রবিবার ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

বিশ্বে প্রয়োজন আস্থা ও সংহতির পুনরুজ্জীবন

আমাদের প্রিয় এই পৃথিবীটা কি এগিয়ে যাচ্ছে, নাকি পিছিয়ে পড়ছে? এমন প্রশ্নের সহজ জবাব নেই। রহস্যের গন্ধ তো পাওয়াই যাচ্ছে। বিষয়টা আসলে কি রহস্যের, নাকি সত্যানুসন্ধানের অনীহা কিংবা সত্য গোপনের ভ্রষ্টতা? পৃথিবী এগিয়ে যাওয়া বলতে আমরা কি বুঝি? কতিপয় দেশের এগিয়ে যাওয়া? বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চর্চা তথা পরাশক্তির সক্ষমতা বৃদ্ধি? সৌরজগতে পরিভ্রমণ-বিলাস কিংবা মারণাস্ত্রের ধ্বংস ক্ষমতা বৃদ্ধি? এসব যদি এগিয়ে যাওয়ার মানদন্ড হয়, তবে পৃথিবী তো অবশ্যই এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এমন এগিয়ে যাওয়াকে পৃথিবীর সব মানুষের অগ্রযাত্রা হিসেবে অভিহিত করা যাবে না। বরং বলা যাবে কতিপয় বিশেষ দেশের, বিশেষ মানুষের অগ্রযাত্রা। এমন খন্ডিত অগ্রযাত্রার জন্য কি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গঠিত হয়েছে, গঠিত হয়েছে জাতিসংঘ? প্রশ্ন জাগে, মানবজাতি এখন দাঁড়িয়ে আছে কোন বেলাভূমিতে? এই বেলাভূমিতে কি সব মানুষের অবস্থানের অধিকার আছে? এ কারণেই মানবাধিকারের বিষয়টি বর্তমান সভ্যতায় খুবই প্রাসঙ্গিক।

বর্তমান সময়ে মানবিকতা কিংবা মানবাধিকারের সূচকে পৃথিবীটা বেশ পিছিয়ে আছে। পৃথিবীর জলবায়ু ও ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থতিও ভালো নয়। ফলে কেমন করে বলবো, প্রগতির মহাসড়কে আছে আমাদের প্রিয় এই পৃথিবী। সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীতে কিছু শীর্ষ সম্মেলন ও শীর্ষ বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। ওইসব সম্মেলন ও বৈঠক থেকে কেমন বার্তা পাওয়া গেল? গত ৬ সেপ্টেম্বর ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোট ‘আসিয়ান’-এর শীর্ষ সম্মেলন। সম্মেলনে ‘নতুন স্নায়ুযুদ্ধের’ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং বলেন, প্রধান দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ মোকাবিলা করার সময়ে ‘নতুন স্নায়ুযুদ্ধ’ এড়ানোর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, ভারত প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলে তীব্র ভূ-রাজনৈতক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝে ইন্দোনেশিয়ায় আশিয়ানের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। সম্মেলনে চীনের প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশগুলোর মাঝে বিদ্যমান মতপার্থক্য ও বিরোধ যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে কারও পক্ষ নেওয়া, জোটের মধ্যে বিরাজমান বিরোধ এবং সম্ভাব্য নতুন স্বায়ুযুদ্ধের বিরোধিতা করার মতো বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের শক্তিমান দেশগুলোর বিরোধে জড়ানোর বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক করে দিয়েছেন লি কিয়াং। এ নিয়ে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবং জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন অংশীদার দেশের নেতাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন আসিয়ান জোটের নেতারা। জাকার্তায় বিশ^ নেতাদের এই সম্মেলনের আলোচ্য সূচিতে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান তৎপরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, দক্ষিণ চীন সাগর একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ। এটি নিয়ে জোটটির কয়েকটি সদস্য দেশের সঙ্গে চীনের বিরোধ রয়েছে।

আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনের একটা চিত্র আমরা পেলাম, পেলাম নতুন স্বায়ুযুদ্ধ নিয়ে সতর্কবার্তাও। এদিকে ভূ-রাজনীতির চালচিত্রও ভালো নয়। ৬ সেপ্টেম্বর ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে পৌঁছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জোরদার করাই এ সফরের লক্ষ্য। এছাড়া এ সফরে ইউক্রেনের জন্য আরও ১০০ কোটি ডলারের বেশি সামরিক সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দেন তিনি। গত জুন থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ জোরদার করার পর এটাই মার্কিন প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার প্রথম ইউক্রেন সফর। এদিকে ব্লিঙ্কেনের কিয়েভ সফর ও দেশটিকে সামরিক সহায়তা প্রদান নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ৬ সেপ্টেম্বর বলেন, ‘ইউক্রেনে একজন মানুষ থাকা পর্যন্ত কিয়েভের যুদ্ধে অর্থায়ন করার বিষয়ে ওয়াশিংটন পরিকল্পনা করেছে।’ এমন বক্তব্য থেকে উপলব্ধি করা যায়, বর্তমান সভ্যতায় ভূ-রাজনীতির ফলাফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে।

বলয়ের এই ভূ-রাজনীতিতে বসে নেই রাশিয়াও। গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার মহাকাশযান উৎক্ষেপণ কেন্দ্র ভস্তোচনি কসমোড্রোমে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সাথে বৈঠক করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। বৈঠকে গুরুত্ব পায় সমরাস্ত্র, ইউক্রেন যুদ্ধ ও উত্তর কোরিয়ার স্যাটেলাইট কর্মসূচি প্রসঙ্গ। বৈঠকে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মন্তব্য করেন উত্তর কোরিয়ার নেতা। তিনি পুতিনকে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, রাশিয়ার নায়কোচিত সেনাবাহিনী ও জনসাধারণ তাদের বিজয় ও ঐতিহ্য ধরে রাখবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি- যারা আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণ এবং উচ্চাকাক্সক্ষাকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে চায়, সেই শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়লাভ করবে রাশিয়ার সেনাবাহিনী ও জনগণ। এদিকে কিম জং উনকে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন পুতিন। একই সঙ্গে রাশিয়ার সাথে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক উন্নয়ন ও সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়টিও গুরুত্ব পায় পুতিন ও কিমের আলোচনায়। উপলব্ধি করা যায়, বলয়ের এই বিশ্ব ব্যবস্থায় ভূ-রাজনীতিকে কেন্দ্র করে পরস্পরকে বিনাশের আয়োজন করা হচ্ছে। এখানে শান্তির বার্তা নেই, বরং আছে শত্রু নিধনের প্রতিজ্ঞা। এমন প্রতিজ্ঞার পটভূমিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশন। নিউইয়র্কে জড়ো হচ্ছেন বিশ্বনেতারা। এ অধিবেশনে ১৪০টিরও বেশি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এবং প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। এবারের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জলবায়ু ও ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এবার সাধারণ বিতর্কের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ‘আস্থা ফেরানো ও বৈশ্বিক সংহতি পুনরুজ্জীবন : সবার শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও স্থিতির জন্য ২০৩০ সালের অ্যাজেন্ডা এবং এর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যকে ত্বরান্বিত করা।’ প্রতিপাদ্য বিষয়ের দিকে নজর দিলেই উপলব্ধি করা যাবে বর্তমান সভ্যতা ও বিশ্বব্যবস্থার সংকটগুলো কি? মানুষ তো শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি চায়। কিন্তু এই চাওয়াগুলো তো এমনিতেই এসে যাবে না। প্রয়োজন হবে মানবিক দর্শন; সঙ্গত কর্ম, উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থাপনা। এমন বাতাবরণের জন্য বিশ্বনেতাদের আচরণ ও তৎপরতায় থাকতে হবে আস্থা ও সংহতির উদাহরণ। গুরুত্বপূর্ণ এি বিষয়গুলোর অভাব এখন প্রকট। এই অভাবগুলো যারা দূর করতে পারেন, তারা সময়ের আহ্বানে সাড়া দেবেন কী?

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ