সোমবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
Online Edition

ঘাতক 

জোবায়ের রাজু 

অর্কের ড্রাইভ করা সাদা কালারের প্রাইভেটকারটি রাতের নিরবতা ভেঙ্গে হন হন করে ছুটে চলছে। এখন রাত সাড়ে নয়টা। অর্কের পাশে বসে আছে স্ত্রী সুমনা। তাদের এই গন্তব্য কিংফিশার রেস্টুরেন্টে যাবার কথা থাকলেও অর্ক সেদিকে গাড়ি ড্রাইভ না করে উল্টো পথে ছুটছে। তার এই গন্তব্য হচ্ছে মেঘনা সেতু। যেখানে অপেক্ষা করছে মৃত্তিকা। 

সুমনা বলল-‘ কী ব্যাপার। তুমি কোথায় যাচ্ছো? আমাদের না রেস্টুরেন্টে যাবার কথা?’ অর্ক কোন কথা না বলে ম্লান হাসলো। গাড়ি ড্রাইভে পূর্ণাঙ্গ মনোযোগী হলেও সে পাশে বসা স্ত্রীর দিকে বার বার তাকাচ্ছে। নীল শাড়িতে সুমনাকে খুব একটা মানায়নি। চুলের খোঁপার পাশে বেলীর মালাটা না দিলেও চলতো। যার কারণে সুমনাকে মন্দ দেখাচ্ছে। তবু অর্ক স্ত্রীকে বলল-‘তোমাকে আজ পরীর মতো লাগছে।’ কথাটা স্ত্রীকে ¯্রফে খুশি রাখার জন্যে হলেও সুমনা সেটাকে সত্য ভেবে রিনরিনে গলায় হাসতে লাগল। 

আজ আঠারো তারিখ। সুমনার জন্মদিন। এই দিনে কিংফিশার রেস্টুরেন্টে কেক কাটার জন্যে গত দিন আগ থেকে অর্ক সুমনাকে তাগিদ দিচ্ছে। জন্মদিনে কেক কাটা এসব কখনো পছন্দ না সুমনার। তবু অর্ক যখন এতো করে বলছে, সুমনা রাজি হল। এখন তারা সেখানেই যাচ্ছে। কিন্তু অর্ক কোনদিকে গাড়ি ড্রাইভ করছে, ভেবে পায় না সুমনা। বিস্মিত গলায় বলল-‘আমরা কোথায় যাচ্ছি অর্ক? পথ ভুল করলে না তো!’ সুমনার প্রশ্নের জবাব দেবার আগেই অর্কের মোবাইল বেজে ওঠে। মৃত্তিকার কল-‘তুমি কোথায় প্রিয়? আমি মিনিট দশেক আগে মেঘনা সেতুতে চলে এসেছি। তোমরা আসতে কতক্ষণ লাগবে?’ অর্ক ক্ষীণ গলায় বলল-‘এই তো পাঁচ মিনিটের মধ্যে সুমনাকে নিয়ে আসছি।’ এইটুকুই বলেই লাইন কেটে দিল অর্ক। জিজ্ঞাসার সুরে সুমনা বললÑ‘কার ফোন গো?’ অর্ক নিচু গলায় বলল-‘আমার বন্ধু সাইফের কল।’ 

দ্রুত গতিতে প্রাইভেটকার ছুটছে। সুমনা জানে তাদের এই যাত্রা গিয়ে কিংফিশার রেস্টুরেন্টে থামবে। কিন্তু অর্ক সেদিকে না গিয়ে অন্য পথে গাড়ি নিয়ে চলছে। সেই পথ গিয়ে শেষ হবে মেঘনার ব্রিজের উপর। সুমনা জানে না একটু পর সে লাশ হয়ে মেঘনার জলে তলিয়ে যাবে। কোন গভীর জলের প্রাণী তার লাশ খেয়ে ফেলবে। 

মাত্র আট মাস আগে বিয়ে হয়েছে অর্কÑসুমনার। সুমনা লাখপতি বাবার একমাত্র মেয়ে। গায়ের রংটা কালো আর অসুন্দর চেহারা বলে বিয়ের উপযুক্ত সময়েও তার জন্যে কোন সম্বন্ধ আসতো না। সুমনার লাখপতি বাবা যখন মেয়ের বয়স আর বিয়ের ব্যাপারে চিন্তার মহাসাগরে পড়লেন, তখনই তার সাথে পরিচয় হয় অর্কের মামার। যে মামার কাছে অর্ক মানুষ হয়েছে ছোটবেলা থেকে। 

ছোটবেলায় অর্কের মা বাবার সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর এই মামার কাছেই তার আশ্রয় আর বেড়ে ওঠা। সুমনার বাবার সাথে অর্কের মামার গলায় গলায় ভাব বাড়তে থাকে দিনে দিনে। বলা যায় এই বিয়ের ঘটক তার মামাই। 

সুমনার বাবা অর্কের মামাকে কথা দিয়েছে তার মেয়েকে ভাগ্নে বউ করে নিলে অর্ককে অনেক ধন সম্পদ আর টাকা দেওয়া হবে। 

সেই লোভটা পেয়ে বসেছে অর্কের মামাকে। ভাগ্নের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সুমনার মতো আইবুড়ি মেয়েকে গ্রহণ করতে মামা রাজি হলেও অর্ক ছিল নারাজ। টাকার লোভে সে কোন মেয়েকে বিয়ে করার পক্ষে ছিল না। থাকবেই বা কেন, সে তো ভালোবাসে মৃত্তিকাকে। তবুও কিভাবে যেন মামার প্রবল অনুরোধের কারণে শেষ পর্যন্ত সুমনার সাথে অর্কের বিয়েটা হয়ে গেল। 

সুমনার বাবা তার কথা রেখেছেন। বিয়ের পর পরই তিনি মেয়ে জামাতাকে তার সম্পত্তির প্রায় অর্ধেকটা দিয়ে দিলেন। একটি ফ্ল্যাটসহ প্রাইভেটকার কিনে দিলেন। গাড়ি বাড়ি সব হল অর্কের। অল্পদিনে শ্বশুর মশাই তার লাইফ পাল্টে দিলেন। 

কিন্তু..। মৃত্তিকাকে কি অর্ক ভুলতে পেরেছে? না পারেনি। গায়ের রং কালো বলে স্ত্রী সুমনার প্রতি কোন টান হয় না অর্কের। তার যত টান, সব মৃত্তিকার জন্যে। 

মৃত্তিকাও পাগলের মতো ভালোবাসতো অর্ককে। কিন্তু অর্কের অন্যত্র বিয়ে হবার পর সে যখন চিরকুমারি জীবন বেছে নেয়ার পরিকল্পনা করেছে, তখনই হঠাৎ হঠাৎ তার মোবাইলে অনাহূতের মতো কল আসতো অর্কের। সম্পত্তির লোভে কালো মেয়ে বিয়ে করা এবং সুমনার প্রতি অর্কের অনীহার গল্পগুলি অর্কের মুখে শুনতে ভালো লাগত মৃত্তিকার। 

দিনে দিনে সুমনার দিকে নয়, মৃত্তিকার দিকেই নুয়ে পড়তে থাকে অর্ক। মৃত্তিকাকে নিয়ে প্রায়ই সে রমনা পার্কে নয়তো জিয়া উদ্যানে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিত। স্বামীর প্রতি কোন অভিযোগও ছিল না সুমনার। 

সুমনাকে তালাক দেবার ব্যাপারে প্রায়ই অর্ক মৃত্তিকার সাথে পরামর্শ করতো। কিন্তু তালাকের ব্যাপারে মৃত্তিকার কখনো মত ছিল না। মৃত্তিকার অনুরোধ হচ্ছে সুমনাকে একেবারেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া। তালাকের ব্যাপারে গেলে নতুন নতুন ঘটনার জন্ম নিবে। আইন আদালতে যাওয়াসহ নানান ঝামেলা। তার চেয়ে বরং পথের কাঁটা একেবারেই সরিয়ে দেয়াটাই উত্তম।

মৃত্তিকার পরিকল্পনা অনুযায়ী আজ অর্ক সুমনাকে জন্মদিনে কেক কাটার নাম করে ঘর থেকে চিরদিনের জন্যে বের করে নিয়ে এসেছে। বিয়ের পর অর্কের প্রতি সুমনার ছিল অগাধ বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের মানুষটি আজ তাকে খুন করবে, এটা সুমনা জানে না। অর্কের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস তাকে অন্ধই করে রেখেছে। যার কারণে সে দেখতেই পারেনি অর্কের আসল রুপ। 

‘কী হল অর্ক! আমরা কোথায় যাচ্ছি?’-সুমনার কথায় ধ্যান ভাঙ্গে অর্কের। নিচু গলায় অর্ক বলল-‘মেঘনা ব্রিজে।’ চোখ কপালে তুলে সুমনা প্রশ্ন করেÑ‘মেঘনা ব্রিজে কেন?’ অর্ক মৃদু হেসে বলল-গেলেই দেখবে।’ 

২.

মেঘনা সেতুর ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্তিকা। সুমনা আর অর্কের জন্য সে অপেক্ষা করছে। মৃত্তিকার ঠিক সামনে এসে থামল প্রাইভেটকার। অর্ক সুমনাকে নিয়ে প্রাইভেটকার থেকে নামতেই মৃত্তিকা বললÑ‘কেমন আছো সুমনা? শুভ জন্মদিন।’ অবাক হয়ে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে থাকে সুমনা। অর্ক তাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছে বুঝতে পারছে না। এতরাতে এখানে মেয়েটিও বা কী করছে? এই সেতুর মাঝখানে এতরাতে অর্কও বা তাকে নিয়ে এসেছে কেন? মেয়েটি-ই বা কে? 

‘অর্ক তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এলে কেন? আর উনিই বা কে?’ সুমনার কথার জবাব না দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অর্ক। তার খানিকটা ভয় লাগছে। সুমনাকে কি সে সত্যি খুন করতে পারবে? খুন এতো সোজা? 

মৃত্তিকা হিংস্রে হয়ে ওঠে। সে ক্রমশ এগিয়ে আসে সুমনার দিকে। সুমনা ভয়ে কুকরে ওঠে। মৃত্তিকা এক পা দু পা করে এগিয়ে আসতে থাকে। সুমনা অর্কের দিকে তাকায়। অর্কের ঠোঁট কাঁপছে। মেঘনার বাতাসে উড়ছে সুমনার নীল শাড়ির আঁচল। 

হঠাৎ সুমনার চুলের বেলী ফুলের মালাটা খুলে পড়ে গেল। মৃত্তিকা সুমনার দিকে এগিয়ে আসছে। 

সুমনার গলা টিপে ধরলো মৃত্তিকা। সুমনা চিৎকার দিয়েও দিতে পারছে না। সে অর্ককে ডাকতে চেয়েও ডাকতে পারছে না। অর্ক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার ঠোঁট কাঁপা বাড়তে লাগল। কপালে জমতে শুরু করেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। 

সুমনার দম বন্ধ হয়ে গেল। নিথর দেহটা পড়ে আছে ব্রিজের উপর। এক্ষুণি লাশটাকে ব্রিজের নিচে ফেলে দিতে হবে। ‘কী হল অর্ক! তুমি ওর দু পা তুলে ধরো, আমি হাত টেনে ধরছি।’Ñমৃত্তিকার কথায় অর্ক বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মৃত্তিকা একাই সুমনার লাশ ব্রিজ থেকে নিচে ফেলে দিল। তারপর অর্ককে টেনে সোজা গাড়িতে নিয়ে গেল। 

প্রাইভেটকারটি দ্রুত সরে গেল ঘটনাস্থল থেকে। অর্ক ঝড়ের বেগে ড্রাইভ করছে, তবু মৃত্তিকা বললÑ‘আরো দ্রুত ড্রাইভ করো অর্ক। পুলিশের নজরদারী হলে সমস্যা।’ অর্ক গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দিল। তাদের গাড়ি ঘেঁষে উল্কার মতো চলে গেল একটি মালবাহী ট্রাক। ট্রাকের পিছনে বড় করে লেখাÑ‘মায়ের দোয়া।’

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ