শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪
Online Edition

স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জন বর্ণ : ক্রস ফায়ার কোন্ বর্ণ

জিবলু রহমান : [দুই]
এ ছাড়া তাকে নানাভাবে বর্বরোচিত নির্যাতন করে। এভাবে ৩ দিনের নির্যাতনে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ১২ নবেম্বর আদালতে নিয়ে এলে কোর্ট পুলিশ অনিতাকে না রেখে চিকিৎসা দেয়ার জন্য বললে সন্ধ্যায় তাকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকের দেয়া পরামর্শের পরও প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। প্রথমে জেল কর্তৃপক্ষ অসুস্থ আসামীকে এভাবে গ্রহণ করতে রাজি না হলেও পরে গ্রহণ করে এবং কারারক্ষীদের পাহারায় ওই দিন রাত ৯টায় ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৩ দিন হাসপাতালে চিকিৎসার পর তাকে আবার জেলহাজতে পাঠানো হয়। ১৬ নবেম্বর আবার তাকে আদালতে সোপর্দ করে ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। ওসি (তদন্ত) মনির ও এসআই আঁখির নির্যাতনের কারণে অনিতার অবস্থা বর্তমানে সঙ্কটাপন্ন বলে অভিযোগে বলা হয়। (সূত্রঃ দৈনিক মানব জমিন ২০ নবেম্বর ২০১৪)
১২ জানুয়ারি ২০১৫ রাজধানীর দক্ষিণখানের মধ্য আজমপুরে চাঁদা না দিলে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার বানিয়ে ব্যবসায়ী ফয়েজ আলী সরকারকে মামলায় আসামী করার হুমকি দিয়েছিল পুলিশ। চাঁদা না পেয়ে তাকে গুলী করে লক্ষাধিক টাকা লুটে নেয়া হয়। তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে পুলিশ এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, অবরোধের পক্ষে পিকেটিংকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা ঘটেছে। ওই এলাকার সবাই বিএনপি-জামায়াতের লোক।
ঘটনার সময় প্রতিবেশী নুরুল হাসানের বাড়ির সামনে তার সঙ্গে কথা বলছিলেন ফয়েজ আলী। হঠাৎ দক্ষিণখান থানার দুই পুলিশ সদস্যসহ উপ-পরিদর্শক (এসআই) জয়নাল দ্রুত তাদের সামনে গিয়ে ফয়েজের জামার কলার চেপে ধরে বলেন, থানায় চল। ফয়েজ অবাক হয়ে তখন জানতে চান, কি হয়েছে, আমাকে থানায় যেতে হবে কেন? একইভাবে নুরুল হাসান জানতে চান, ফয়েজের বিরুদ্ধে কিসের অভিযোগ, তাকে কেন থানায় যেতে হবে? এ নিয়ে বাগবিতন্ডার একপর্যায়ে ফয়েজের বাম কাঁধ ধরে ঘুরিয়ে কোমরের নিচে এক রাউন্ড গুলী করেন এসআই জয়নাল। জয়নালকে তখন জাপটে ধরেন নুরুল হাসান। গুলীটি ফয়েজের পা ভেদ করে ওই সড়কের এক মাছ বিক্রেতার শরীরে আঘাত করে।
চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন এগিয়ে গেলে জয়নাল পিস্তল দেখিয়ে দুই পুলিশ সদস্যসহ দ্রুত পালিয়ে যান। তাৎক্ষণিকভাবে ফয়েজকে উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। (সূত্রঃ দৈনিক মানব জমিন ১৩ জানুয়ারি ২০১৫)
ডিবি পরিচয়ে রাজু নামে এক যুবককে বাসা থেকে তুলে নিয়ে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ এনে ১৯ নবেম্বর ২০১৫ মিরপুর মডেল থানার ২ এসআই ও এক এএসআইয়ের বিরুদ্ধে পুলিশের মিরপুর বিভাগের ডিসি বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন তার মা তাসলিমা আক্তার। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, ১৪ নবেম্বর বিকালে মিরপুর থানার এসআই ইমরুল ফাহাদ ও মোয়াজ্জেম হোসেন এবং এএসআই আজীজ ডিবি পরিচয়ে সাদা পোশাকে তার ছেলে রাজুকে রামপুরা ওয়াপদা রোডের বাসা থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে মিরপুর এলাকায় তুলে নিয়ে যায়। পরে মুক্তিপণ বাবদ রাজুর স্বজনদের কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। অনেক চেষ্টা করেও এ বিশাল অঙ্কের টাকা জোগাড় করতে পারেননি রাজুর স্বজনরা। তাই ইয়াবা দিয়ে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে তাকে আদালতে চালান দেয়া হয়।
৮ ডিসেম্বর ২০১৫ রাজধানীর ভাটারায় বাসায় ঢুকে বাড়িওয়ালাকে পেন্ডিং মামলায় ফাঁসানোর ভয়ভীতি দেখিয়ে ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ তুলে ১২ ডিসেম্বর মিরপুর বিভাগের ডিসির দফতরে রূপনগর থানার ২ পুলিশের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে অভিযোগ দেন রূপনগরের ইস্টার্ন হাউজিং এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী শামসুজজোহা ফরহাদ। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা হলেন এসআই ফিরোজ ওয়াহিদ ও এএসআই মিজান। রূপনগর থানার ওসি রেজাউল হাসানের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ এনে মিরপুর বিভাগের ডিসির দফতরে ১৮ ডিসেম্বর একটি অভিযোগ দেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম বাসেত আকন্দ।
সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ, ৯ জানুয়ারি ২০১৬ রাজধানীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে মারধর ও ‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখিয়েছিল মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ। অভিযুক্ত এসআই মাসুদ সিকদারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে ১৬ জানুয়ারি পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের যোগাযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী অভিযোগ করেন, ঘটনার রাত ১১টার দিকে তিনি মোহাম্মদপুরে খালার বাসা থেকে কল্যাণপুরে নিজের বাসায় যাওয়ার সময় জেনেভা ক্যাম্পের পাশে থেকে এক পুলিশ সদস্য তার শার্টের কলার ধরে বলেন, ‘তোর কাছে ইয়াবা আছে’। তিনি অস্বীকার করলে পুলিশ কর্মকর্তাটি তাকে ধরে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাসুদ শিকদারের কাছে নিয়ে যান। এসআই মাসুদও এক পর্যায়ে তাকে জোর করে পুলিশের ভ্যানে তুলে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে গুরুতর আহত করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাকে নির্যাতনের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সিটি করপোরেশেনের এক কর্মকর্তাকে লাঠি ও বন্দুকের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে আহত করেছে পুলিশ। ১৫ জানুয়ারি ২০১৬ ভোর সাড়ে ৫টায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে মীরহাজিরবাগ এলাকায় পুলিশ ডিসিসির কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্রকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকাশ বলেন, ভোরে সাদা পোশাকের ছিনতাইকারী মনে করে গাড়ি ফেলে দৌড় দিলে পুলিশ আমাকে আক্রমণ করে। তাদের কাছে নিজের পরিচয় দেই। পরিচয় পাওয়ার পরও এসআই আশরাফ গালি দিতে থাকেন।
বিকাশ জানান, লাঠির আঘাতে মাথা ফেটে রক্ত বের হতে থাকলেও কয়েকবার আঘাত করেন এসআই আশরাফ। এ সময় পরিচয় দিলে বলে, কোথায় বলবে বল মাছের রাজা ইলিশ দেশের রাজা পুলিশ। এক পর্যায়ে আমার পকেটে ওয়্যারলেস দেখে পুলিশ আমাকে ফেলে চলে যায়।
১৬ জানুয়ারি ২০১৬ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পরিচ্ছন্নতা বিভাগের পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাসকে রাজধানীর ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালে দেখতে গিয়ে পুলিশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেছেন, পুলিশের পক্ষ থেকে ডিসিসির কর্মকর্তাকে নির্যাতনের সময়ে ‘মাছের রাজা ইলিশ দেশের রাজা পুলিশ’ বলে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তি করা হয়েছে তা একটি ভয়ানক উক্তি। দেশে যে অবস্থা চলছে তা এখনই রুদ্ধ করা না হলে, দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া না হলে দেশের সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে, যার পরিণতি ভালো হবে না।
ড. মিজানুর রহমান বলেন, বিকাশ চন্দ্র দাসকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদ-, সাংবিধানিক অধিকার এবং নির্যাতন বিরোধী আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করে পুলিশ পার পেয়ে যেতে পারে বলেই বার বার এমনটি ঘটছে। বলা হয়ে থাকে, যারাই অপরাধ করে, অভিযুক্ত সেই পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে দৃশ্যমান নয়। দৃশ্যমান কোনো উদাহরণ দেখি না আমরা। দলীয়করণও একটি সমস্যা। দলীয়করণের কারণেও অপরাধী পুলিশ সদস্যরা পার পেয়ে যায়। আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে এই দলীয়করণ করার কারণে তাদের সাত খুন মাফ হয়ে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, পুলিশের যেসব সদস্য এরকম আচরণ করছে তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিত। পুলিশের পদোন্নতি, পদায়ন ও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে সেখানে যেন মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পুলিশ নিয়োগ দেয়া হয়। আর কোনো বিশেষ জেলাকে প্রাধান্য না দিয়ে শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতে পুলিশ প্রশাসন সাজানো। পুলিশকে রাজনৈতিক-ভাবেও যাতে ব্যবহার না করা হয়।
পুলিশের পক্ষ থেকে ডিএমপির মুখপাত্র ও ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, অবৈধ অর্থ উপার্জনের জন্য কোনো পুলিশ সদস্য যদি অপরাধ, বেআইনী কমকা- করে তবে তার ব্যক্তিগত দায় হিসেবেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদের দায় পুলিশ নেবে না। তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নির্যাতনকারী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হবে কিনা এ বিষয়ে মনিরুল বলেন, তদন্ত শেষে প্রমাণিত হলেই বিভাগীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলা হবে। (সূত্রঃ দৈনিক দিনকাল ১৭ জানুয়ারি ২০১৬)
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাসের নির্যাতনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ডিএমপি কমিশনারের এক অফিস আদেশে বলা হয়, যাত্রাবাড়ী থানার এসআই আরশাদ হোসেনের নেতৃত্বে ছিনতাই প্রতিরোধ দল টহলরত অবস্থায় ছিল। ভোর সাড়ে চারটার দিকে একটি মোটরসাইকেল ওই এলাকা দিয়ে একাধিকবার যাতায়াত করলে পুলিশের সন্দেহ হয়। পুলিশের সদস্যরা মোটরসাইকেলটিকে থামার সংকেত দিলে আরোহী সংকেত অমান্য করে রাস্তায় মোটরসাইকেল ফেলে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। এতে তিনি রাস্তায় পড়ে সামান্য আহত হন। এ ঘটনায় ডিএমপি’র যুগ্ম কমিশনারকে (ট্রাফিক দক্ষিণ) প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদনে (১৭ জানুয়ারি) বলা হয়েছে, ‘তদন্ত চলাকালে ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করলেন ডিএমপি কমিশনার।’ এ থেকেই বোঝা যায় তদন্ত কতটুকু ফলপ্রসূ হবে।
দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন পুলিশের কাজ। নাগরিকের জানমাল দুর্বৃত্ত ও দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই রাষ্ট্র পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলেছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশকে সভ্যতা-শালীনতা ও মানবাধিকারের মান বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আইনের বিধি-বিধান সাপেক্ষে পুলিশকে বল প্রয়োগেরও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে পুলিশকে অবশ্যই নীতি-নৈতিকতার নিরিখে আচরণ করতে হয়। পুলিশ এমন কিছু করতে পারে না, যা নির্দোষ ও নিরীহ নাগরিকদের ভোগান্তি ও দুর্দশার কারণ হয়। যে রাষ্ট্রে পুলিশের কার্যকলাপের ওপর সভ্য সমাজের নিয়মবিধির বাধা থাকে না এবং তারা যথেচ্ছভাবে তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে, তেমন রাষ্ট্র পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে ওঠে। আমরা অনেক দেশের কথা জানি, যেখানে স্বৈরশাসকরা গুপ্ত পুলিশ দিয়ে সব ধরনের নাগরিক প্রতিবাদকে স্তব্ধ করে দেয়ার প্রয়াস পায়। এরকম রাষ্ট্রে নাগরিকরা প্রতি মুহূর্তে আতংকের মধ্যে থাকে। বিশেষ করে রাত নেমে এলে কখন গুপ্ত পুলিশের লোকেরা দরজায় কড়া নাড়বে এবং তারপর ঘরের ভেতর প্রবেশ করে তাদের তালিকাভুক্ত মানুষটিকে তুলে নিয়ে যাবে এবং তারপর কোনোদিনই সেই মানুষটির সন্ধান পাওয়া যাবে না, এমন রাষ্ট্র পুলিশি আতঙ্কের দিক থেকে শীর্ষে অবস্থান করে। এরকম রাষ্ট্রই পুলিশি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পায়।
স্বাভাবিকভাবেই জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সত্যিই কি পুলিশ বাংলাদেশের রাজা হয়ে গেছে? তাহলে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীবর্গের অবস্থান কোথায়? দেশে সংবিধান ও আইন দ্বারা গঠিত সরকারের প্রতি অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা জানানোর অধিকার প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের থাকতে পারে না। প্রশ্ন হল, পুলিশ বাহিনীর কারোর কারোর মধ্যে এরকম বেপরোয়া ভাব কেন সৃষ্টি হচ্ছে?
২০০৯ সালের ১৭ নবেম্বর বিচারপতি এএফএম আবদুর রহমান ও বিচারপতি ইমদাদুল হক আজাদ সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকার ও র‌্যাব’র প্রতি রুল জারি করেন। হাইকোর্টের ওই বেঞ্চে শুনানির সময় সরকার পক্ষ সময় চাইলে হাইকোর্ট রুলের শুনানি না হওয়া পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বা ক্রসফায়ার বন্ধের নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের ওই রুল জারির পরও ক্রসফায়ার অব্যাহত থাকায় আদালত তখন উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তদন্ত প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ৩৭ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। নিহত ৩৭ জনের মধ্যে ৩০ জন ক্রসফায়ার/ এনকাউন্টার/ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ৮ জন র‌্যাব’র হাতে, ২৪ জন পুলিশের হাতে এবং ২ জন বিজিবির হাতে নিহত হয়েছেন। এছাড়া ২ জন ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয়েছেন বলে পুলিশ দাবি করলেও তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায় এবং নিহতরা পুলিশের হেফাজতেই ছিলেন। একজনকে শ্বাসরোধে হত্যা উল্লেখ করা হয়। ৩৭ জনের মধ্যে ৯ জন বিএনপি’র নেতা-কর্মী, ৯ জন জামায়াতে ইসলামী ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা, ১ জন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, ১ জন শ্রমিক, ১ জন মোবাইল সার্ভিস সেন্টারের কর্মচারী, ৪ জন যুবক এবং ১২ জন কথিত অপরাধী ছিল।
২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের প্রশিকা ভবনের সামনে থেকে পুলিশের একজন এসআই’র নেতৃত্বে পল্লবী থানার সিভিল টিম বিএনপি’র সাবেক মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ভাগ্নে নাহিদকে তুলে নিয়ে যায়। পরে সন্ধ্যায় একটি মোবাইল থেকে নাহিদের বাবা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার জিমএম সাঈদকে ফোন করে বলা হয় নাহিদ পল্লবী থানার হেফাজতে আছে এবং তিনি যেন এসে নাহিদকে নিয়ে যান। পরে থানায় গেলে পুলিশের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলে পাঁচ লাখ টাকা দিলে আপনার ছেলেকে ছেড়ে দেয়া হবে। জিএম সাঈদ ২০ হাজার টাকা নিয়ে গেলে পুলিশ নাহিদকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়নি। ৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ যে মোবাইল ফোন থেকে যোগাযোগ করেছিল সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। নাহিদের পরিবার এরপর বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করেও তার খবর পায়নি। ৭ ফেব্রুয়ারি নাহিদের বাবা পল্লবী থানায় গেলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে যেতে বলেন। এরপর মর্গে যেয়ে জিএম সাঈদ তার ছেলে নাহিদের গুলীবিদ্ধ লাশ দেখতে পান।
২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ভোররাত আনুমানিক চারটায় যশোর জেলার মণিরামপুর থানার একজন এএসআই যুবদলের দুই কর্মী ইউসুফ আলী এবং লিটনের লাশ যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, এরা পেট্রোলবোমা ছুড়তে যাবার সময় ট্রাকচাপায় মারা গেছেন। ইউসুফের বাবা আবদুল আজিজ বলেন, ২ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী একদল লোক বাড়ি থেকে ইউসুফকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। ইউসুফের মা রওশন আরা বলেন, ছেলের খোঁজে মণিরামপুর থানায় গিয়ে জানতে পারি আমার ছেলে যশোর হাসপাতালে। হাসপাতালে এসে ছেলের মৃতদেহ দেখতে পাই। রওশন আরা দাবি করেন, পুলিশই তার ছেলেকে ধরে নিয়ে খুন করেছে।
রংপুর জেলার মিঠাপুকুরে পুলিশের সঙ্গে কথিত সংঘর্ষে জেলা শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক জেলা সভাপতি নাজমুল হুদা লাবলু নিহত হয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, ৯ মার্চ ২০১৫ রাত আনুমানিক সাড়ে তিনটায় রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের বলদীপুকুর এলাকায় একদল দুর্বৃত্ত গাছ কাটছিল। এ সময় টহল পুলিশ বাধা দিলে দুর্বৃত্তরা পুলিশের ওপর ককটেল ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলী ছুড়লে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। পরে পাশের পুকুর থেকে নাজমুল হুদা লাবলুকে গুলীবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহতের বড় বোনের স্বামী মাসুদ জানান, ৮ মার্চ সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টায় পীরগঞ্জ উপজেলার শানেরহাট কালানুর শাহ্পুর গ্রামে তার বাড়ি থেকে সাদা পোশাকের ব্যক্তিরা আইন-শৃংখলা বাহিনীর লোক বলে পরিচয় দিয়ে অস্ত্রের মুখে লাবলুকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর ৯ মার্চ দুপুরে পুলিশ তাদের খবর দেয় লাবলুর লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য।
১২ এপ্রিল ২০১৫ রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টায় আনিসুর রহমান আনিস (১৮) নামে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার এক ছাত্রশিবির কর্মী, মওলানা ভাসানী ডিগ্রি কলেজে একাদশ শ্রেণীর ছাত্র আনিসুর রহমানকে গুলীবিদ্ধ অবস্থায় সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করার পর তিনি মারা যান। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ফয়সাল আহম্মেদ ও অর্থোপেডিক বিভাগের মেডিকেল অফিসার নুরুল ইসলাম জানান, পায়ে গুলীবিদ্ধ হওয়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আনিস মারা গেছেন।
সিরাজগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা (ওসি) হাবিবুল ইসলাম মানবাধিকার সংস্থা অধিকারকে জানান, ১৩ এপ্রিল হরতাল সফল করার লক্ষ্যে আগের দিন সন্ধ্যায় কয়েকজন শিবির কর্মী আনিসের নেতৃত্বে সদর থানার ওপর দুইটি ককটেল নিক্ষেপ করে। এ সময় পুলিশ ধাওয়া করে আনিসকে আটক করে। পরে রাত আনুমানিক সোয়া বারটায় আনিসকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান পরিচালনার সময় শিবির কর্মীরা শহর রক্ষা বাঁধ এলাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলী ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলী ছোড়ে। এ সময় সহকর্মীদের ছোড়া গুলী আনিসের ডান পায়ে বিদ্ধ হয়। আনিসকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। জেলা জামায়াতের আমীর শাহিনুর আলম অধিকারকে বলেন, আনিস পুলিশের গুলীতে নিহত হয়েছেন। পুলিশ আনিসকে ১২ এপ্রিল রাতে জেলা সদরের নবদ্বীপ পুল সংলগ্ন ধানবান্ধি মহল্লার ভাই ভাই মেস থেকে আটক করে নিয়ে যায়। এরপর পুলিশ গুলী করে তাকে আহত করে এবং ডাক্তাররা আনিসকে কোন চিকিৎসা না দেয়ায় তিনি মারা যান।
[চলবে]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ