শনিবার ১৮ মে ২০২৪
Online Edition

একুশ তুমি

পপি আক্তার : শীতের সকাল। কুয়াশার চাদর ঠেলে পুবে রাঙা সূর্য উঠছে। দেশের এত কোলাহলের মাঝেও যেন এ এক অপূর্ব সৌন্দর্য। ধানের শীষের ডগায় সূর্যের আলো পরে যেন শিশিরগুলো চক চক করছে। শীতের অনুভূতি যেমন কাপিয়ে তুলছে পথের ধারের মানুষদের তেমনি মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে তরুণ ভিতরে। তারা প্রস্তুত হচ্ছে তাদের মায়ের মুখের ভাষার জন্য লড়াই করবে বলে।
রাতটা ছিল ২০শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ এর। অনেক তরুণ মিলে জমায়েত হলো এলাকার একটা গাছের নিচে। শীতের রাতে, তবুও মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসা তাদের নিয়ে এসেছে রক্ত হিম করা ঠান্ডায়। কয়েকজন মিলে সাদা কাগজে তাদের দাবি লিখছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই এমনি কিছু দাবি। তাদের সবার মধ্যে ভালো বক্তৃতা দিতে পারত অরুণ। তার সাহসও ছিল প্রচুর। সে তার দেশের জন্য নিজের প্রাণ দিতেও দু’বার ভাবত না। তার উদ্যোগেই কালকের মিছিলের কথা হচ্ছিল। তার অনুপ্রেরণায় এলাকার যে তরুণরা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রাণ ভয়ে যেতে চায়নি মিছিলে, তারাও আজ এসেছে নিজের ভাষাকে জয় করার জন্য।
আলোচনার মধ্যে অরুণ বলল-
ঃ বাংলা আমাদের ভাষা। আমাদের ভাষা কেন ওই উর্দু সরকার কেড়ে নিবে। ছোট বেলায় মায়ের মুখ থেকে এই ভাষা শিখেছি। এই ভাষা কিছুতেই আমরা কেড়ে নিতে দিতে পারি না। তাদের ভাষায় তারা কথা বলুক। আমাদের ভাষায়, আমরা কথা বলব। শুধু উর্দু কেন দেশের রাষ্ট্রভাষা হবে? এ অন্যায়, এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে যদি আমরা প্রতিবাদ না করি তবে এভাবে আরো অন্যায় করবে ওরা আমাদের উপর।
একজন বলে উঠল-
ঃ এ ভাষা আমাদের। আমরা যদি আমাদের ভাষাকে বাচাতে না পারি, তবে অন্য কেউ এই ভাষার জন্য লড়াই করবে না। আমাদেরই আমাদের ভাষার জন্য প্রতিবাদ করতে হবে। সবাই একসাথে সম্মাতি দিল। তারা সবাই কাল শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করবে বলে ঠিক করে।
পোষ্টার লেখা শেষ হলে অরুণ সবাইকে বাসায় যেতে বলে। সবাই নিজের বাসায় গেল। কিন্তু রাতে ঘুম হলো না অনেকেরই। কাল মিছিলে কি কি হবে না হবে তাই ভেবেই কখন সকাল হয়ে গেল যেন।
সকাল বেলা সবার আগে অরুণকেই দেখা গেল গাছটার নিচে। সে সবগুলো পোষ্টার ঠিক করে রেখেছে। চোখ মুখ দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে কাল তার ঘুম হয়নি ।
সে সেলিমকে লক্ষ্য করে বলল, সবাই আসে নি এখনো?
ঃ চলে আসবে। মাত্র সাড়ে ছয়টা বাজে। অরুণ ভাই, আপনি কিছু খেয়েছেন?
ঃ চলেন চায়ের দোকানে। একটু চা খাবেন। অরুণ ভাবল সবাই আসতে আসতে একটু চা খেয়ে আসা যাক। তারা রহিম মিয়ার চায়ের দোকানে গেল।
রহিম মিয়া (একটু হেসে) অরুণকে জিজ্ঞেস করল, কেমুন আছেন ভাইসাব? আইজকা নাকি কিসের মিছিল হইব শুনলাম।
ঃ হ্যাঁ। আপনিও চলেন আমাদের সাথে মিছিলে। আমরা আমাদের ভাষার জন্য মিছিল করব।
ঃ না ভাইসাব। আমার ওইসব ডর লাগে। হেরা ত যারে পাইতাছে অরেই ধরতাছে।
ঃ তাই নাকি?
ঃ হ, আপনি শুনেন নাই?
চা খাওয়া শেষ হলে তারা ফিরে যায় গাছটার নিচে। দূর থেকে অরুণ দেখতে পায় অনেকেই এসে গেছে সেখানে।  অরুণ তাদের দেখে ভাবে, তাদের দিয়েই ভাষাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। প্রায় ৯ টার দিকে তারা মিছিলে নিয়ে বের হয়। তারা আস্তে আস্তে হেটে হেটে বড় রাস্তার দিকে এগোয়। এবাবে কিছুক্ষণ হ্টাার পর দেখা যায় কতগুলো পুলিশের জিপ আসছে। অরুণ জানত আজ সব ধরনের মিছিলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করার পরও তার মিছিল নিয়ে বেরিয়েছে. তাই পুলিশ তাদের আটকানোর চেষ্টা করবেই।
তারা সবাই পুলিশকে দেখে আরো জোরে জোরে তাদের দাবি জানাতে থাকে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বলে রাস্তা চঞ্চল করে তোলে। দ্বিগুণ জোর দিয়ে তাদের দাবি জানাতে থাকে। পুলিশের কথা না মানায় পুলিশ তাদের উপর গুলী ছুড়তে থাকে। মিছিলের সামনে যারা ছিল তাদের কয়েক জনের হাতে, পায়ে, বুকে, মাথায়, এক এক করে গুলী বিধতে থাকে। মিছিলের সকলের সামনে ছিল অরুণ। পুলিশের চালানো প্রথম গুলীটা লাগে ওর বা হাতের উপরে। তারপরও সে তার ভাষার জন্য লড়াই করা যায়। বলতে থাকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। একটু পরই আরেকটা গুলী এসে লাগে তার বুকের ঠিক মাঝখানে। সাথে সাথেই পরে যায় সে। তাকে পরে যেতে দেখে সেলিম দৌড়ে আসে। সে দেখে রক্তে জামা ভিজে গেছে অরুণের। সেলিমকে কাছে দেখে অরুণ তার রক্তে ভেজা হাত দিয়ে সেলিমের হাত ধরে বলে, ভাষাকে বাচাও, একে কেড়ে নিতে দিয়ো না, বাংলা আমাদের------বলতে বলতে তার গলার স্বর অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেলিম অশ্রুসিক্ত চোখে  শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে অরুণকে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ