বইমেলায় গল্প উপন্যাস কবিতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গবেষণার বই
স্টাফ রিপোর্টার : মননশীল পাঠকের অভাবে নিরুৎসাহিত হয় মননশীল সাহিত্য সৃষ্টি। এ যেন এক দুষ্টচক্র। মননশীল পাঠকের অভাবে মননশীল লেখক সৃষ্টি হয় না, আবার লেখকের অভাবে পাঠক হয় না। তবে গত এক দশকে দেশের পাঠক সমাজে বিরাট এক পরিবর্তন এসেছে। গল্প, উপন্যাস, কবিতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গবেষণা, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, দর্শন, সংগীত, বিজ্ঞান, ভ্রমণ ও ধর্মবিষয়ক বইয়ের পাঠকও।
দেশের ছোট-বড় সবগুলো প্রকাশনা এখন এই ধারার বই সারা বছর প্রকাশ করে। অনেকগুলো প্রকাশনা সংস্থা মূলত এই ধরনের বইকেই তাদের মূল ধারা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তৈরি হয়েছে আলাদা এবং বিশাল পাঠকসমাজ। বইমেলারও একটি বড় অংশ তারা।
বইমেলা ঘুরে দেখা যায়-গবেষণা, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাসনির্ভর বই প্রকাশ করে যেসব প্রকাশনা সংস্থা, কথাপ্রকাশ তাদের মধ্যে অন্যতম। এ বছর প্রকাশনাটি থেকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘সাতচল্লিশের দেশভাগে গান্ধী ও জিন্নাহ’, যতীন সরকারের ‘সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রত্যাশা’, সনৎকুমার সাহার ‘অর্থনীতির ন্যায় অন্যায়’, জাহীদ রেজা নূরের ‘৬ দফা থেকে স্বাধিকার’সহ উল্লেখযোগ্য সব বই প্রকাশ হয়েছে।
কথাপ্রকাশের ব্যবস্থাপক মো. ইউনূস আলী জানান, পাঠকরা আমাদের প্রকাশনাকে চেনেন গবেষণা, প্রবন্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাসবিষয়ক বইয়ের জন্য। অনেক পাঠক এসে বলেন, বাংলা একাডেমিতে এখন এ ধারার খুব ভালো বই পাই না। এ বইগুলোর আলাদা পাঠক রয়েছে। বইগুলোর বিক্রি ভালো বলেই আমরা এখন এই ধারার নানা বিষয়কে উপজীব্য করে উপন্যাস প্রকাশ করছি। লেলিন উপন্যাসটি তেমনই। ছয় বছরের চেষ্টায় উপন্যাসটি লেখা হয়েছে।
প্রথমা প্রকাশনার বইয়ের একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে প্রবন্ধ, গবেষণা, ইতিহাস। আনু মুহাম্মদের লেখা ‘অর্থশাস্ত্র ইতিহাস, দর্শন রাষ্ট্রনীতি’, বদিউল আলম মজুমদারের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রাজনীতি’, মহিউদ্দিন আহমদের ‘প্লাবনভূমির মহাকাব্য’, ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী’সহ আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করেছে তারা। এ বইগুলোর বাজারের বিষয়ে প্রথমা প্রকাশনের ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন বলেন, গবেষণা, প্রবন্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, আত্মজীবনী, অনুবাদ, ধর্মীয়, গণিত, বিজ্ঞানের বইগুলোর বিশাল পাঠকসমাজ। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এ বইগুলো শুধু মেলায় নয়-সারা বছরই বিক্রি হয়।
পাঠক সমাবেশ থেকে এবারের বইমেলায় প্রকাশ হয়েছে স্বকৃত নোমানের ‘বাংলার ইসলাম সহজিয়া ও রক্ষণশীল ধারা’। মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশ করেছে কাবেদুল ইসলামের ‘গণপরিষদ বিতর্কের আলোকে বাংলাদেশের সংবিধান জন্মকথা’, আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হয়েছে ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের ‘শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু’, সময় প্রকাশন থেকে এসেছে ‘কী চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু’, ঐতিহ্য থেকে প্রকাশ হয়েছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘সাহিত্যের নায়িকাদের তিন অধ্যায়’, মহিউদ্দিন আহমেদের ‘তেহাত্তরের নির্বাচন’ এবং ‘চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ’, অবসর থেকে প্রকাশ অপেক্ষায় আছে গোলাম মুরশিদের ‘মাইকেলের দু শো বছর’। ইউপিএল থেকে প্রকাশ হয়েছে এম ইদ্রিস আলীর ‘বঞ্চনা ও প্রান্তিকতার ইতিবৃত্ত ইসরাইলের আরব জনগোষ্ঠী’।
এদিকে গতকাল সোমবার অমর একুশে বইমেলার ১২তম দিনে বইমেলা শুরু হয় বিকেল ৩:০০টায় এবং চলে রাত ৯:০০টা পর্যন্ত। এদিন নতুন বই এসেছে ১১৫টি। বিকেল ৪:০০টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি : হেনা দাস শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জোবাইদা নাসরীন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঝর্না রহমান এবং ফওজিয়া মোসলেম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার।
প্রাবন্ধিক বলেন, হেনা দাস আজন্ম এক প্রতিবাদী সত্তাÑএকজন শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী, ঈর্ষণীয় সংগঠক। নির্লোভ শুভ্রতার প্রদীপ হয়েই তিনি আলো ছড়িয়েছেন এবং সকল প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে মানুষের জন্য পথ উন্মোচন করেছেন। দেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং শোষণমুক্তির লক্ষ্যে একজন সার্বক্ষণিক কমিউনিস্ট কর্মী হিসেবে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। এজন্য ঔপনিবেশিক শাসন, শ্রেণি ও লিঙ্গ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। মহিলা সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, গণনাট্য সংঘ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হেনা দাস নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন।
আলোচকবৃন্দ বলেন, বিপ্লবী হেনা দাস ছাত্রজীবন থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। নারী আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন ও সামাজিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মানুষের মধ্যে থেকে আজীবন তিনি বিপন্ন মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। কোনো বাধাই তাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। সব বাধা উপেক্ষা করে দৃঢ়চিত্তে নিজের আদর্শের পথে অগ্রসর হয়েছেন হেনা দাস। বিপ্লবী চেতনার পাশাপাশি তিনি ছিলেন সৃজনশীল মননের অধিকারী একজন মানুষ। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক শিরীণ আখতার বলেন, বিপ্লবী হেনা দাস অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন সারাটি জীবন। তার প্রতিটি কাজে দৃঢ় মনোবল ও সংগ্রামী আদর্শের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। আমাদের জীবনে, মননে এবং সুন্দর সমাজ গড়ার আন্দোলনে বিপ্লবী হেনা দাস সবসময় স্মরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন। আজ লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক সালমা বাণী, কবি ফারহানা রহমান, গবেষক মিলটন কুমার দেব এবং কথাসাহিত্যিক ইকবাল খন্দকার।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি আলতাফ হোসেন, সাজ্জাদ আরেফিন, ওমর কায়সার, ইউসুফ রেজা, আসাদ কাজল, শাহেদ কায়েস এবং সারমিন মতিন মিতু। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী কাজী মদিনা, পলি পারভীন, জালালউদ্দীন হীরা। এছাড়াও ছিল নাজিয়া জাবীনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘স্পর্শ ফাউন্ডেশন’, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘কথা আবৃত্তি চর্চাকেন্দ্র’ এবং মোঃ সজীব মিয়ার পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘হাওলা’র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়া, সাইদুর রহমান বয়াতি, জহির আলীম, আবুল বাসার আব্বাসী এবং বশির উদ্দিন সরকার। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন গৌতম কুমার সরকার (তবলা), ইফতেখার হোসেন সোহেল (কী-বোর্ড), মো. হাসান আলী (বাঁশি), খোকন বাউলা (দোতারা) এবং মেহেদী হাসান রনি (বাংলা ঢোল)। আজ ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০২৪ মঙ্গলবার। অমর একুশে বইমেলার ১৩তম দিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩:০০টায় এবং চলবে রাত ৯:০০টা পর্যন্ত। বিকেল ৪:০০টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে স্মরণ : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আহমাদ মোস্তফা কামাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন হরিশংকর জলদাস এবং ফারজানা সিদ্দিকা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।