সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

দাদু-নাতির গল্প

শরীফ সাথী : দাদু ও নাতি রোজ বিকালে পাটাচোরার তীরধরার দ্বীপে গল্পের আসর বসায়। আজ রূপকথার গল্প শুনতে না চেয়ে নাতির ব্যতিক্রম আবদার। 

দাদুভাই, তুমি আজ তোমার ছোটবেলায় দেখা কিছু আমাকে বলে শুনাও না?

-নাতি ভাই কি আর বলি? শুনবি যখন তাহলে স্মৃতির পাঠ খুলে একেকটি পাতা নেড়ে নেড়ে কিছু বলে শুনাই।

খন ছিলো সবুজের সমারোহের সতেজ প্রাণস্ফুর্তিময়ের দিনকাল। নদী ভর্তি পানি থই থই। 

হরেক পাখির কিচির মিচির শব্দের মায়াবী ছন্দে জেগে ওঠা, মেতে ওঠা। মাঠের পরে মাঠ গরু-মহিষ, ছাগল ভেড়ার ঘাস খাওয়া, রাখালের বাঁশির সুর শুনে মুগ্ধ । আনন্দে আনন্দে আঁকাবাঁকা মেঠোপথের দুই ধারে সবুজ গাছ। সবুজ ঘাসের মুচকি হাসি দেখে গন্তব্যে যাওয়া, সত্যিই দারুণ বৈচিত্রের হাওয়া খাওয়া। নিভৃতে ব্যথুদের (কৃষকের) মাঠে যাওয়া। মাটির কলস ভর্তি জল, ঝুলা, কাঠা বা ধামা ভর্তি মুড়ি মুড়কি নিয়ে মাঠের (ক্ষেত খামারে) কাজ করতে যাওয়া, ভাটিয়ালি, রাখালিয়া, পল্লিগীতি, পালাগানে, জারিগানে, বাউল গানে সারা মাঠ মাতিয়ে আনন্দ মনে গাওয়া, সুখ সুখ পাওয়া। একে অপরে যেন অতি বিশ্বাসের সাথে আনন্দ উপভোগ করা। ক্ষেতের ফসল রাখা খামার পাহারা দেওয়া, চাঁদের আলোর মন ভুলানো রাতে কত না খেলা চলতো। ছোলা গম মশুরীর হুড়া (পুড়িয়ে) খাওয়া মাঠে মাঠে দলকে দল। রুপকথার গল্পে হারিয়ে যাওয়া। দাদুদের কোলে চড়ে (বসে) দৈত্য-দানব, ভূত ও পরীদের ভয়ানক! মজাদার কাহিনী শোনা, চোখে নতুনত্বের স্বপ্ন বোনা।

প্রতিদিনের আনন্দটুকু সত্যিই কি ভোলা যায়? কোটি কোটি তারাদের ঝিকিমিকি আলো, রুপালী চাঁদের পূর্ণ জোছনার মায়া ঝরানো, মমতা ছড়ানো, হৃদয়ে জড়ানো ঢেউ! ভোলে কি কেউ? দখিনা বাতাসে সবুজের দোল খাওয়া । মেঘমুক্ত আকাশে রবির মিঠা হাসি। গরু দিয়ে লাঙ্গল চাষে শ্যামল মাটির বুক চিরে টেউ তুলে চলা , নিদারুণ ছোঁয়ায় মুগ্ধ হওয়া। বাদল দিনে হৈ-হুল্লোড় করে ভিজে ভিজে ঘুরে ঘুরে এপাড়া ওপাড়া ঘুরা। লাঙ্গল কাঁধে ভাগ গরু ডা ডা গরু করে বাড়ি ফেরা। বিকেলের কোন কোন মুর্হুতে বৃক্ষডালে পাখির বাসা খুজে খুজে ডিম না কি পাখির ছানা দেখে মাঠের পর মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো । দুষ্টুমির ছলে গুলতি মেরে পাখি ঠিক করা। দল বেধেঁ এপাড়া ওপাড়া ঘুরে ঘুরে কুল পেয়ারা, জাম গাছে উঠে খাওয়া, আতা পেড়ে গমের ভূসি নয়তো কোলা বা গোলার মধ্যে পাকাতে দেওয়া হা ডু ডু ও নাকড়ি খেলার বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মাতিয়ে তোলা ? বছরে বেশ কয়েক বার নদীতে গান্ধি লাগতো। গ্রামকে গ্রাম লোকের সমাগমে নদীর পানিতে মাছ ধরার দৃশ্য মনের মণিকোঠায় স্মৃতির পালক নেড়ে উড়ে উড়ে ঘোরে । শিশু কিশোরের পাল্ল্া দিয়ে সাঁতরানো দৃশ্য দু’চোখে অফুরান। হোলিখেলা গরু-মহিশের গা ধোয়ানো । লেজ ধরে নদীর এপার ওপার করা কতনা মধুময় স্মৃতিতে মোড়ানো । উজানে পাটের জাগ দিয়ে ভাসিয়ে, তাতে উঠে বসে মুড়ি খেতে খেতে ভেসে  আসা ভাটি মুখে বাড়ির নিচের নদীর তীওে খুটি মেরে  রাখা কতযে আনন্দময় মুহুর্তগুলো। গরুর গাড়ি করে আতœীয় বাড়ি যাওয়া নব বধু নিয়ে আসা। ছইওয়ালা গাড়িতে বৃষ্টির দিনে হোক আর অন্যান্য সময়েই হোক না কেন , কতনা মজাদার মুহুর্তগুলো। নৌকার বৈঠা বেয়ে নদী পারাপার করা। কাদা ভরা রাস্তায় পিছলে পিছলে পথ চলা। কৃষকদলের ছাটা করে ধান, গম কাটা । নিড়ানো ব্যাগার যাওয়া, দল বেঁধে ঘুরতে যাওয়া , আবেগী মুহুর্ত গুলো কি দারুন! এপাড়ায় ইলিশ মাছ ভাজেতো বাসনা ছড়ায় ওপাড়ায়, ওপাড়ায় কলাই মুগ ভাজেতো বাসনা ছড়ায় সারা পাড়া । স্বাদে-গন্ধে ভরপুর । 

জ্যোৎস্না রাতে কপাল টিপাটিপ টুকিটুক লুকোচুরি খেলায় গ্রামের সারা পাড়ায় জাগ্রত থাকা। গোলার ভিতর, কোলার ভিতর, আবডালে, ভাঙ্গাঘরে, আড়মাচায় কতনা জায়গায় লুকানো। কাঠের কলে গরু দিয়ে ঘানি ভাঙ্গানো। আখ মাড়ানো গরু দিয়ে ঘুরে ঘুরে কল ঘোরানোর দৃশ্য, তাওয়ায় আখের রস জাল দিয়ে গুড় ছিন্নি লাড্ডু কত কী মজাদার মধুরসের কথা , মৌমাছির মধুর চাক ভাঙ্গা মনের স্মৃতির চাদরে জড়ানো। জ্যৈষ্ঠে মাসের সকালে কাঁঠাল গাছে উঠে বেত দিয়ে ঠকঠক করে পেঁকেছে কয়টা পরীক্ষা করে পাকা কাঁঠাল বাকের শিঁকে দিয়ে নিচে নামানে। উইপোকার ঢিবি ভেঙ্গে চার সংগ্রহ করে পানতা ভাত ,খৈল , মাছের খাবার বানিয়ে নদীতে মাচায় বসে বসে ছেরোস্তায় মাচ ধরার চিত্র,  এই বুঝি ডাবু গিলে মাছ টানলো , ছনি দিয়ে আস্তে আস্তে মাছ শিকার করে , মাছের মুখে গান্ধি মেরে সূতোতে বেঁধে মাচার নিচে খুঁটিতে বেধে ছেড়ে দেওয়া এবং খেলা দেখা সত্যিই এসব আনন্দঘন এক মূহুর্ত। কোমরের গেজিতে থাকা পয়সা নিয়ে , লাটিম ঘোরানো খেলা খেলা। গুটি দিয়ে নানান খেলার দৃশ্য বিশ্বকে জানানোর মতো। 

দাদুভাই তোমার ছোটবেলা এত মজাদার ! আহ ! কী দারুণ!

হ্যা নাতিভাই? আজ এপর্যন্ত রাখি। চলো আঁধার নামার আগেই । তীর ধরা দ্বীপ ছাড়ি । দিনকাল এখন খুব ভাল নয় নাতি । হ্যা দাদুভাই , চলো তাড়াতাড়ি উঠি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ