শনিবার ১৮ মে ২০২৪
Online Edition

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর

স্টাফ রিপোর্টার : মহান মুক্তিযুদ্ধের বছর, ১৯৭১ সালে বিজয়ের এই সময়ে ১২ ডিসেম্বর ছিল রোববার। সময়ের বিবর্তনে, পঁয়তাল্লিশ বছর পর দিনটি আজ সোমবার। একাত্তরের এই দিনে মুক্তিবাহিনী পাবনার ডেমরাকে হানাদারমুক্ত করেছিল। রংপুর ও সৈয়দপুরের দুটো ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া বৃহত্তর রংপুর অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ফরিদপুরের ভাটিয়াপাড়া ও সিলেটের হরিপুরে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ওপর চূড়ান্ত হামলা চালায়। এদিকে এদিন বাংলাদেশের দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে এসে থেমে ছিল মার্কিন সপ্তম নৌবহর।

সব জায়গায় পাকহানাদার বাহিনী হেরে যাচ্ছে। ভারতীয় সৈন্যদের সাথে নিয়ে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছে মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় জেনারেল নিয়াজীর ললাটে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ভাঁজ। ঢাকা সেনানিবাসে যেখানে তিনি রয়েছেন সেটা আপাতত নিরাপদ। কিন্তু বিদেশী সাহায্য না এলে তো যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এমন সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান ফোন করেছেন। নিয়াজী ফোন ধরেই বললেন, ‘কবে আসবে সাহায্য?’ গুল হাসান বললেন, ‘কোন চিন্তা করো না। আগামীকাল অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে উত্তর, দক্ষিণ দুইদিক থেকেই বন্ধুরা এসে পড়বে।’ একটু স্বস্তি পেলেন নিয়াজী। ভাবলেন তারা যে ভয় পাননি তা জানান দেয়া যাক। বিদেশী সাংবাদিকদের তিনি বললেন, ‘একটি প্রাণ জীবিত থাকা পর্যন্ত প্রতি ইঞ্চি জায়গার জন্য আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবো।’

বাংলা একাডেমি প্রকাশিত কবি আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থে এ দিনের ঘটনা তুলে ধরে বলা হয়, “বিদেশীদের নিয়ে তিনটি বিমান ঢাকা থেকে কলকাতা যায়। ছত্রীসেনা টাঙ্গাইলে নেমেছে। এদের কাছেই আত্মসমর্পণ করলো পাক সেনাবাহিনী। ছোট্ট বিমান বন্দরটি দখল করতে না করতেই ক্যারিবু বিমানের অবতরণ শুরু হলো। এলো আরো সৈন্য আর অস্ত্র। ৫৭ ডিভিশন ভৈরব পেরিয়েছে আগের দিন। এবার নরসিংদী হয়ে ঢাকার দিকে। সেদিন ঢাকায় ভারতীয় কামানের গর্জন শোনা গেলো। মানেকশ’র আবেদন বেতারে বার বার প্রচারিত হচ্ছে- ‘বাঁচতে চাইলে আত্মসমর্পণ করো। আত্মসমর্পণ করলে সব পাকসেনা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী মর্যাদা পাবে।”

পাকিস্তান যেমন একদিকে সমর সাহায্যের প্রতীক্ষায় ছিল। তেমনি অপরদিকে তাদের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা কিসিঞ্জার ১১ ডিসেম্বর রাশিয়ার ওয়াশিংটন প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে ডেকে হুঁশিয়ার করে বলেন, পরদিন মধ্যাহ্নের আগে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা মুখ থুবড়ে পড়ে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের দীর্ঘ বক্তব্যের পর অধিবেশন মুলতবি হয়ে যায়।

এদিন লন্ডনের সান্ডে টাইমস পত্রিকায় তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাংবাদিক নিকোলাস ক্যারল-এর নেয়া ঐ সাক্ষাৎকারে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “আমি সংসদে এবং জনসভায় অনেকবার পরিষ্কারভাবে বলেছি, আমাদের কারো কোনো ভূখ- দখল করার ইচ্ছা নেই। পাকিস্তান যে সকল অঞ্চল জোর করে দখল করে রেখেছে, তুমি নিশ্চয়ই জানো, তা ভারতেরই অংশ সে অঞ্চলগুলোর ওপরও একই নিয়ম বর্তাবে। ....বাংলাদেশে, তাদের নেতা শেখ মুজিবকে বিশেষভাবে প্রয়োজন। ভারত কি করছে জানো, তাকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে।” 

ওই সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে ইন্দিরা গান্ধী আরো বলেন, “তাদেরকে (যুক্তরাষ্ট্র) অবশ্যই বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির কথা স্বীকার করতে হবে। তাদেরকে পাকিস্তানের বাস্তব পরিস্থিতিকেও স্বীকার করতে হবে। একটি দূরবর্তী দেশ অন্য একটি দেশকে যেমন সমর্থন দিয়ে সুবিধা করতে পারে না তেমনি অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এটা কোনো একটা দেশের সরকারের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে, কিন্তু সে দেশের জনগণের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা যদি প্রযোজ্য না হয়, তাহলে সে সরকার কখনো শক্তিশালী হবে না। যতই সামরিক বাহিনীর সমর্থন থাকুক না কেন, এটা আমাদের ব্যাপার নয়, এটা তাদেরই ব্যাপার। এটা পাকিস্তানেরই ব্যাপার।”

এদিন টাঙ্গাইলের অব্যবহৃত বিমানবন্দর ব্যবহার করে নামানো হয় ভারতীয় সেনা। ঢাকায় চারদিক ঘিরে মুক্তিযোদ্ধারা, মুক্তিসেনারা ঢাকা দখলের জন্য অবস্থান নেয়। এ সময় ঢাকা রক্ষার শেষ চেষ্টাও পাকিস্তানী শাসকদের হাতছাড়া হয়ে যায়। এ বিষয়ে রাও ফরমান আলী লিখেছেন, ঢাকাকে রক্ষার গুরুত্ব যখন অনুধাবন করা হয় ততক্ষণ ফ্রন্ট লাইনগুলো থেকে ঢাকায় কিছু ট্রুপস (সেনাদল) পাঠানোর জন্য নবম ও ষোড়শ ডিভিশনের কাছে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু ফেরির অভাবে এবং আকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কোনো উদ্যোগ নেয়া যায়নি। এদিন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয় দ্বিতীয়বারের মতো। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এতে ভেটো দেয়।

সকালেই মুক্ত হয়ে গেছে নরসিংদী। গত তিন দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ৫টি ব্যাটালিয়ন, দুইটি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ও ৫৭ ডিভিশনের টেকনিক্যাল হেডকোয়ার্টার মেঘলা অতিক্রম করে। সূর্যাস্তের আগেই জামালপুর ও ময়মনসিংহ থেকে ভারতীয় জেনারেল নাগরার বাহিনী চলে আসে টাঙ্গাইলে। বিমান থেকে অবতরণ করা ছত্রীসেনারা নাগরার বাহিনীর সাথে মিলিত হয়। মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে হানাদারদের প্রচ- যুদ্ধ হয়। হানাদাররা এখানে মরিয়া হয়ে লড়াই করে। তাদের হাতে ১৫ জন ভারতীয় সৈন্য এবং ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। এ সময় মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর হাতে এক মেজরসহ পাকবাহিনীর ১৯ জন ধরা পড়ে। নবাবগঞ্জের পোড়াগ্রামে প্রচ- সংঘর্ষ হয় হানাদার ঘাতকদের সঙ্গে। ফেনী থেকে চট্টগ্রাম যাবার পথে কুমীরা শত্রু ঘাঁটির হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আগমনের খবর পেয়ে বগুড়ায় ঘাতকরা শহরের এতিমখানা থেকে এলোপাতাড়ি গোলাবর্ষণ করে। বেশ কিছু নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায় এই বেপরোয়া গুলীবর্ষণে। এদিন নীলফামারী হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত হয়।

এদিকে নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন এদিন অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ভারতকে পাকিস্তান ছেড়ে যেতে বলেন। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মাতৃভূমি রক্ষায় শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে সংকল্পবদ্ধ। তিনি ঘোষণা করেন, কোনো শক্তি নেই পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারে।’ চীনা রাষ্ট্রদূত চ্যাং তুং নূরুল আমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এদিন। পিডিপি নেতা মাহমুদ আলীও উপস্থিত ছিলেন এ সময়। পরে নূরুল আমিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করেন। একই দিন রেডিও পিকিং ঘোষণা করে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের মাধ্যমে পাকিস্তান আক্রমণ করে মূলত চীনকেই দমন করতে চায়। বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার ভারতের মাধ্যমে তথাকথিত ‘বাংলাদেশ’ সমর্থনের অন্যতম কারণ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ