শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪
Online Edition

বারুণী স্নানোৎসব: সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারতের পূণ্যার্থীদের মিলন মেলা

ফটিকছড়ি সংবাদদাতা : ঐতিহ্যবাহি বারুণী স্নানোৎসবকে ঘিরে রামগড় সাবরুম সীমান্তের ফেনী নদীতে পরিণত হয় বাংলাদেশ - ভারত দু’দেশের নাগরিকদের মিলন মেলায়। উভয় দেশের হাজার হাজার পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থীর সমাগমে সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি মুখরিত থাকে ফেনী নদী। বৃটিশ আমল থেকেই চৈত্রের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশি তিথিতে প্রতিবছর ফেনী নদীতে বারুণী স্নানে মিলিত হন দুই দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ। তারা পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য তর্পন করে এখানে। রামগড় ও সাবরুম অংশে নদীর দুই তীরে দুই দেশের পৌরহিতরা সকালেই বসেন পূজা অর্চণার জন্য। পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা ছাড়াও নিজের পুণ্যলাভ ও সকল প্রকার পাপ, পংকিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে ফেনী নদীর বারুণী স্নানে ছুটে আসেন সনাতন ধর্মাবলম্বী আবালবৃদ্ধবণিতা। ১৫ মার্চ সকাল ৭টা থেকেই শুরু হয় বারুণী স্নানোৎসব। স্নান কিংবা পুজা আর্চণা ছাড়াও দুই দেশে অবস্থানকারি আত্মীয়- স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করার জন্যও অনেকে দূর দূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসেন। ঐতিহ্যবাহি এ বারুণী মেলা উপলক্ষে বহুকাল থেকেই এদিনে দুদেশের সীমান্ত অঘোষিতভাবে কিছু সময়ের জন্য উন্মুক্ত থাকার সুবাদে এপার বাংলার মানুষ ছুটে যায় ওপারের সাবরুম মহকুমা শহরে, আবার ওপারের লোক এসে ঘুরে যান রামগড়। এ মেলাকে ঘিরে দুদেশের মানুষের মধ্যে তৈরী হয় ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির মেল বন্ধন। বারুণী মেলায় শুধু বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নয়, ত্রিপুরা, মারমা, চাকমা, মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সমাগম ঘটে এখানে। বারুণী স্নান একটি ধর্মীয় উৎসব হলেও  দুদেশের বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় ও ধর্মের মানুষের সমাগমে এটি সার্বজনীন আনন্দ মেলার ঐতিহ্যে পরিনত হয়েছে। ঐতিহ্যবাহি এ বারুণী মেলা সুকমল বাবু বলেন, ‘ভারত বিভক্তির পূর্বে এখানে বারুণী মেলায় বাংলাদেশ ভারত দুদেশের দূরদূরান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল পুণ্যার্থীর সমাগম হত। পাকিস্তান আমলেও ফেনী নদীতে বারুণী মেলা বসতো। অবশ্য তখন দুদেশের সীমান্ত পারাপারের সুযোগ ছিল না। দেশ স্বাধীনের পর থেকেই এ মেলাকে ঘিরে সীমান্ত আইনের অঘোষিত শিথিলতার কারণে দুদেশের মানুষ একে অপরের সান্যিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এ মেলাটি এখন দুদেশের সংস্কৃতির অংশ হয়ে পড়েছে। ধর্মীয় রীতি পালনের পাশাপাশি দুদেশে অবস্থানরত আত্মীয় স্বজনদের দেখা সাক্ষাতেরও একটি চমৎকার ক্ষেত্র হয়েছে এ বারুণী মেলা।’ তাঁর এ কথার প্রতিফলন পাওয়া যায় মেলায় আগত কয়েকজনের সাথে আলাপ করে। এদের মধ্যে কান্তি বালা (৫০) এসেছেন  ভারতের বিলোনিয়া মহকুমা থেকে। তিনি বলেন, ‘২০ বছর পর এখানে এসেছি এক মাত্র মেয়ের সাথে দেখা করতে। মেয়ে সুরমা বালাও ফটিকছড়ি থেকে ছুটে এসেছেন ।বারুণী মেলায় মাকে দেখতে। সাবরুমের মনু বাজারের বাসিন্দা পাঁচ কড়ির সাথে কথা হয় রামগড়ে। তিনি বলেন,১৯৬০ সালে বাংলাদেশের মাটিতেই আমার জন্ম হয়। চৌদ্দগ্রামের বাতিশা গ্রামে আমাদের বাড়ি ছিল। ১৯৬৩ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় বাবা মা’র সাথে আমিও ভারতবাসী হই। জন্মভূমির মাটির ছোঁয়া আর গন্ধ নিতেই আজ বাংলাদেশে এসেছি।’ হরিণা বাজার সরকারি হাই স্কুলের শিক্ষক প্রদীপ কুমার সঙ্গে স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে এসেছেন। কুমিল্লা থেকে আসা সমীর চন্দ্র বলেন,‘সাবরুম যাচ্ছি দাদা দাদির সাথে দেখা করতে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি ভারত ছেড়ে এ দেশে চলে আসি বাবা মা’র সাথে। কিন্তু দাদা, দাদি ও কাকারা ভারতে থেকে যায়। প্রতি বছরই বারুণী মেলায় তাঁদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে এখানে চলে আসি।’  সাবরুমের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দ্বীপক দাস(সুমন) বলেন, ‘বারুণী মেলা উপলক্ষে দুবাংলার মানুষের যে মহামিলন ঘটেছে তা অভুতপূর্ব। এতে পরষ্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্ব ও আন্তরিকতা বাড়বে। তিনি বলেন, ওপারে সাবরুমে বারুণী ঘাটে এ দিনে বিশাল মেলার আয়োজন করা হয়। দুই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার মানুষ এ বারুণী মেলায় আসেন আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করতে। ফটিকছড়ি থেকে আসা সোলায়মান আকাশ বলেন,বারুনীস্নানকে ঘিরে এখানে দু দেশের নাগরিকদের মিলন মেলা বসে। এ মেলায় যোগ দিতে প্রতিবছরই ছুটে আসি। এটি একটি সার্বজনিন উৎসবে পরিণত হয়েছে।বাঙ্গালী হিন্দু ছাড়াও সনাতন ধর্মাবলম্বী  ত্রিপুরা আদিবাসী সমপ্রদায়ের অসংখ্য পুণ্যার্থীর সমাগম হয় এখানে। খাগড়াছড়ি, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা, মানিকছড়ি প্রভৃতি এলাকা থেকে এ আদিবাসী নারী পুরুষ পুণ্যস্নানে অংশ নিতে ছুটে আসেন ফেনী নদীতে। বাংলাদেশ ভারত দু’ দেশের পাহাড়ি বাঙ্গালী, বিভিন্ন ধর্ম,জাতি ও সম্প্রদায়ের আবালবৃদ্ধবণিতার বিপুল সমাগমে ফেনী নদী পরিণত হয় এক মিলন মেলায়। বারুণী মেলা উপলক্ষে দুদেশের সীমান্ত অঘোষিতভাবে উন্মুক্ত থাকায় ওপারের সাবরুম থেকে হাজার হাজার ভারতীয় বাধভাঙ্গা জোয়ারের মত ধেয়ে আসে রামগড়ে। একইভাবে রামগড় থেকেও ওপারে যান অগণিত মানুষ। রামগড় বাজারে ঘুরতে আসা সাবরুমের সুমন, রাজু, সুনিল বলেন,‘ এখানে ঘুরে মনে হচ্ছে ভারতেই আছি। কারণ চারিদিকে ভারতের লোকজনদেরকেই দেখছি।’ ভারতীয়রা রামগড় বাজার থেকে সেমাই, নারিকেল, সাবান, শুটকি মাছ ইত্যাদি কিনে নিয়ে যায়। আবার ওপারের সাবরুম থেকেও এপারের লোকজন বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে আনে। আর কেনা কাটার সুবিধার্থে রামগড় বাজারের অলিগলিতে কতিপয় লোক দুদেশের টাকা বদলের ব্যবসা করেছে। এদিকে হাটহাজারী ফটিকছড়ি সীমান্ত মন্দাকিনী খালেও বারুণীস্নানে হাজার হাজার পূণ্যার্থীদের সমাগম ঘটে। সেখানেও বিশাল এলাকা জুড়ে বসে গ্রামীণ লোকজ মেলা। আয়োজক কমিটি আগতদের বিভিন্নভাবে সেবা প্রদান নিশ্চিত করেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ