সন্ত্রাসে ভারতীয় অস্ত্র
বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলায় ভারতে তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। এ উদ্দেশ্যে বিহারসহ বিভিন্ন রাজ্যে অস্ত্র তৈরির গোপন কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। এসব কারখানায় তৈরি অস্ত্র পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন জেলার মধ্য দিয়ে চোরাচালানের অবৈধ পথে বাংলাদেশের জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের হাতে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এজন্য পশ্চিম বঙ্গের মালদহ ও বর্ধমানসহ সীমান্তের নিকটবর্তী বিভিন্ন জেলায় অস্ত্র ব্যবসার ঘাঁটি বানিয়েছে ভারতীয়রা। দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ভারতীয়দের সহযোগিতায় বাংলাদেশে একটি অস্ত্র ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাদের মাধ্যমে অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। মাঝে-মধ্যেই বিভিন্নস্থানে ভারতে তৈরি অস্ত্রসহ গ্রেফতার হচ্ছে সন্ত্রাসীরা। ৩১ অক্টোবর রাতে গাবতলী থেকে ১০টি অস্ত্রসহ গ্রেফতার হওয়া এক ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের কাছে অস্ত্র তৈরির ও পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে। সে নিজেও এর সঙ্গে জড়িত।
বলা দরকার, বিভিন্ন সময়ে আলোচিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি হামলায় ভারতের অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি প্রাধান্যে এসেছিল গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের পর। গত ১ জুলাই গুলশানের এই রেস্টুরেন্টে ২০ জন দেশী-বিদেশীকে হত্যা করেছে জঙ্গি গোষ্ঠী। এরপরই বাংলাদেশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের পক্ষ থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তশেষে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা এএনআই-ও স্বীকার করেছে, গুলশানে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো ভারতের তৈরি এবং পাঠানোও হয়েছিল ভারত থেকে।
দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে আসা সকল অস্ত্র তৈরি করা হয় ভারতের রাজ্য বিহারের কিছু গোপন আস্তানায়। কোনো কোনো অস্ত্রে এমনকি বিহারের মুঙ্গের সমরাস্ত্র কারখানার সিলও পাওয়া গেছে, যার অর্থ সরকারী পর্যায়ে না হলেও ব্যক্তিগতভাবে মুঙ্গের কারখানার অনেকে এই কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে প্রশ্ন উঠেছে, সমরাস্ত্র কারখানার মালিক যেহেতু সরকার সেহেতু ভারত সরকারের পক্ষেও দায় এড়ানো সম্ভব কি-না। উল্লেখ্য, সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, সেখানে গ্রেফতার হওয়া কয়েকজন জঙ্গির কাছে জানা গেছে, বিহারে তৈরি করার পর অস্ত্রগুলো বালুর ট্রাকে করে পশ্চিম বঙ্গের বাংলাদেশ সংলগ্ন বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়া হয়। গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো পশ্চিম বঙ্গের মালদহ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাঠানো হয়েছিল। ভীতি ও আতঙ্কের কারণ হলো, এসবের মধ্যে পিস্তল ও রিভলবারের মতো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত সাধারণ অস্ত্রের পাশাপাশি একে-৪৭ ও এ কে-২২ ধরনের ভয়ঙ্কর বিভিন্ন অস্ত্র এবং গ্রেনেডও রয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতীয় অস্ত্রের বিষয়টিকে অবশ্যই যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া দরকার। কারণ, পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ এবং অ্যান্টি টেরোরিজম স্কোয়াড এটিএসসহ বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে ভারতে। দেশটির বিভিন্ন রাজ্যেরও রয়েছে নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের সন্ত্রাস বিরোধী কার্যক্রম সম্পর্কেও নিয়মিত খবরে জানা যায়। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও একই ভারতে অবৈধ কারখানায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরি হচ্ছে এবং সে অস্ত্রগুলারই একটি অংশ বাংলাদেশে পাচার হয়ে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের হাতে পৌঁছাতে পারছে- এমন খবর নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক শুধু নয়, অবিশ্বাস্য ও প্রশ্নসাপেক্ষও বটে।
গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি আমরা মনে করি, এই সত্য উভয় রাষ্ট্রের সরকারকেই বুঝতে হবে যে, জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ যে নামেই চিহ্নিত করা হোক না কেন এটা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। জঙ্গি-সন্ত্রাসীরাও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের আওতায় হত্যার মতো ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। ভারতে তৈরি অস্ত্র দিয়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার খবরও একই বিপদজনক সত্যকেই অনস্বীকার্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সুতরাং কোনো ঘটনা ঘটলেই তার জন্য এদেশের কোনো রাজনৈতিক দলকে দায়ী করার যুক্তি বা সুযোগ থাকতে পারে না। অন্যদিকে বিশেষ করে বাংলাদেশে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত এবং পরিপূর্ণরূপে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দলগুলোর দিকে আঙুল ওঠানোর আপত্তিকর তৎপরতা চালানো হচ্ছে। আমরা মনে করি, সত্যিই সন্ত্রাস দমন ও প্রতিরোধ করতে চাইলে এই প্রবণতার অবসান ঘটানো উচিত। কারণ, এর ফলে প্রকৃত জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা নিরাপদে পার পেয়ে যায় এবং জনমনে অযথা রাজনৈতিক দল সম্পর্ক প্রশ্ন ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়। অথচ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক দলগুলো প্রতিটি উপলক্ষে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা তথ্য-প্রমাণসহ অস্বীকার করেছে। শুধু তা-ই নয়, দল দু’টি সরকারের জঙ্গিবাদ বিরোধী কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন তো জানিয়েছেই, একই সাথে ওই প্রচেষ্টায় অংশ নেয়ার ও সহযোগিতা করারও ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু মূলত নিজের অশুভ কৌশল ও উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সহযোগিতার এই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। একই কারণে দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে এবং এখনো তাদের সম্পূর্ণরূপে প্রতিহত ও নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।
আমরা মনে করি, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের কোনো দেশ নেই এবং তারা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের অধীনে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে- এই সত্য অনুধাবন না করা হলে এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অযৌক্তিকভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা অব্যাহত রাখা হলে বাংলাদেশে কখনোই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন করা যাবে না। আমরা তাই আশা করতে চাই, ভারত ও বাংলাদেশের সরকার অস্ত্র তৈরি ও পাচারের বিষয়টি নিয়ে সততার সঙ্গে অনুসন্ধান চালাবে, এই কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে এবং উভয় দেশের জনগণকে প্রকৃত সত্য জানিয়ে দেবে। দু’দেশের সরকারকে একই সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র তৈরি ও বিক্রি বা পাচারের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নিতে হবে, যাতে কোনো দেশের কোনো জঙ্গি-সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পক্ষেই এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালানো সম্ভব না হয়।