দেশ একটি নৈতিকতাহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়েছে
# বাজেট প্রণয়নে লুটেরা গোষ্ঠীর কথা শুনেছেন অর্থমন্ত্রী--হোসেন জিল্লুর রহমান # নৈতিকতাহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়েছে দেশ --ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ # খেলাপি ঋণ এখন বিজনেস মডেল হয়ে গেছে - ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ # ব্যাংকিং খাতকে আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি -আহসান এইচ মনসুর
স্টাফ রিপোর্টার : সম্পাদক পরিষদ ও সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) যৌথভাবে আয়োজিত আলোচনা সভায় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, নৈতিকতাহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়েছে দেশ। কেউ বলেছেন খেলাপি ঋণ এখন বিজনেস মডেল হয়ে গেছে। ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন কোন কোন অর্থনীতিবিদ। গতকাল সোমবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এবারের বাজেট প্রণয়নে অলিগার্ক বা লুটেরা গোষ্ঠীর কথা শুনেছেন অর্থমন্ত্রী। যারা ক্ষমতার প্রশ্রয়ে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে তাদের কথা চিন্তা করেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আবার এই বিশেষ শ্রেণির কথা চিন্তা করে অর্থনীতিতে সংস্কার ও ব্যাংক খাত নিয়ে তেমন আলোচনা করা হয়নি।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব গতবছর পর্যন্ত অর্থনৈতিক সঙ্কট স্বীকারই করেনি। ধাক্কা খাওয়ার পর এখন সমস্যার কথা বলছে। বেশিরভাগ দেশ যখন সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে আমরা নয়-ছয় সীমা আরোপ করেছি। দুর্নীতি এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। সার্বিক নৈতিকতার ব্যাপক অধপতন হয়েছে। নৈতিকতা ফিরিয়ে আনতে না পারলে সংকট আরো গভীর হবে। পরিস্থিতির উন্নয়নে প্রশাসনিক সংস্কার, ব্যাংকিং কমিশন গঠন ও অর্থনীতিবিদদের নিয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনের কৌশল নির্ধারণে পুনঃমূল্যায়ন করা যেতে পারে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, দরিদ্রদের পাশাপাশি এখন নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তরাও মূল্যস্ফীতি নিয়ে সংকটে। বাজেটে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। তবে এজন্য যে কর্মকৌশল লাগে সেটা কোথায়। কর্মসংস্থানের সংকটে থাকা যুবকদের জন্য বাজেটে কী উদ্যোগ রয়েছে? উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে সাধারণ মানুষের জন্য করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানো হয়নি। আবার মোবাইলে কথা বলার ওপর, মোটরসাইকেলে নতুন করে কর বাড়ানো হয়েছে।
পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, সৎ করদাতাদের সর্বোচ্চ স্তরের আয়কর দিতে হবে ৩০ শতাংশ। অথচ কালো টাকার মালিকরা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করতে পারবেন। এটা সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করা। ভালো উদ্যোক্তারা সব সময় চান নিয়মের ব্যত্যয় যেন না ঘটে এবং ব্যবসায়িক পরিবেশ। এক্ষেত্রে কর প্রশাসনে সংস্কার আনতে হবে। এবারে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। তবে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না। বাজেটে কিছু কাগুজে ভালো কথা আছে। আবার উদ্যোগের কমতি নেই। তবে সেটা গাছাড়া এবং অসম্পূর্ণ। কিছু শুল্ক কমানো হয়েছে।
আরেক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, প্রশাসনের সর্বস্তরে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সরকারি ব্যয়ে প্রচুর অপচয় হয়েছে। অর্থনীতিতে আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়নি। অবাধে কালো টাকার সঞ্চালন ও পুঁজি পাচার হচ্ছে। দেশ একটি নৈতিকতাহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এবারের বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। তবে স্মার্ট মানুষ যদি নীতিহীন হয়, তা আরো ভয়ংঙ্কর হতে পারে।
তিনি বলেন, সময়মতো সঠিক পদক্ষেপের অভাবে মূল্যস্ফীতি আমাদের ওপর গেড়ে বসেছে। ঠিক সময়ে বিশ্বাসযোগ্য নীতি নেয়া হয়নি। দীর্ঘদিন থেকে ভুল নীতির কারণে মৌলিক অনেক দুর্বলতা সামনে এসেছে। সঠিক নীতির অভাবে অর্থপাচার, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, রিজার্ভের ধারাবাহিক পতন, রাজস্ব আয় হ্রাস ও কালো টাকা তৈরি হচ্ছে। মৌলিক নীতিগত পরিবর্তন না আনলে এসব সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, বাজেট ঘাটতি পূরণ করতে আমরা দেশ এবং বিদেশ থেকে উচ্চ সুদে একের পর এক ঋণ নিয়েই চলেছি। ঋণ নির্ভরতা কমাতে সরকারের কোনো পদক্ষেপ আছে নাকি গা ছাড়া বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বিবেচনা করা দরকার। ঋণের ওপর নির্ভর করে এভাবে অর্থনীতি চলতে থাকলে একসময় দেউলিয়া না হলেও বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ মুহূর্তে আমাদের অর্থনীতির সব সূচক খারাপ। যতদিন এসব সূচক ভালো ছিল, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ছিল। রেমিট্যান্স ও রিজার্ভের অবস্থাও ভালো ছিল। তখন অর্থনৈতিক ত্রুটি হজম করার শক্তিও ছিল।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরো বলেন, সিংহভাগ দুর্নীতিবাজ উচ্চবিত্ত যখন সরকারের কর ঠিকমতো পরিশোধ করে না, তখন কিছু সৎ করদাতার ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দিলে তারাও আর সৎ থাকে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘খেলাপি ঋণ এখন দেশে একটা বিজনেস মডেল হয়ে গেছে। আপনি ব্যাংক থেকে ঋণ নেবেন, আর ফেরত দেবেন না, এই মডেল চলছে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, চ্যালেঞ্জিং সময়ে বাজেট দেয়া হয়েছে। অথচ এতে নতুনত্ব দেখছি না। আগের বাজেটের অংক শুধু এদিক– সেদিক করা হয়েছে। বলা হচ্ছে সংকোচনমূলক বাজেট, অথচ বাজেটের ঘাটতি তো সংকোচনমূলক মনে হয় না। আবার ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। সরকার যদি বেশি ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাত কীভাবে ঋণ পাবে। আর ব্যক্তি খাত ঋণ না পেলে কর্মসংস্থান হবে কীভাবে। এ অবস্থায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত।
সাবেক এ গবর্নর বলেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এ মুহূর্তে যা এক থেকে দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। নতুন করে ১ হাজার ২৮৫টি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এটা অর্ধেক করে দিলেই সরকারের ঋণ নির্ভরতা ও ঘাটতি কমবে। বাজেটের নীতি কৌশল ও দর্শনে বলিষ্ঠ কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না, যা এ সময়ের জন্য দরকার ছিল। এমনিতেই ব্যাংকের মরমর অবস্থা। সুশাসনের চরম ঘাটতি।
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, বাজেট করতে হবে পারফরম্যান্স নির্ভর। কিছু সংস্থা দরকার হলে বন্ধ করে দিতে হবে, কিছু সংস্থার জনবল কমাতে হবে। শুধু বাজেটের অংক এদিক-সেদিক করে কোনো লাভ নেই। কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। সূর্যের আলোর মতো স্বচ্ছ হতে হবে। তখন বাজেট যে আকারই হোক, সমস্যা হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গবর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতি যে পর্যায়ে গেছে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কেবল আইএমএফের ফর্মুলা মেনে সুদহার বৃদ্ধি, ডলারের দর বৃদ্ধি ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে হবে না। বাজার তদারকি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সরবরাহ বাড়াতে হবে। তা না করে কেবল সংকোচন করে কাজ হবে না।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকিং খাতকে আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। কেন এ অবস্থা হলো তার শ্বেতপত্র প্রকাশ করুন। তিনি বলেন, উচ্চ আয়ের তো পরের কথা, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে রাজস্ব আয় ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, শুধুমাত্র রাজস্ব সংগ্রহে ব্যর্থতার কারণে দেশ দেউলিয়া হওয়ার পথে। রাজস্ব খাত এবং আর্থিক খাত সংস্কার অর্থনীতির জন্য এই মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এ দুটি খাতের সংস্কার নিয়ে বাজেটে তেমন কিছু বলা হয়নি। তার মতে, সংস্কারের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানো বাজেটের বিষয় নয়। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য গত মাসে সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। বিনিময় হার বাজারভিত্তিক হওয়ার পথে অগ্রসর হয়েছে। বাজেট মুদ্রানীতির জন্য সহায়ক অবস্থান ঘোষণা করেছে, যা ইতিবাচক। সুদের হার আবার বেধে না দিলে এবং টাকা-ডলার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকলে আগামী ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন। তবে মূল্যস্ফীতি কমবে মানে এই নয় যে মূল্যস্তর কমবে, মূল্যবৃদ্ধির হার কমবে।
সাবেক অর্থসচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এবং দৈনিক যুগান্তরের প্রকাশক সালমা ইসলাম অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। স্বাগত বক্তব্য দেন নোয়াবের সভাপতি এ. কে. আজাদ। সমাপনী বক্তব্য দেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।