ (গিলয়) বা টিনোস্পোরা (সংস্কৃত নাম : অমৃত, তন্ত্রিকা, কু-লিনী, চক্রলক্ষ্মীণি) হচ্ছে  মেনিসপার্মেসিয়া পরিবারের অর্ন্তভূক্ত একটি পর্ণমোচী উদ্ভিদ যা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বহুলভাবে জন্মায়। গুল্মটি অন্য গাছের ওপরে বেয়ে ওঠা লতানো উদ্ভিদ। কা-ের উপরিভাগ খসখসে ফাটল যুক্ত। বিস্কুট রং এর চামড়া। পাতা পানপাতার মত হৃদয় আকৃতির এবং লম্বা বোটা যুক্ত। লম্বা সুতার মত অসংখ্য বায়ুবীয় মূল যা ঝুলন্ত কা- থেকে মাটি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই গাছে গ্রীষ্মকালে ফুল ফোটে এবং শীতকালে ফল পাকে। পূংকেশর এবং স্ত্রীকেশর ভিন্ন ফুলে থাকে। এর কা- দুর্বল এবং রসালো। কা-ের রং হচ্ছে সাদা থেকে ধূসর এবং তা ১-৫ সে মি পর্যন্ত মোটা হতে পারে। গুলঞ্চের পাতা দেখতে হৃদয়ের (হার্ট) আকারের এবং তাতে মেমব্রেন (ঝিল্লি) আছে। তাতে গ্রীষ্মকালে সবুজেটে-হলুদ রঙের ফুল ফোটে আর গুলঞ্চের ফল সাধারণত শীতকালে দেখা যায়। গুলঞ্চের সবুজ রঙের আঁটিযুক্ত ফল  হয়ে থাকে যা পাকলে লাল বর্ণ ধারণ করে। গুলঞ্চের কা-েই অধিকাংশ নিরাময়যোগ্য গুণ আছে, তবে পাতা, ফল, এবং শিকড় বা মূলেও অল্পবিস্তর গুণ আছে। এই গাছ দেশের আনাচে কানাচে পাবেন। অনেকটা অযতেœ বেড়ে ওঠে। আমি রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বোটানিকেল গার্ডেনসহ বিভিন্ন স্থানে দেখেছি। আপনারাও দেখে থাকবেন, হয়তো চিনতে পারেননি। 

 এর বৈজ্ঞানিক নাম টিনোস্পোরা কর্ডিফোলিয়া। অর্ডার বা বর্গ হচ্ছে রানুনকুলালেস (Ranunculales), পরিবার বা ফ্যামিলি হচ্ছে  মেনিসপার্মেসিয়া (Menispermaceae),  জেনাস বা গণ হচ্ছে টিনোস্পোরা (Tinospora), স্পেসিজ বা প্রজাতি: টি. কর্ডিফোলিয়া (T. cordifolia) . আরদ্বিপদী নাম বা বিনোমিয়াল নেম হচ্ছে টিনোস্পোরা কর্ডিফোলিয়া। 

এর সাধারণ নাম: গিলয়, গুডুস, গুড়ুচি, গুলবেল, হার্ট লিফ মুনসিড (heart leaf moonseed)। প্রশমণের গুণ এবং স্বাস্থ্যকর উপাদানের জন্য আয়ুর্বেদিক এবং ঘরোয়া চিকিৎসায় এটির কদর অসামান্য। বস্তুত, স্বাস্থ্যের সার্বিক উপকারিতার ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতার জন্য আয়ুর্বেদে এটিকে ‘‘রসায়ন’’ নামে অভিহিত করা হয়। সংস্কৃতে এটিকে ‘‘অমৃত’’ বলা হয়েছে, যার অর্থ ‘‘অমরত্বসুধা’’। এই সময়ের আতংক ডেঙ্গু জ্বরের মতো জীবাণুর সংক্রমণের হাত থেকে এটি রক্ষা করে।

আদিতে ভারতীয় উপমহাদেশে পাওয়া যেত গুলঞ্চ লতা। শ্রীলঙ্কা, চীন, ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্যও দেশে পাওয়া যায়। কিন্তু এখন চিনেও এ উদ্ভিদ পাওয়া যায়। এ লতায় আছে আশঁ (১৫ - ১৯%), প্রোটিন (৩.১%) এবং প্রতি ১০০ গ্রামে ২৯২.৫৪ ক্যালরি পুষ্টি শক্তি। এ লতায় আরো আছে নানা রকম রাসায়নিক পদার্থ যেমন জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ, ফ্লোরিন, ক্যালশিয়াম, টাইটানিয়াম, ক্রমিয়াম, আয়রন, কোবাল্ট, নিকেল, কপার, ব্রমিন, ষ্ট্রোনশিয়াম এবং পটাশিয়াম। জানামতে পটাশিয়াম (০.৮৪৫%) যা স্নায়ুবিক শক্তিবৃদ্ধি করে। ক্রমিয়াম (০.০০৬%) শর্করা ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে। আয়রন (০.২৮%) যা হেমোগ্লোবিন বৃদ্ধি করে এবং ক্যালশিয়াম (০.১৩%) স্নায়ু, হৃদযন্ত্র এবং পেশি শক্তি বৃদ্ধি করে। এ গাছের রস বেশ তিতা তবে এর মধ্যে আছে এন্টি-অকসিডেন্ট, এন্টিহাইপার গ্লাইসেমিক, এন্টি- নিওপ্লাসটিক, এন্টিডোট, এন্টি-প্লাসমোডিক, এন্টি-হাইপারটিক, এন্টি-এলার্জিক, এন্টি-ইনফ্লামেটরি, এন্টিহাইপার লাই পেডেমিয়া, এন্টি-এষ্ট্রেস সমৃদ্ধ গুনাবলী। এর মধ্যে আরো আছে এলকালয়েড, ডিটারপিনয়ড, ল্যাকটোনস, ষ্টেরয়েডস, গ্লাইকোসাইডস, এলিফ্যাটিক যৌগ এবং পলিসাকারাইড। এগুলো সবই ডাক্তারী শাস্ত্রের উপভাষা।  যুগযুগ ধরে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে জন্ডিস, ডায়াবেটিস, আর্থ-রাইটিস, ক্যান্সার, ডেঙ্গুজ্বর, আমাশয়, গনোরিয়া, সিফিলিস, হেপাটাইটিস, চর্মরোগ, রক্তশূন্যতা, ব্রনকাইটিস, এজমা, পাইল্স, কিডনি রোগ, এবং সাপের বিষের এন্টিডোট হিসাবে ব্যবহার হয়।

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রে গুলঞ্চ একটি পরিচিত গুল্ম। গুলঞ্চের কা- শুধুমাত্র নিরাময়ের একটি চমৎকার এজেন্ট নয়, কিন্তু রাসায়নিকভাবে এটি আপনার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যাতে ঠিকভাবে এবং তাদের সম্পূর্ণ শক্তি-সহ কাজ করে তা নিশ্চিত করে। এই আয়ুর্বেদিক মহৌষধের বহু স্বাস্থ্যের উপকারিতা রয়েছে। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য ঐতিহ্যবাহী ওষুধের শতাব্দী ব্যবহারের সত্ত্বেও, কোনও উচ্চমানের ক্লিনিকাল প্রমাণ নেই যে এটিতে রোগের উপর কোনও প্রভাব আছে। 

এর ওষুধী গুণের কথা বলেছি। বিস্তারিত জেনে নিন - ওজন কমাতে গুলঞ্চ: গুলঞ্চ হাইপোলিপিডেমিক হিসাবে কাজ করে বলে নিয়মিত সেবন করলে ওজন কমানোর ক্ষেত্রে চমৎকার কাজ দেয়। শরীরের পরিপাক প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করে এবং যকৃৎ বা লিভার রক্ষা করে। জ্বর উপশমে গুলঞ্চ: দীর্ঘস্থায়ী জ্বরের চিকিৎসার জন্য চিরাচরিতভাবে গুলঞ্চ ব্যবহার হয়। বিভিন্ন প্রাণীর ওপর প্রয়োগ করে গুলঞ্চের অ্যান্টিপাইরেটিক কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ডেঙ্গির বিরুদ্ধে কার্যকারিতা বুঝতে শারীরিক পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে জ্বর উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। গুলঞ্চ ইমিউনোমডিউলেটরি প্রক্রিয়া করে এবং তার অ্যান্টিবায়োটিক উপাদান আছে। ডেঙ্গু জ্বরের মতো জীবাণুর সংক্রমণের হাত থেকে এটি রক্ষা করে একথা আগেই বলেছি। ডায়বিটিসের প্রতিরোধে গুলঞ্চ: ইনসুলিনের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হয় বলে ডায়বিটিসের ক্ষেত্রে এটি কার্যকরী হয়। শ্বাসকষ্ট রুখতে গুলঞ্চ: দেখা গিয়েছে, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস-এর চিকিৎসায় গুলঞ্চ কার্যকরী ভূমিকা নেয় এবং হাঁপানি বা অ্যাজমার উপসর্গ কমানোর ক্ষেত্রেও এটি কাজে লাগে। মহিলাদের জন্য গুলঞ্চ: রোগ প্রতিরোধী উপাদানগুলির জন্য রজঃনিবৃত্তি উত্তর (পোস্টমেনোপজাল) মহিলাদের জন্য গুলঞ্চ খুব কাজে লাগে। এর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান অস্টিওপোরোসিস (হাড়ের ক্ষয়)  রোধ কমাতে পারে। পুরুরষদের জন্য  গুলঞ্চ: গুলঞ্চের ব্যবহারে বীর্যধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে পুরুষদের যৌন ক্ষমতা বা ইচ্ছা বৃদ্ধি পায়। ক্যান্সারের প্রতিরোধে গুলঞ্চ: কয়েকটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, গুলঞ্চের অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদানের জন্য গুলঞ্চের ব্যবহার করা যেতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুলঞ্চ: দুশ্চিন্তা, অবসাদ এবং অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য গুলঞ্চের ব্যবহার হয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ