রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

ফকীর ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহে মজনু শাহ-এর ভূমিকা : একটি পর্যালোচনা

নূরুল ইসলাম : বৃটিশ শাসন এদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাদের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিল প্রথম বিদ্রোহে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। মুসলমানরা দীর্ঘদিন ধরে বৃটিশ শাসন মেনে নিতে পারে নি। যা শুরু হয় স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম। এ সংগ্রামের প্রথম পদক্ষেপ ছিল ফকির-সন্ন্যাসীর বিদ্রোহ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সরকারের নথিপত্র, সাহিত্যকর্ম, সমসাময়িক রচনাবলী পরবর্তী সময়ের কিছু গবেষণাকর্ম থেকে এ বিদ্রোহ সম্পর্কে জানা যায়। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে যা ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ বিদ্রোহ সম্প্রসারণ হয়েছিল ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, ময়মনসিংহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, ও পূর্ণিয়া জেলায়। তবে সমগ্র উত্তর বঙ্গ ছিল ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের মূলকেন্দ্র। এ বিদ্রোহের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, কোম্পানী সরকারকে বাংলার প্রতিটি জেলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হয়। মজনু শাহ, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী, মূসা শাহ, চেরাগ আলী শাহ, প্রমুখ নেতার নেতৃত্বে এ বিদ্রোহ পরিচালিত হলেও বিদ্রোহের প্রধান নায়ক (হিরো) ছিল মজনু শাহ যিনি বিদ্রোহের পুরোভাগে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আলোচ্য প্রবন্ধে ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রধান নায়ক মজনু শাহের ভূমিকা আলোচনা করা হয়েছে।
পরিচয় ও প্রাথমিক জীবন : ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অবিসংবাদিত নেতা মজনু শাহ। বৃটিশ বিরোধী  আন্দোলনে (ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ) নেতৃত্বদানকারী এ মহান নেতার প্রকৃত নাম ও জন্মতথ্য জানা যায় না। কোন কোন সরকারি পত্রে তাঁকে শায়খ মজনু বলে চিহ্নিত করা হলেও শাহই তার জনপ্রিয় নাম। বিদ্রোহের পূর্বে তিনি বাংলাদেশের বগুড়া জেলার মহাস্থানগড় নামক স্থানে এসে স্থায়ী বসবাস করেন। এর পূর্বে তিনি বিহার ও অযোধ্যার সীমান্তবর্তী মাখন  নামক পল্লীর অধিবাসী ছিলেন বলে অনুমান করা হয়।১
মজনু শাহ বুরহানা তরিকার শায়খ ছিলেন। এজন্য তিনি মজনু শাহ বুরহানা নামেও খ্যাত ছিলেন। বুরহানা তরিকার প্রবর্তক বুরহান উদ্দীন বুরহানা মূলত জ্বালালিয়া তরিকার শায়খ ছিলেন। জালালিয়া তরিকা সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার শাখা বিশেষ।২ Letters from Charles Grant to Augustus Clevand and Gilbert Irouside 6th & 8th March, 1783, Revenue Dept. Consultation No. 14, dated 08.04.1783 and Public Dept. original Consultations No. 13 & 15, dated 15.03.1783. অনুসারে মজনু শাহ প্রাথমিক অবস্থায় মাদারিয়া তরিকাভুক্ত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে তিনি বুরহানিয়া তরিকাভুক্ত হন।৩
শাহ সুজা (১৬৩৯-১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ) প্রদত্ত ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের এক ফরমানে শাহ সুলতান নুরিয়া বুরহানার উল্লেখ পাওয়া যায়।৪ তিনি দিনাজপুর জেলা সদর থেকে ২৬ মাইল দূরবর্তী হেমতাবাদ থানাধীন বালিয়াদীঘিকে কেন্দ্র করে ইসলাম প্রচার করতেন। স¤্রাট শাহ সুজা সূফী নেতা শাহ সুলতান নুরিয়া বুরহানাকে সনদে বিশেষ অধিকার প্রদান করেছিলেন।৫ তিনিও বুরহানিয়া তরিকার শায়খ ছিলেন। শাহ সুজা কর্তৃক প্রদত্ত ফরমানে উল্লেখ করা হয়েছে :
Whenever you wish to go out for the guidance of the people or for travel into the cities, countries divisions and all sorts of places where you like to go according to your free will & inclinations you may take all the articles of the jews e.g.bannars, standards, flags, poles, stuffs, band, mahi and muratibs etc.
You will be entitled within the countries of Bangla, Bihar and Orissha to consficates as you like properties to which there is no heir or pirpal or rent free tenures. When you pass through any tract of the country the landlords and tenants will supply you with provisions.
You will also be able for the good of mankind & the faith of Islam to be guided by the learned people. No less contribution of any kind will be .৬
বুরহানা ফকির তথা সূফী সাধকদের প্রভাব প্রতিপত্তির একটি একটি অনন্য দলিল। ফকীর নেতা মজনু শাহ ছিলেন এই তরিকা বা খান্দানেরই যোগ্য উত্তরসূরী। সমকাল হিন্দু কবি পঞ্চানন দাসের কবিতায় পূর্বোক্ত সনদে বর্ণিত শাহ সুলতান নুরিয়া বুরহানার প্রভাব প্রতিপত্তির মতই। তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী মজনু শাহের প্রভাব প্রতিপত্তির বিষয়ে প্রায় হুবহু বর্ণনা পাওয়া যায়।৭ ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি তারিখে ভারতের গভর্নর জেনারেলের নিকট লিখিত একটি সরকারী পত্রে মজনু শাহ সম্পর্কে লিখা হয় : a famous leader of the Sannyasies or badithi. ২৪ তারিখের অপর এক পত্রে- leader of the beggar-banditi বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে তাঁর নেতৃত্বের বিষয়টি প্রমাণিত হয়।৮ মজনু শাহের নেতৃত্বে পরিচালিত এ বিদ্রোহকে অনেকে ‘কৃষক বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেছেন।৯ ভারতের সরকারি ইতিহাস ও গেজেটিয়ার রচয়িতা Sir W. W. Hunter লিখেছেন :
বিদ্রোহীরা অন্য কেহ নয়, এরা হল মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংসপ্রাপ্ত সৈন্য বাহিনীর বেকার ও বুভুক্ষ সৈন্যরা এবং জমিহারা-গৃহহারা বুভুক্ষ কৃষকের দল। এ অন্নবস্ত্রহীন বেকার সৈন্য ও কৃষক উভয়ই জীবিকা নির্বাহের এ শেষ উপায়টি (বিদ্রোহ) অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছিল। এরাই তথাকথিত গৃহত্যাগী ও সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীরূপে দলবদ্ধ হয়ে সমগ্র বঙ্গ দেশে ঘুরে বেড়াত। এদের সংখ্যা এক সময় পঞ্চাশ হাজার পর্যন্ত উঠেছিল।”১০
Edware Thompson & G.T. Garratt ঐতিহাসিক বিদ্রোহ সম্পর্কে বলেন : বিদ্রোহীদের প্রকৃত পরিচয় যাই হোক না কেন তাদের বিদ্রোহ হেস্টিংসের সময়ে সর্বাপেক্ষা রহস্যময় ঘটনা। হেস্টিংস তাদেরকে হিন্দুস্থানের যাযাবর নামে অভিহিত করেছেন। তিনি যে কয়েকটি মিথ্যা ধারণার সৃষ্টি করে গেছেন এটি তার মধ্যে অন্যতম। ... বিদ্রোহীদের অভ্যুত্থান আজও রহস্যাবৃত এবং ভারতবাসীদের দিক থেকে এ রহস্য উদ্ঘাটন করে এর নির্ভুল ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।১১
১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মজনু শাহ্্ ও তাঁর খলিফাগণ বৃটিশ বিরোধী অসংখ্য অভিযান পরিচালনা করেন। তন্মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযান ও অপারেশন সম্বন্ধে আলোকপাত করে তাঁর জীবন-বৃত্তান্তের সম্পূর্ণতা প্রদানের চেষ্টা করা হলো :
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রথম অভিযান পরিচালিত হয় ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় ইংরেজ কুঠির উপর। এ আকস্মিক আক্রমণে কুঠির ইংরেজ বণিকগণ ভয়ে এরূপ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে যে, আক্রমণকারীদের কোনরূপ বাধা দেয়ার চেষ্টা না করে তারা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য সমস্ত ধন সম্পদ ফেলে কুঠির পিছন দরজা দিয়ে অন্ধকারে নৌকাযোগে পলায়ন করে। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহীরা আবার রামপুর-বোয়ালিয়ার কুঠি আক্রমণ করে ইংরেজ বণিক ও স্থানীয় জমিদারদের সকল সম্পত্তি লুণ্ঠন করে। এ দুটি বিদ্রোহের নেতৃত্বে কে ছিলেন তা পুরোপুরি জানা যায় না। সম্ভবত কোন সন্ন্যাসী বা ফকির নেতা বিদ্রোহীদের সংগঠিত করে এ আক্রমণ পরিচালনা করেছিলেন।
মজনু শাহের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী ফকিরদের আক্রমণ পরিচালিত হয় ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে। ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে উত্তর বঙ্গ ও নেপালের সীমান্তে ইংরেজ বণিকদের প্রতিনিধি মার্টেল বহু লোকজনসহ কাঠ কাটতে গেলে মজনু শাহের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীরা তাদের সকলকে বন্দি করে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেন।১২ এ ঘটনার পর রংপুরে মোতায়েনকৃত ক্যাপ্টেন ম্যাকেঞ্জির নেতৃত্বাধীন এক বিশাল সৈন্যবাহিনী বিদ্রোহীদের দমনের জন্য আগমন করেন। মজনু শাহের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী বাহিনী শত্রু পক্ষের শক্তি দেখে গভীর জঙ্গলে পলায়ন করে। সেনাপতি ম্যাকেঞ্জি সুবিধা করতে না পেরে ফিরে যান এবং ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে আরো এক বিশাল বাহিনী নিয়ে পুনরায় এ অঞ্চলে ফিরে আসলে বিদ্রোহীরা যুদ্ধ এড়িয়ে উত্তরে সরে যায়। শীতের প্রারম্ভে বিদ্রোহীরা ইংরেজ বাহিনীর উপর আক্রমণ আরম্ভ করে। বিদ্রোহীরা রংপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়। অপরদিকে ইংরেজ বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করার জন্য লেফটেন্যান্ট কিথ বহু সৈন্য সামন্তসহ ম্যাকেঞ্জির বাহিনীর সাথে যোগদান করেন। শত্রুর শক্তি দেখে বিদ্রোহীরা আবার পশ্চাৎপদসরণ করে ইংরেজ বাহিনীকে আরো গভীর জঙ্গলের ভিতর টেনে নিয়ে যায়।
১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে নেপালের সীমান্তে মোরঙ্গ অঞ্চলে বিদ্রোহীরা তাদের সমস্ত শক্তি সংহত করে ইংরেজ বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ অতর্কিত আক্রমণে ইংরেজ বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। সেনাপতি কিথ বহু সৈন্যসহ এ যুদ্ধে নিহত হয়।১৩
১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের যুদ্ধে পরাজয়ের পর শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ভীষণ ত্রাসের সৃষ্টি হয়। বিদ্রোহীদের এ ব্যাপক বিদ্রোহ দমনের জন্য ইংরেজ সরকার দেশের বিভিন্ন জেলায় এ অঞ্চলে সুপারভাইজার নামক একদল কর্মচারী নিয়োগ করে তাদের মাধ্যমে বিদ্রোহীদের গোপন সংবাদ সংগ্রহের চেষ্টা করে। কিন্তু এতেও কোন ফল হয়নি বরং নতুন নতুন অঞ্চলে বিদ্রোহীরা ছড়িয়ে পড়ে।
১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর বিদ্রোহীরা উত্তরবঙ্গে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য দিনাজপুর, বগুড়া, জলপাইগুড়ি জেলার বিভিন্ন স্থানে মাটির প্রাচীর ঘেরা দুর্গ নির্মাণ করে। এদের মধ্যে প্রাচীন শহর মহাস্থানগড় ও পৌন্ড্রবর্ধনের দুর্গ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মহাস্থানগড়ের দুর্গটি চারদিকে খাড়া পাহাড়ে ঘেরা। বিদ্রোহীরা এ প্রাকৃতিক দুর্গটিকে আরো সুরক্ষিত করে তোলে।১৪ ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে মজনু শাহের পরিচালনাধীন আড়াই হাজার বিদ্রোহী সৈন্যের সাথে লেফট্যান্যান্ট টেলর ও লেফট্যান্যান্ট ফেন্টহাম পরিচালিত এক বিরাট ইংরেজ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মজনু শাহ মহাস্থানগড়ের সুরক্ষিত দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এরপর তিনি বিদ্রোহের প্রয়োজনে বিহার গমন করেন।১৫
বিহার গমনের কয়েক মাস পর মজনু শাহ পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি দেশের সকল শ্রেণী, এমনকি জমিদারগণও যাতে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয় সে প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। তাঁর এ প্রচেষ্টায় ইংরেজ সরকারের বহু কর্মচারী বিদ্রোহীদের সাহায্যে অগ্রসর হয়। অনেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। এ পর্যায়ে মজনু শাহ বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে দেশের ধনী ও জমিদারগণ যাতে জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয় তার জন্য চেষ্টা চালায়। এ সম্পর্কে তৎকালীন বাংলার বৃহত্তর জমিদারীগুলোর অন্যতম নাটোরের জমিদার রাণী ভবানীর নিকট লিখিত মজনু শাহের একখানি পত্র বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পত্রখানি নিম্নরূপ:
আমরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে ভিক্ষা করিতেছি এবং বাংলাদেশেও বরাবর আমাদের অভ্যর্থনা জানাইয়াছে। .... আমরা কাকেও গালি দিই না অথবা কোন লোকের গায়ে হাত তুলি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের ১৫০ জন নির্দোষ ফকিরকে হত্যা করা হয়েছে।... তাদের পরিধেয় বস্ত্র, এমনকি খাদ্যদ্রব্য পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এ সকল গরীব লোককে হত্যা করে কি লাভ হয় তা বলার প্রয়োজন নাই। পূর্বে ফকিরেরা ভিক্ষা করে বেড়াত, এখন তারা দলবদ্ধ হয়েছে। ইংরেজরা তাদের এ ঐক্য পছন্দ করে না, তারা ফকিরদের উপাসনায় বাধা দেয়। আপনিই আমাদের প্রকৃত শাসক, আমরা আপনার মঙ্গলের প্রার্থনা করি। আপনার নিকট হতে আমরা সাহায্য লাভের আশা করি।১৬
১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাস হতে নাটোর অঞ্চলে মজনু শাহের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা বিশেষ সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা এ অঞ্চলের জমিদার এবং ইংরেজ শাসকদের অনুচরদের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করত এবং তাদের বেঁধে নিয়ে গিয়ে কৃষকদের উপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিত। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের ২২শে জানুয়ারি রাজশাহীর সুপারভাইজার এক সরকারী পত্রে লিখেছেন, ‘বুরহানা ফকির মজনু শাহ বহু সংখ্যক লোকজন নিয়ে পরগণায় প্রবেশ করে একজন প্রধান ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে বন্দি (জিম্মি) করে রেখেছেন’।১৭ এ বাহিনীতে বহুসংখ্যক ফকির রয়েছে, তাদেরকে প্রতিহত বা মোকাবিলা করা কঠিন।১৮
১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মজনু শাহ ৭০০ লোকের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে দিনাজপুরের মেসিদা নামক স্থানে আস্তানা গড়ে তোলে। তিনি সেখানকার জমিদারদের নিকট পাওনা অথবা রাজস্ব বাবদ ১৫০০/- দাবি করেন এবং জমিদারদের গ্রেফতার করে ধরে আনার জন্য দুইশত ফকিরকে প্রেরণ করেন। কিন্তু জমিদারের পলায়নের খবর পেয়ে এ ফকির দল প্রায় ৩০ মাইল দূরবর্তী লেম্বরবাড়িয়া পর্যন্ত উক্ত জমিদারকে ধাওয়া করে। ফকির বাহিনী ঐ পরিমাণ অর্থ উক্ত জমিদারের কাচারি থেকে আদায় করে। এ সময় থেকে ফকির বাহিনী সেখানকার সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ফলে বিদ্রোহের আঘাতে এখানে সরকারি শাসনব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে এবং শত অত্যাচার উৎপীড়ন সত্ত্বেও রাজস্ব আদায় প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্রোহীরা বহু স্থানে ইংরেজ সরকারের সংগৃহীত রাজস্ব লুণ্ঠন করার ফলে রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে যায় এবং বিহার ও বঙ্গদেশে ইংরেজদের সামরিক মর্যাদা হ্রাস পেতে থাকে। ফলে শাসকগণ বাধ্য হয়ে সকল শক্তি নিয়োগ করে বিদ্রোহের মুলোচ্ছেদ করার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
বিদ্রোহ দমনের জন্য শাসকশ্রেণী গ্রামাঞ্চলে ও শহরে নতুন নতুন আইন প্রবর্তন করে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করে। বিদ্রোহীদের গোপন সংগঠন, গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থা ও চলাচল সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহের জন্য জমিদারদের, এমনকি কৃষকদেরর আইনের দ্বারা বাধ্য করা হয়েছিল। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ঘোষণা করলেন, যে গ্রামের কৃষকগণ ইংরেজ শাসকদের নিকট বিদ্রোহীদের সংবাদ দিতে অস্বীকার করবে এবং বিদ্রোহীদের সাহায্য করবে তাদের দাস হিসাবে বিক্রয় করা হবে।১৯ এ ঘোষণা অনুসারে কয়েক সহ¯্র কৃষককে ক্রীতদাসে পরিণত করা হলো। বিভিন্ন গ্রামের বহু কৃষককে অবাধ্যতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিস্বরূপ গ্রামের মধ্যস্থলে ফাঁসিকাষ্ঠে হত্যা করে গ্রামবাসীদের ভয় দেখানোর জন্য মৃতদেহগুলো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
বিদ্রোহী বা তাদের সাথে সম্পর্ক আছে এরূপ সন্দেহ হলে যে কোন লোককে বিনা প্রমাণে ফাঁসি দেবার দৃষ্টান্তও বিরল নয়। যাদের ফাঁসি দেয়া হতো তাদের পরিবারের সমস্ত লোককে চিরকালের জন্য ক্রীতদাসে পরিণত করা হতো।২০ শাসকবর্গের এরূপ পদক্ষেপের ফলে বিদ্রোহ সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়ে পড়ে। ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছোটখাট কয়েকটি আক্রমণ ছাড়া বিদ্রোহীদের তেমন কোন তৎপরতা আর দেখা যায়নি।
১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ হতে পুনরায় বিদ্রোহী শুরু হয়। এ সময় মজনু শাহ উত্তরবঙ্গে ফিরে এসে বিদ্রোহীদের আবার সঙ্ঘবদ্ধ করার ও নতুন লোক সংগ্রহের চেষ্টা করেন। দিনাজপুর জেলায় মজনু শাহের উপস্থিতির সংবাদে শাসকবর্গ এতই ভীত হয়েছিল যে, অবিলম্বে জেলার সকল স্থান হতে রাজস্বের সংগৃহীত অর্থ দিনাজপুর শহরের সুরক্ষিত ঘাঁটিতে স্থানান্তরিত করে রাজকোষের রক্ষিবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়।২১
কিন্তু মজনু শাহ আপাতত কিছুই করলেন না। সুতরাং ভীত-সন্ত্রস্ত শাসককর্তারা মজনুর প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে তার নিকট একটি পত্র প্রেরণ করে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য জানার চেষ্টা করে এবং তার সৈন্যদল ভেঙে দেয়ার অনুরোধ করেন। অপরদিকে বগুড়া হতে তার বিরুদ্ধে একটি বিশাল ইংরেজ বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে মজনু শাহ আপাতত যুদ্ধ এড়াবার জন্য করতোয়া নদী ও ময়মনসিংহ জেলার সীমান্ত পার হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ঘাঁটি স্থাপন করেন। [চলবে]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ