শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪
Online Edition

ভারত বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চায়

স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এগিয়ে নিতে দু’দেশের পারস্পরিক আস্থা ও ঐকমত্যের ওপর জোর দিয়েছেন উভয় দেশের সাবেক কূটনীতিকরা।
গতকাল শুক্রবার ঢাকায় আয়োজিত দু’দিনব্যাপী বাংলাদেশ-ভারত হাই কমিশনার সম্মেলনের প্রথম দিন ‘লেসন ফর্ম দি পাস্ট’ অধিবেশনে দু’দেশের সাবেক হাই কমিশনাররা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনায় অংশ নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী সিনেট হলে এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন এই ব্যতিক্রমী সম্মেলনের আয়োজন করে।
উদ্বোধনী অধিবেশন শেষে চা-চক্রে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাই কমিশনার পিনাক চক্রবর্তী বলেন, বিশ্বের একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে এ দেশে যে সরকারই এসেছে আমরা তাদের সঙ্গে কাজ করেছি। বর্তমানেও যে সরকার রয়েছে আমরা তাদের সঙ্গেও কাজ করে যাবো। এর আগে সামরিক সরকারের সঙ্গেও আমরা কাজ করেছি। পিনাক চক্রবর্তী আরো বলেন, আমরা বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী বিরোধীদল চাই। তাদের যে সকল অধিকার আছে তা তারা অর্জন করে নিতে পারবে। তিনি আরো বলেন, আমি একজন কূটনীতিক হিসেবে বাংলাদেশে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কামনা করি।
মূল অনুষ্ঠানে ১৯৮৫ থেকে চার বছর ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনারের দায়িত্ব পালন করা আই এস চাধা বলেন, দু’দেশের সম্পর্ক জোরদারে পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধি ও জাতীয় ঐকমত্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। দু’দেশেরই সৌভাগ্য যে তাদের শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্ব রয়েছে।
সাবেক হাই কমিশনার মুচকুন্দ দুবে যখন ঢাকায় দায়িত্ব পালন করেন, তখন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায়। সাবেক এই কূটনীতিকের মতে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন ‘অতীতের চেয়ে ভাল’।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার ও অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানে নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের অন্তর্ভুক্তি জরুরি বলে মনে করেন ভারতে বাংলাদেশের সাবেক হাই কমিশনার ফারুক আহমেদ চৌধুরী। এক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের ভূমিকাকেও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।
ভারতে বাংলাদেশের সাবেক হাই কমিশনার সি এম শফি সামি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক শুধু দু’দেশের জন্যই নয়, গোটা অঞ্চলের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ভারত বিশ্বে উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি। নিকট প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দিতে ভারতের জন্য সহায়ক হবে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক ‘সঠিক পথেই’ রয়েছে মন্তব্য করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, সমস্যা সমাধানে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ প্রয়োজন, যাতে অমীমাংসিত বিষয়গুলো ঝুলে না থাকে।
ভারতে বাংলাদেশের সাবেক হাই কমিশনার ফারুক সোবহান মনে করেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রত্যাশিত আস্থার সম্পর্ক গড়ে না উঠায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও তার নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। জঙ্গি দমনে যৌথ পরিকল্পনার পাশাপাশি আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ার উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, শীর্ষ পর্যায়ে নিয়মিত দ্বিপাক্ষিক সিদ্ধান্তগুলো পর্যালোচনা করে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
কলকাতায় বাংলাদেশের সাবেক ডেপুটি-হাই কমিশনার হারুন-অর-রশীদ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ‘সমান্তরাল ও ভারসাম্যপূর্ণ’ সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, সীমান্ত হত্যা দ্রুত শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা উচিত। এছাড়া তিস্তা চুক্তি ও সীমানা নিয়ে বিষয়গুলোও জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে।
সম্মেলনের উদ্বোধন সেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন,  বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্কে পূর্বে উঠা-নামা ছিল। কিন্তু বর্তমানে  মোদি সরকার এবং এর আগে মনমোহন সিং এর সরকারের সময় থেকেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ভালোর দিকে যাচ্ছে। আর এই সম্পর্ক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন হলো উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দুই দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে গতিশীলতা আসবে। তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত চুক্তিগুলোর রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে নিষ্পত্তি করতে হবে। এর মাধ্যমে দুই দেশই উন্নয়ন লাভ করবে। এই চুক্তিগুলোর সমাধানের মধ্য দিয়ে দরিদ্রতা, সীমান্ত বিরোধ, ছিটমহল সমস্যার সমাধান হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাবি ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ভারত-বাংলাদেশ শুধু ভাল প্রতিবেশী দেশ নই, ভাল বন্ধুও বটে। এই সামিটে দু’দেশের সীমান্ত সমস্যা, চোরাচালান, অর্থনৈতিক সমস্যা, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ নানা সমস্যার সমাধান বের হয়ে আসবে। ফলে দু’দেশের সর্স্পকের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি আশা প্রকাশ করেন দু’দেশের কূটনীতিকদের খোলামেলা বক্তব্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময় বর্তমান প্রজন্ম এবং নীতিনির্ধারকদের ভবিষ্যৎ কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণে পথ-নির্দেশনা প্রদান করবে। এতে দু’দেশের জনগণের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ সৃষ্টি ও কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক জোরদারে নিরাপত্তার বিষয়টিতে আরো গুরুত্ব দিতে বলেন দুই দেশের সাবেক হাই কমিশনাররা। অধিবেশনের সঞ্চালনায় ছিলেন  সম্মেলনের প্রধান সমন্বয়কারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। ঢাকায় ভারতের বর্তমান হাই কমিশনার পঙ্কজ শরণও অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। অধিবেশন শেষে দুই দেশের সাবেক কূটনীতিকরা উপস্থিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
এদিকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান সম্মেলনের বিভিন্ন সেশনে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার পিনাক রায় চক্রবর্তী, বীণা সিক্রিসহ বাংলাদেশ ও ভারতের ১৩জন প্রাক্তন হাই-কমিশনার এবং ৩ জন প্রাক্তন ডেপুটি হাই-কমিশনার বক্তব্য রাখেন। সম্মেলনে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক আশেকা ইরশাদ।
ড.  ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, একটি দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছতে গেলে তার জনগণ ৫০ কিংবা ৮০ শতাংশ শিক্ষিত হলে হবে না। শতভাগ শিক্ষিত হতে হবে। যে দেশের শতভাগ জনগণ সংবিধান পড়তে পারে না, অধিকারের কথা বলতে পারে না। সে দেশের জনগণ কিভাবে অধিকারের কথা বলবে। তাই বিষয়টি দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে প্রথমদিনে তিনটি উন্মুক্ত আলোচনা সেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ-ভারতের মোট ১৭ জন প্রাক্তন কূটনীতিক অংশগ্রহণ করেন। এই পর্বগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। প্রসঙ্গত, এই প্রথমবারের মতো ঢাকায় আয়োজিত এ ধরনের একটি সম্মেলনে দুই দেশের প্রাক্তন কূটনৈতিকগণ বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং পারস্পরিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ