শনিবার ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

হিজাব আমার অধিকার

 মুসফিকা আঞ্জুম নাবা

আমাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি। তাই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন ও ধর্মীয় আদর্শ প্রচার প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। ‘হিজাব’ ইসলামে অপরিহার্য তথা ফরজ বিধান। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আল কুরআনের অনেক স্থানে পর্দা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসেঙ্গ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে নারীগণ!) তোমরা ঘরের মধ্যে অবস্থান করবে, অজ্ঞতার (জাহেলি) যুগের নারীদের মত নিজেদের প্রদর্শন করবে না। আর নামাজ প্রকিষ্ঠা করবে, জাকাত আদায় করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে।’ (সুরা আহযাব : আয়াত-৩৩)

হিজাব বা পর্দা মানুষকে অশুভশক্তির প্ররোচনা ও কুপ্রবৃত্তি থেকে নিরাপদ রাখে। হিজাবীরা মানুষের কুদৃষ্টি ও ফেৎনা থেকে নিরাপত্তা লাভ করেন। আর নারীদের নিরাপত্তা ও পুরুষের চারিত্রিক পরিশুদ্ধতার জন্যই নারীদের ওপর হিজাব তথা পর্দার বিধান দেয়া হয়েছে। তা যথাযথভাবে পালন করা শুধু ধর্মীয় স্বাধীনতা নয় বরং প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। এ অধিকার আমারও।

যদিও তথাকথিত নারীবাদীরা ইসলামের এই মৌলিক বিধানের সরাসরি বিরোধীতা করে আসছে। কথিত নারী প্রগতি, নারীমুক্তি, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে হিজাববিহীন খোলামেলা চলাফেরার সমাজে অবক্ষয়কে পরিকল্পিতভাবে উস্কে দেয়া হচ্ছে। আর হিজাব তথা পর্দা আল্লাহ তায়ালা নির্ধারিত অত্যাবশ্যকীয় বিধান। সর্বোপরি একজন নারী যখন বেপর্দায় চলাফেরা করে; তা শুধু নারীর জন্যই ক্ষতিকর নয় বরং তা পুরুষের জন্যও ক্ষতিকর। বেপর্দা হয়ে চলাফেরায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে নারীর ওপর। তা থেকে যুবসমাজ চারিত্রিক অবক্ষয়ে জড়িয়ে পড়ে। যা কোন দেশ, জাতি ও সমাজের জন্যই মোটেই সুখকর নয়।

পর্দা শুধু মুসলিম নারীদের মধ্যে নয় বরং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির অংশ। পর্দা সাধারণত দু’টি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। যেমন, মহিলাদের শারীরিক বিচ্ছিন্নতা এবং শরীরকে আবৃত করার প্রয়োজনীয়তা যাতে মহিলারা তাদের ত্বকের লাবণ্য রক্ষা এবং রূপ-সৌন্দর্যকে গোপন করতে পারেন।

ভারতীয় উপমহাদেশে মহিলাদের চলাফেরা এবং আচরণকে সীমাবদ্ধ করতে পর্দার অভ্যাস প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান ছিল এবং ইসলামের আগমনের সাথে সাথে এটি আরো ভালোভাবে সমাজে প্রচলিত হয়েছিল। ১৯ শতকে পর্দা হিন্দু অভিজাতদের মধ্যে প্রথাগত হয়ে ওঠেছিল। এখনো উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে পর্দা বা শালীন পোশাক ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। যা তাদের আভিজাত্যের স্মারক হিসাবে গণ্য। 

আমাদের দেশ মুসলিম প্রধান হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলামের অপরিহার্য বিধান পর্দা বা হিজাব নিয়ে অহেতুক বিতর্ক শুরু হয়েছে। তথাকথিত নারীবাদীরা পর্দা আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সমাজ-সংস্কৃতির অংশ নয় বলে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে চলেছে। সে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবেই বিভিন্ন লোকালয়ে বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্দানশীন মেয়েরা নানাভাবে নাজেহাল ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। 

এমতাবস্থায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত বিষয়টি আমলে নিয়ে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। যা নাগরিকদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি মাইল ফলক। 

হিজাব নিয়ে নানাবিধ বিতর্কের প্রেক্ষাপটে হিজাব ও বোরকা পরা নারীর সাংবিধানিক অধিকার বলে মন্তব্য করেছেন দেশের উচ্চ আদালত। এ প্রসঙ্গে আদালত বলেছেন, ‘এখানে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এবং রাষ্ট্র কর্তৃক সেই অধিকার সমুন্নত রাখা একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব’। 

এদিকে দেশের উচ্চ আদালত হিজাব ও বোরকা পরাকে ‘নারীর সাংবিধানিক অধিকার’-মর্মে মন্তব্য করলেও সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বহু শিক্ষার্থীকে হিজাব পরার ‘অপরাধে’ হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। এমনকি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়েও বিষয়টি নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বেত্রাঘাতের শিকার হওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ে (জেবি) হিজাব নিষিদ্ধ করেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়–য়া। অভযোগে বলা হয়েছে, হিজাব পরিধান করে এক ছাত্রী স্কুলের শ্রেণিকক্ষে এলে ওই প্রধান শিক্ষক ছাত্রীকে হেনস্থা করেন। তাকে বেত্রাঘাতও করেন-মর্মে অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী ছাত্রী ওই সময় উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেন।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, প্রতিদিনকার মতো সকালে হিজাব পরে বিদ্যালয়ে আসে অষ্টম শ্রেণির ঐ শিক্ষার্থীসহ ৩ জন। সকাল ১১টার দিকে অ্যাসেম্বলি শেষে ক্লাস শুরুর আগে প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়–য়া তাদের ডেকে হিজাব খুলে ফেলতে বাধ্য করার চেষ্টা করেন। 

এ সময় অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী হিজাব খুলতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে তাকে বেত্রাঘাত করেন প্রধান শিক্ষক। এ ঘটনা মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ও শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করেন। এতে কোনো প্রতিকার না পেয়ে ওই ছাত্রীর পরিবার উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন।

নিকট অতীতেই আমাদের দেশে হিজাব বা পর্দা নিয়ে কোন বিতর্ক ছিল না বরং সকল শিক্ষার্থীই নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবেই পালন করেছেন। এখনো আমরা লক্ষ্য করি হিন্দু পুরুষ শিক্ষার্থীরা ইচ্ছা হলে পৈতা বা গলায় কাঠের মালা পড়তে পারে। বিবাহিত হিন্দু মেয়েদের শাখা-সিঁদুর পড়তেও কোন বাধা নেই। খ্রীষ্টান শিক্ষার্থীরা তাদের ধর্মীয় আদর্শ মতে গলায় ক্রুস ঝোলাতেও কোন ভাবেই বাধা দেয়া হয় না। বৌদ্ধ ধর্মপ্রাণ শিক্ষার্থীদের গেরুয়া পোশাক পড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে দেখা যায়। তারা কোন ভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হন না। ব্যতিক্রম শুরু ইসলামী আদর্শের স্মারক ‘হিজাব’।

মূলত, একটি চিহ্নিত মহল এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আবেগ-অনুভূতি, বোধ-বিশ^াস, তাহজীব-তমুদ্দনকে বিশেষভাবে টার্গেট করেছে। আর এরাই হিজাবসহ ইসলামী আদর্শের স্মারকগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। ফলে হিজাব, দাড়ি-টুপি ও ইসলামী আখলাক-সুরতকে নানাভাবে নাজেহাল করা হচ্ছে। আর এই অপকর্মের মাধ্যমে এই অশুভ শক্তি একদিকে ধর্ম অবমাননা করছে; অপর দিকে করছে রাষ্ট্রীয় সংবিধানের অমর্যাদা। এমতাবস্থায় দেশের উচ্চ আদালত হস্তক্ষেপ দেশের শান্তিপ্রিয় ও ধর্মপ্রাণ মানুষের নতুন করে আশাবাদের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এতেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না বরং একটি চিহ্নিত মহল হিজাবের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। 

 

আমরা আশা করবো সরকার বা যথাযথ কর্তৃপক্ষ দেশের ধর্মীয় সংস্কৃতির অনুসরণ, সাংবিধানকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করবেন। একই সাথে অপরাধীদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় ইসলাম বিরোধী শক্তির অপতৎপরতা কখনোই বন্ধ হবে না। আর মনে রাখতে হবে হিজাব আমার অহংকার; সর্বোপরি অধিকারও।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ