মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪
Online Edition

পঞ্চগড়ে অনাবাদি জায়গা ছাড়িয়ে ফসলি জমি দখল করছে চা

পঞ্চগড়ে সমতল এলাকায় চাষ করা একটি বাগান থেকে চা পাতা উত্তোলন করছে নারী শ্রমিকরা

ইবরাহীম খলিল পঞ্চগড় থেকে ফিরে : এক সময় পঞ্চগড়ে কেবল অনাবাদি জমিতেই চায়ের চাষ করা হতো। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ের চাষীরা চা চাষের মজা বুঝে ফেলায় ফসলি জমিতেও চায়ের চাষ শুরু হয়েছে ব্যাপকহারে। এমনও হচ্ছে যে, উচু-সমতল ছাড়িয়ে নিম্নাঞ্চলেও চায়ের চাষ করা হচ্ছে দেদারছে। বিশেষ করে যেসব জমিতে অধিক বৃষ্টিপাত হলে পানি জমে সেসব জমিতে চা চাষ শুরু করেছে। আগে এসব জমিতে ধান কিংবা আখ বা অন্য কোন ফসল করা হতো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্যান্য এলাকার তুলনায় ফলন বেশি এবং উৎপাদিত চা পাতা বিক্রি সহজ হওয়ার কারণেও চা চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে। সিলেট ও চট্টগ্রামে প্রতি হেক্টরে গড়ে সাড়ে ৩ মে. টন ফলন হলেও তেঁতুলিয়া-পঞ্চগড়ে প্রতি হেক্টরে গড়ে প্রায় ৬ মে. টন কাঁচা চা পাতা উৎপাদিত হচ্ছে। এছাড়া নতুনভাবে বাগান তৈরির জন্য ক্ষুদ্র-প্রান্তিক চাষিদের চা চারা ও ঋণ দিয়ে দিয়ে সহায়তা করছে বিভিন্ন সংস্থা।
এদিকে সবুজ চা চাষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চগড়ে আখ ও আনারস চাষ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। আখের অভাবে পঞ্চগড় জেলায় একমাত্র ভারী শিল্প পঞ্চগড় সুগার মিলস লিমিটেডের উত্পাদন কমে গেছে। কৃষকদের আখের উৎপাদনে রাখতে চিনিকলের কর্মকর্তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান বলে জানা গেছে। ঋণ, ভর্তুকিসহ নানা সুবিধা দিয়ে আখ চাষের জন্য আগ্রহ সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে এশিয়ান হাইওয়ে দিয়ে তেঁতুলিয়ার দিকে কিছু দূর এগুলেই রাস্তার দুই পাশে বিস্তির্ণ ধান ক্ষেত আখ ক্ষেতের মাঝখানে চায়ের ক্ষেত চোখে পড়বে। ফসলি জমির মাঝখানে সব গাছের মাথা সমান কাটা থাকায় ছোট ছোট চা বাগান বা চায়ের ক্ষেত সবার নজর কাড়ে সহজেই। এলাকার দৃশ্য দেখলে সহজেই বোঝা যায় যেসব ছোট ছোট জমিতে এখন চায়ের গাছ লাগানো হয়েছে। এসব জমিতে আগে ধান কিংবা অন্য কোন ফসলের চাষ করা হতো। কয়েক বছর আগেও এই রাস্তা দিয়ে বাংলাবান্ধা যাওয়ার পথে চায়ের বাগান দেখা যেত না। কিন্তু এখন এই রাস্তায় তেঁতুলিয়া যাওয়ার পথে কয়েকটি প্লট পরপরই চোখে পড়ে ছোট বড় চায়ের ক্ষেত। ধানক্ষেত আখ ক্ষেতের ফাঁকে সারি সারি চা গাছের দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য মনযোগ আকর্ষণ করে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পরীক্ষামূলকভাবে চায়ের গাছ লাগিয়েছেন অনেকে। কৃষকরা বলছেন, বাড়ির পাশে কয়েক শতাংশ জমিতে তারা চা চাষ শুরু করেছেন। সুফল পেলে চাষ বাড়িয়ে দিবেন।
পঞ্চগড়ের কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এজেলায় চা চাষে বিপ্লব ঘটে গেছে। এ বিপ্লবের ছোঁয়া লেগেছে পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট দিনাজপুরসহ অন্যজেলাতেও। চাষীরা মনে করছেন, চা বাগান থেকে দীর্ঘ মেয়াদি লাভ পাওয়া যায়। একটি বাগান তৈরি করতে পারলে এর সুফল পাওয়া যায় এক শ’ বছর পর্যন্ত। একারণেই মূলত চাষীরা অন্য ফসলের স্থলে চায়ের চাষ করতে মনোযোগী হচ্ছে। চা চাষের জন্য কৃষকরা কৃষি অফিসে আগের চেয়ে অনেক বেশি ভীড় করছেন বলেও জানালেন কৃষি বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। চায়ের সঙ্গে কৃষকদের জড়িয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে চা বিক্রি সহজ হওয়া। আগে বিভিন্ন কোম্পানি চায়ের বাগান করে নিজেরাই বিপনন করতো। চাষীদের বিপনন করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে পঞ্চগড়ে ৪টি চায়ের ফ্যাক্টরি হয়ে গেছে। ফলে, প্রতি সপ্তাহে চাষীরা বাগান থেকে কচি পাতা সংগ্রহ করে স্থানীয় ফ্যাক্টরিতে বিক্রির করতে পারেন তারা।
প্রসঙ্গত,দেশের মানুষ আগে জানতেন যে, কেবল পাহাড়ি অঞ্চলে চায়ের চাষ হয়। সমতল জমিতে কোনভাবেই চা চাষ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু পঞ্চগড়ে সমতল ভূমিতে চা চাষ শুরু হওয়ায় অনেকেই আশ্চর্য্য হতেন। এবং তা দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পঞ্চগড়ে যেতেন।
তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গির আলম জানান, চা চাষের জন্য প্রয়োজন পড়ে অ্যাসিডিক মাটি অথাৎ অম্ল মাটি। যেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে কিন্তু পানি জমে থাকবে না। তবে এই কৃষি কর্মকর্তার আশংকা এবছর পঞ্চগড় ও আশপাশের এলাকায় অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাই যারা নিচু জমিতে চায়ের চাষ করেছেন তারা ক্ষতির শিকার হতে পারেন।
পরিসংখ্যান বলছে, আজ থেকে দশ বছর আগে পঞ্চগড় জেলায় চা চাষের জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৬ শ’ হেক্টর। আর বর্তমানে এই জেলায় বছরে হাজার হাজার হেক্টর জমি চা চাষের আওতায় আসছে। কৃষিবিদরা বলছেন, এ অঞ্চলের পরিবেশ এবং মাটি চা চাষের উপযোগী আর এজন্যই চায়ের চাষও জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে চায়ের চাষ বাড়তে থাকলে কয়েক বছর পর পঞ্চগড়ে আর অন্য ফসল থাকবে না।
জেলার তথ্য বাতায়ন বলছে, ১৯৯৯ সালের জেলার প্রশাসনের উদ্যোগে পরিচালিত সমিক্ষা অনুযায়ী পঞ্চগড় জেলায় মোট ৪০ হাজার একর জমি চা চাষের উপযোগী রয়েছে। কথা ছিল অন্যান্য ফসলের মত যার যেটুকু জমি চা চাষের উপযোগী আছে তারা চায়ের চাষ করবে এবং পতি সপ্তাহে সবুজ চা পাতা ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করবে। কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই। লাভজনক মনে হওয়ায় চাষীরা নিজেদের ইচ্ছা মত চা চাষ করছে। এবং তা প্রয়োজনের তুলনা অনেক বেশি হয়ে গেছে। আশংকার কথা হলো, যে জমিতে ধান আখের চাষ হওয়ার কথা ছিল সেসব জমিতে এখন চায়ের বাগান শোভা পাচ্ছে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে পঞ্চগড়ে চা চাষে তিন থেকে চার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা আরও অনেক বেশি। চায়ের ফ্যাক্টরি হওয়ার কারণে চা চাষের পরিমাণ যেমন বাড়ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কর্মসংস্থান। এ কারণেই পঞ্চগড়ের মানুষের জীবন মান আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে।
২০০৯ সালে পঞ্চগড়ে মেড চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার কেজির মত। এরপর চায়ের চাষ যেমন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ; চায়ের উৎপাদনও বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। প্রতি বছর ব্যাপকহারে বাড়ছে চায়ের উৎপাদন।
সরকারী হিসেব অনুযায়ী পঞ্চগড় জেলায় স্মল গ্রোয়ার বা ৫ একর পর্যন্ত চা চাষী, স্মল হোল্ডার বা ৫ থেকে ২০ একর পর্যন্ত জমি চা চাষের আওতায় এমন চাষী এবং টি এষ্টেট অথাৎ যাদের যারা ২০ একরের বেশি জমিতে চা চাষ করছেন এমন চাষীর সংখ্যা ২০০টি। কিন্তু বাস্তবে পঞ্চগড়ে চা চাষীর পরিমাণ অনেক বেশি। আগে যেখানে সরকারী সহযোগিতা এবং বিভিন্ন কোম্পানির উৎসাহের কারণে চা চাষ বেড়েছে। কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই। প্রান্তিক চাষীরা চায়ের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গির আলম জানালেন- এখন যারা এক একর জমি আছে তারা বাড়ির পাশে ১০ শতাংশ জমিতে হলেও চায়ের গাছ লাগাচ্ছেন। শখ করে হলেও চায়ের চাষ হচ্ছে পঞ্চগড়ে।
তিনি জানালেন, তেঁতুলিয়া উপজেলায় মোট জমির পরিমাণ ১৮ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে চাষের জমির পরিমাণ ১৪ হাজার হেক্টর। এই স্বল্প পরিমাণ চাষের জমি খনন করে নুড়ি পাথর উত্তোলনসহ বৃহত্তর এবং ক্ষুদ্র পরিসরে বর্তমানে চা বাগান করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ফলে প্রতিবছর প্রায় ১ হেক্টর করে ধান চাষের জমি হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে তেঁতুলিয়ায় ১২৯০ হেক্টর জমিতে সবুজ চা বাগান গড়ে উঠেছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ