রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

পর্নোগ্রাফির কারণসমূহ : ক্ষতি এবং তার প্রতিকার

-মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : [সাত]
আইনটি প্রণয়নের প্রাসঙ্গিকতা হিসেবে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ বলে উল্লেখ করা হয়। পর্ণোগ্রাফী প্রদর্শনের ফলে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে; বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে; সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেননা বর্তমানে চলচ্চিত্র, স্যাটলাইট, ওয়েবসাইট ও মোবাইলের মাধ্যমে পর্ণোগ্রাফী মারাত্মক ব্যাধির মত দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। নারী, পুরুষ, শিশু ও যুব সমাজকে সামাজিকভাবে সুরক্ষা দেয়ার বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে পর্ণোগ্রাফী নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আইনটি প্রণয়নের প্রাসঙ্গিকতায় প্রকৃতার্থে ইসলামের শাশ্বত নৈতিকতার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে।
ইসলামী মূল্যবোধ মানুষকে অশ্লীল কর্ম থেকে বিরত রাখে। অশ্লীলতার সকল দুয়ার উন্মুক্ত রেখে শুধু আইন করে অশ্লীলতাকে রোধ করা যায় না। পর্ণোগ্রাফী নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির মননে ধর্মীয় মূল্যবোধ অভাবনীয় প্রভাব ফেলতে পারে। একমাত্র ইসলামী জীবন দর্শনের বাস্তবায়ন পর্ণোগ্রাফী নামক মহামারি থেকে সমাজকে রক্ষা করতে পারে। বিশেষ করে ইসলামী মূল্যবোধ মানুষকে সকল প্রকার অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখতে পারে।
সুপারিশমালা : পর্ণোগ্রাফী আয়ের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা হয় পর্ণোগ্রাফী বিজনেস মাধ্যমে। এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী একে মানবাধিকার বলে আখ্যা দেয়া শুরু করেছে। এদের কাছে অশ্লীলতা বলতে কিছু নেই। অন্যদিকে বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় পর্দা উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে পর্ণোগ্রাফী কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চাইলেই ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে ইন্টারনেট পর্ণোগ্রাফী রোধ করতে পারে। সব সাইবার ক্যাফেতে নজরদারি বৃদ্ধি এবং তাদের মাধ্যমে পর্ণোগ্রাফী প্রচার ও প্রসার বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা উচিত।
শুধু আইনই যথেষ্ট নয়; বরং আইনের যথাযথ প্রয়োগও জরুরী। আইনের প্রয়োগ করতে পারলেই কেবল পর্ণোগ্রাফী ও এ সংক্রান্ত সকল অনাচার দূর করা সম্ভব হবে।
পর্ণোওয়েবসাইটগুলোর মাধ্যমে একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র নানা ধরনের সাইবার ক্রাইম করছে। পর্ণোগ্রাফী রোধে সুনির্দিষ্ট আইনের অবর্তমানে পর্ণোগ্রাফীর ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ বা দমন করা যায়নি এবং এর জন্যে শাস্তিও দেয়া যায়নি। উক্ত আইনের মাধ্যমে পর্ণোগ্রাফীর ওয়েবসাইগুলো বন্ধ করার ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বর্তমানে পর্ণোগ্রাফীর মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি করা হয়। এক্ষেত্রে যৌন হয়রানীমুক্ত শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ তৈরীতে মহামান্য হাইকোর্ট প্রদত্ত নীতিমালা প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। সরাকারি-বেরসকারি সকল কর্মক্ষেত্রে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জেন্ডার বৈষম্য, যৌন হয়রানী এবং নির্যাতন দমন এবং নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টিতে নিয়োগদাতা বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সচেতন হতে হবে।
নিজ ইচ্ছায় ঐ দৃশ্যে যারা অবৈধ পারফর্ম করে তাদের কোন শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। আইনে উল্লেখিত বিভিন্ন শাস্তির আওতায় তাদেরকেও অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে পর্ণোগ্রাফী নিয়ন্ত্রণ আইন নতুন। ফলে এ আইনের অপপ্রয়োগের আশংকাও থেকে যায়। অবশ্য এ আইনে কেউ মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা দিলেও তা প্রমাণ হলে তার শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আইনের সুযোগ নিয়ে কোনভাবেই তা যেন কারো উপর অপপ্রয়োগ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা অপরিহার্য।
কেউ কেউ বিশেষ সুবিধার লোভে পড়ে নিজের অজান্তে এ ভুল পথে পরিচালিত হয়। ফলে পর্ণোগ্রাফীতে যৌনকর্মে তাদের এমন সম্মতি ফুটে উঠে বাস্তবে যা সঠিক নয়। এক্ষেত্রেও এ কাজকে ধর্ষণ হিসেবে আমলে নিয়ে শাস্তি প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ‘‘এডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক, লেখক: সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আইন ভাবনা : পর্ণোগ্রাফী নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ ও প্রাসঙ্গিক কথা, আজকালের খবর, ২ ফেব্রুয়ারী ২০১২ (তিনি লিখেছেন, আমাদের মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র মামলায় (৫৭ ডিএলআরের ৫৯১ পৃষ্ঠায়) বলেছেন, যৌনকর্মের সময় যদি ভিকটিম বাধা না দেয় অথবা বাধা দেয়ার চেষ্টা না করে অথবা কোনো চিৎকার না দেয় তাহলে তাতে ভিকটিমের সম্মতি আছে ধরে নিতে হবে। ২৭ আগস্ট ২০০৯ তারিখে ধর্ষণের অভিযোগে আনীত একটি মামলায় আসামী হান্নানকে আদালত খালাস দেন। আদালত বলেন, ওই মামলার ঘটনায় ভিকটিম রুনা খাতুন (১৬) প্রতিবেশী আসামী হান্নান তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে প্রায় ছয়-সাত মাস ধরে তাদের বাড়িতে অন্যদের অনুপস্থিতিতে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে বেশ কয়েকবার যৌনকর্মে মিলিত হয়। যার ফলে ভিকটিম রুনা খাতুন গর্ভবতী হয়। গর্ভবতী হওয়ার পাঁচ মাস পর ভিকটিম তার মাকে জানায় এবং এ ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদে একটি সালিশও হয়। আসামী হান্নান ভিকটিম রুনা খাতুনকে বিয়ে করতে অস্বীকার করায় চেয়ারম্যান, মেম্বার ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তির সিদ্ধান্তে আসামীকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এ মামলায় বিচারক আসামীকে খালাস দেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ঘটনার সময় ভিকটিমের বয়স কমপক্ষে ১৬ বছর ছিল। এর আগে তার দু’বার বিয়ে হয়েছিল এবং আসামীর সঙ্গে তার একাধিকবার যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া ভিকটিমের সম্মতিরই নামান্তর। এ ধরনের অনাচার আমাদের সমাজে হরহামেশা দেখা যায়। এহেন প্রতারণা করেও এসব ক্ষেত্রে প্রেমিকরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে প্রেমিকাদের অবশ্যই বেশি সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।)
সিনেমা, টিভি বিজ্ঞাপন ও নাটক অশ্লীলতামুক্ত করতে হবে। অশ্লীল সংলাপ, অশ্লীল গান, প্রেমের আবেদন, পরকীয়া ইত্যাদির উপাদান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। চরিত্র বিধ্বংসী সর্বপ্রকার বস্তই নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিনোদন কেন্দ্র, নাটক, সিনেমা, টিভি বিজ্ঞাপনসহ সকল অঙ্গণকে অশ্লীলতামুক্ত রাখতে আইনে উল্লেখিত নৈতিক মূল্যবোধের সুরক্ষা দিতে হবে। The Code for Censorship of Films in Bangladesh, 1985 (Dhaka, the 16th November 1985 No. S.R.O. 478.L/85) [Immorality or Obscenity: N.B. (4) In case a picture creates such an impression on the audience as to encourage vice or immorality, even it shows that the vicious to the immoral has been punished for his/her wrong.
আইনটি বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় পর্যায় থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। কমিটিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, মানবাধিকার কর্মী ও স্থানীয় আলিমদের অন্তর্ভূক্ত করা উচিত।
বাংলাদেশে ভাসমান কিছু নারী ও শিশু অবৈধ যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী এদেরকে ব্যবহার করে অবৈধ পর্ণো ছবি উৎপাদন করে। ফলে এদের পুনর্বাসন সেবা, বিশেষ শিক্ষা, চাকরির প্রশিক্ষণ ও অংশগ্রহণের সুয়োগসহ প্রয়োজনীয় সহায়তাদান প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পদক্ষেপ নেয়া অত্যাবশ্যক।
সমাজের সভ্যসাচি মানুষদের বিনোদন প্রয়োজন মিটাতে দেশে চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশ লাভ করেছে। আর এ সুযোগে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যক্তিবর্গ অশ্লীল ছবি নির্মাণ করে সুস্থ ধারার চলচ্চিত্রের সর্বজন গ্রহণযোগ্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। এ ক্ষেত্রে শর্ত ও নিয়মভঙ্গের উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে ‘দি সেন্সরশিপ অব ফিল্ম এক্ট’ এ উল্লেখিত আইনের ধারা অনুযায়ী ‘অনুমোদিত ছবির প্রত্যায়ন বাতিলকরণ’ সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। The Censorship Of Films ACT. 1963. Act No. XVII of 1963 (As amended by President’s Order No. 41 of 1972, Ordinance No. LVIII of 1982 and Act No. I of 2006), aviv 7 [Power to decertify certified films-7. Where the Goverment is of the opinion that a certified film, or class, should, in the interest of law and order, or in the interest of local film industry, or in any other national interest, be decertified in respect of the whole or any part of Bangladesh, it may, of its own motion, by notification in the official Gazette, direct that such film or class of films shall be deemed to be uncertified film or films in respect of the whole of Bangladesh, or such area or areas as may be specified in the notification.] 7A (1), (2) & (3) [Seizure of film 7A (1) Where the Board has reason to believe that a film or publicity materials are being exhibited in any place in contravention of any provision of this Act or any rule made thereunder, it may, by order in writing, authorise any Police officer not below the rank of Sub-Inspector or any distrisct Information officer to search the place and seize a film or any publicity materials under sub-section (I) shall forthwith forward it to the court. (3) On receipt of a film or any publicity materials under sub-section (2) the Board] shall take such action under the Act as it deems proper]
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এখানকার অধিবাসী জনগোষ্ঠীর নৈতিকতা দেশের আইনসমূহকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। ‘দি কোড অব সেন্সরশীপ অব ফিল্মস ইন বাংলাদেশ, ১৯৮৫’ তে “Religious Susceptibilities’’ অর্থাৎ ‘ধর্মীয় সংবেদনশীলতা’ এবং Immorality or Obscenity অর্থাৎ ‘অনৈতিকতা বা অশ্লীলতা’ দু’টি শিরোনামে যথাক্রমে চারটি ও পাঁচটি ক্ষেত্র বর্ণিত হয়েছে। উল্লেখিত ক্ষেত্রসমূহে পর্ণোগ্রাফীর যাবতীয় অশ্লীলতাকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উপমহাদেশের প্রযোজিত সিনেমা মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশুদ্ধিকরণে এ শর্তসমূহ মাইলফলক।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ পর্ণোগ্রাফী উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও প্রদর্শনীতে কখনোই অনুমোদন করেনি। এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনাদর্শ ইসলাম পর্ণোগ্রাফীসহ সব ধরনের অশ্লীলতাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ফলে এ অঞ্চলের মুসলিমরা ছিল যাবতীয় অশ্লীলতামুক্ত ও রুচিহীন ক্রিয়াকর্মের বিপরীতে উন্নত জীবন যাপনের প্রতি প্রত্যয়শীল। তাদের শিল্প, সাহিত্য, নাটক, সিনেমা সহ সর্বপ্রকার সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা এ উন্নত তাহযীব-তামাদ্দুনের পক্ষেই স্বাক্ষর বহন করে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় স্যাটেলাইট, মোবাইল প্রযুক্তি, ইন্টারনেট, সাইবার ক্যাফে ইত্যাদি উদ্ভাবনের পর নৈতিকতা বিরোধী যে অশ্লীল ভিডিও ও স্থিরচিত্র ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তা নিয়ন্ত্রণে সুস্পষ্ট আইনগত পদক্ষেপ হিসেবে সরকার নতুন আইন প্রণয়ন করে। প্রস্তাবিত আইনে পর্ণোগ্রাফী সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইন প্রণয়নের আবশ্যকতা সম্পর্কে প্রদত্ত বিবৃত্তি ও মূল আইনের শিরোনাম পরবর্তী উল্লেখিত আইন প্রণয়নের প্রেক্ষাপট বর্ণনায় আইনটির যে প্রাসঙ্গিকতা ফুটে উঠেছে তা পক্ষান্তরে অশ্লীলতা নিয়ন্ত্রণে ইসলামী নৈতিকতায় ঐতিহাসিক ও উন্নত পদক্ষেপসমূহের তাৎপর্যই বহন করছে। ইসলাম মানব জীবন পরিচালনায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ নৈতিক চরিত্রে বিকশিত শাশ্বত আদর্শ। পর্ণোগ্রাফীর মতো একটি অনৈতিক কর্ম ইসলামী মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ জাতির ভেতর কখনই সৃষ্টি হতে পারে না। বাংলাদেশে পর্ণোগ্রাফী ও সংশ্লিষ্ট অপরাধ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও জীবন-নির্ধারণের সঠিক ও পূর্ণ অনুসরণ। (সমাপ্ত)
# লেখকঃ শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, কলামিষ্ট

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ