শুক্রবার ০১ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

কাক ও বকের পাঠশালা

আরিফুর রহমান সেলিম

কাক ও বক দুটোই খুব অহংকারী। কাক অহংকার করে নিজের গলা নিয়ে আর বক অহংকার করে নিজের সৌন্দর্য নিয়ে। সেদিন দু’জনেরই দেখা হলো নদীর ঘাটে। দু’জনেই গোসল করতে গেছে। কাককে দেখেই বক বলে উঠলো কি হবে তোর গোসল করে?  সারা গায়ে তো  ময়লার গন্ধ লেগেই থাকে। আর তুই দেখতেও কি কুচকুচে কালো।  “কাক প্রথমেই নদীর শান্ত পানিতে একটা ডুব দিলো। মাথাটা ঠান্ডা করে  একটু জিরিয়ে নিয়ে সে জবাব দিলো, তুই খুব গুণবতী তাইনা!  তুই কি জানিস তোর কণ্ঠস্বর কেউ বুঝে না। বোবা কোথাকার। এমন মিন মিন স্বভাবের কাউকে দেখলেই আমার মাথায় রক্ত ওঠে। কোত্থেকে যে এসব ভীরু নদীর ঘাটে আসে। ” বলেই হন হন করে উড়ে উড়ে কাকটা তার বাসার দিকে ছুটলো। আর মন খারাপ করে বকটা ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো বাসার দিকে।

রাতের বেলা বকের মাথায় শুধু ভন ভন করছে কাকের কথাগুলো। মনে মনে বললো, “বলে কি কাকে?  আমি নাকি ভীরু?  আমার নাকি কন্ঠস্বর চিকন? আমার কথা কেউ বুঝে না?” ওতো হতচ্ছারি। সারাক্ষণ কা কা করে চারিপাশ কেমন গরম করে রাখে। মানুষসহ অন্য পশুপাখিরা কত বিরক্ত হয়। ওতো মনে করে জোরে শব্দ করতে পারলেই হলো। মনে আছে ছোট্ট বেলায় মা আমাকে বলেছিলো “শোন মা। কখনো জোরে শব্দ করে কথা বলবে না। এতে অনেকেই বিরক্ত হয়। মস্তিষ্কে সমস্যা হয়। শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।” সেই থেকেই তো আমি শান্তশিষ্ট। কখনো জোরে আওয়াজ করে কথা বলি না। বিচ্ছিরি কাক যা বলে বলুক। আমি বরং মায়ের কথা মতোই চলবো। মনে আছে নবীজী বলেছিলেন “আমাদের মায়ের কথা শুনতে হবে। মাকে ভালবাসতে হবে। কারণ মায়ের পায়ের নিচেই সন্তানের বেহেশত।”

ঐ দিকে কাকেরও রাতে ঘুম আসছে না । বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু বকের কথাগুলোই কানে বাজছে। মনে মনে কাক বকের প্রতি রাগ ঝেড়ে বলছে  ‘‘কত্ত বড় সাহস ঐ পুচকে বকের। শ্রদ্ধা নাই ট্রদ্ধা নাই। একটা কথা বললেই হলো। বলে কিনা আমার গায়ে নাকি ময়লার গন্ধ। ঐ পুচকে কাক কি জানে আমার বাবার কথা। বাবা বলেছিলো।” কখনো কোন কাজকে ছোট মনে করবে না। সারাক্ষণ নিজে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে এমনকি পরিবেশটাও পরিচ্ছন্ন রাখবে। মনে রাখবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলে দেহ ও মন দুটোই ভালো থাকে।  যা বলে বলুক ঐ পুচকে বকে আমি কিছুই মনে করব না। আমি নিজে পরিষ্কার থাকি আর পরিবেশও পরিচ্ছন্ন রাখি। বাবা বলেছেন নবী বলেছেন....  পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাই ইমানের অঙ্গ। তাই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি সব সময় পরিষ্কার থাকবই।

এভাবে ভাবতে ভাবতে কাক ও বক ঘুমাতে গেলো। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলো কাক ও বক বেড়াতে গিয়েছে এক বিয়ে বাড়িতে। দু’জনেই নিজেদের যেন সুন্দর লাগে সেজন্য সাজুগুজু করে গেলো। কাকের কথা বকের আর বকের কথা কাকের মনে ছিল। তাই দু’জনকেই যেন ভিন্ন রকম দেখা যায় তারা সে চেষ্টা করলো।

কাক খুব সুন্দর করে সাজলো। হাতে দিলো চুড়ি। পায়ে সুন্দর নূপুর। গলায় সোনার হার। ঠোঁটে লিপিষ্টিক। আর মুখে মাখলো নানান জাতের ক্রিম। কাক কে দেখতে এক অদ্ভূত রকমের সুন্দর লাগলো।

আর ঐ দিকে বক যেন নিজেকে দুর্দান্ত সাহসী মনে হয় সে জন্য কালো রঙের একটা কাপড় পরলো। মুখে মাখলো কালো হওয়ার ক্রিম। কারণ বকের মনে হলো কাকের মতো কালো হলেই বুঝি সাহসী হওয়া যায়। 

বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্যান্য পাখিরাও সমবেত হলো। কোকিল, ময়না, টিয়ে, ঘুঘু, টুনটুনি সকল পাখিরাই সেখানে ছিল। হঠাৎ সেখানে হাজির হলো কাক আর বক। চারিদিকে হুলুস্থুল কান্ড ঘটে গেলো। মুহূর্তেই খবর ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। কাক আর বকের অদ্ভুত সাজ দেখতে সব পাখিরা হুমরি খেয়ে পড়লো। কাক আর বককে নিয়ে সকলেই হাসাহাসি আর টিপ্পনি কাটতে লাগলো। লজ্জায় কাক আর বক সেখান থেকে কোনমতে জান নিয়ে পালালো। দৌড়াতে দৌড়াতে কাক আর বকের ঘুম ভেঙে গেলো। বাইরে তাকিয়ে দেখলো সকাল হয়ে গেছে।

বক আর কাক সকালেই মর্নিং ওয়াকে হাঁটতে বের হলো। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ চোখে পড়লো একটা সাইনবোর্ড। টিয়ে পাখি একটা পাঠশালা খুলেছে। লেখা আছে এই স্কুলে পাখিদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও জীবন গঠনের পরামর্শ দেওয়া হবে। বক ও কাকের দু’জনেরই ইচ্ছে হলো টিয়ের স্কুলে ভর্তি হবে।

পরদিন কাক ও বক টিয়ের স্কুলে ভর্তি হতে গেলো। টিয়ে পাখির চমৎকার আচরণে দু’জনেই মুগ্ধ হলো। বুঝতে পারলো টিয়ে শিক্ষক হিসিবে সত্যিই অসাধরণ হবে। টিয়ে পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে জীবন গঠনের পরামর্শ দিতে লাগলো।

  কিছুদিন পর কাক ও বক নিজেদের মধ্যে ঘটা ঝগড়ার কথা টিয়েকে জানালো। টিয়ে প্রথমে খুব মন খারাপ করলো। সে পরামর্শ দিলো ঝগড়া করা কখনোই ভালো নয়। আর উচিত নয় একজন আরেক জনকে হিংসা করা। অহংকার করাও ভালো নয়। এতে পতন ডেকে আনে।

হাসি হাসি মুখ করে সে কাক ও বককে বললো তুমি কাক আর তুমি বক। তোমাদের জন্মগত যে বৈশিষ্ট্য সেটাই ধারণ করছো। তোমরা কেউ কারো চেয়ে মন্দ কিংবা ভালো নও। কাকের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা যেমন দরকার ঠিক তেমনি দরকার বকের ধীরতা স্থীরতা ও নম্রতা। আমরা সবাই যদি কঠিন ও সবাই যদি নরম হয়ে যাই তাহলে পৃথিবী টিকবে না। নরম ও গরমের মিশ্রণেই পৃথিবী টিকে থাকবে। এখানেই জীবনের বৈচিত্র্য।

তারপর কাক ও বক একে অপরের বন্ধু হয়ে গেলো।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ