রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

আইনী জটিলতা নিরসন করা প্রয়োজন

-আবু মুনীর
নদী দখল ইংরেজি River Possession or Occupancy. আর দখলকার ইংরেজি হলো Occupant or Possessor. পাহাড়, হ্রদ, প্রস্রবন প্রভৃতি উচ্চ ভূমিতে সৃষ্ট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্রোতধারার মিলিত প্রবাহ নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক খাত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যখন অপর কোনো জলাশয়, হ্রদ বা সাগরে মিলিত হয় তখন ঐ প্রবাহকে নদী বলা হয়। নদীর বিজ্ঞানসম্মত বিদ্যাকে পোটোমলোজি (Potamology) বলে। একটি নদী ও তার উপনদী সমূহ একত্রে মিলে নদী প্রণালী বা নদী ব্যবস্থা গঠিত হয়। নদী যে স্থানে সমুদ্রে বা হ্রদে মিলিত হয় তাকে মোহনা বলে। বাংলাদেশের নদী নালাকে চারটি নদী প্রণালী বা নদী ব্যবস্থার বিভক্ত করা হয়েছে। যথা (১) ব্রহ্মপুত্র-যমুনা (২) গঙ্গা-পদ্মা (৩) সুরমা-মেঘনা ও (৪) চট্টগ্রাম অঞ্চলের নদ নদী সমূহ। বাংলাদেশের নদ নদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৪,১৪০ কি.মি (প্রায়) [সূত্র: বাংলা পিডিয়া]। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক অবস্থান ও গঠনের প্রেক্ষিতে নদ-নদীর গতিধারা দেশের সকল কর্মকান্ডকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে থাকে। দেশের প্রধান নদীগুলোর শাখা ও উপ-নদীসহ মোট প্রায় ৭০০ নদী রয়েছে। বাংলাদেশের মাটির গঠন ৮০% নদী বাহিত পলি দ্বারা গঠিত। নদী ভাঙ্গনের ফলে নদীর গতিপথ প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয় এবং নতুন নতুন চর জেগে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় অনেক কার্যক্রম গ্রহণের অবস্থান সৃষ্টি করে। ১৯৫০ সনের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৮৬ ধারায় নদী সিকস্থি ও পুনর্গঠন (পয়স্থি) সংক্রান্ত আইন বর্ণিত আছে। তবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সনে ১৩৫ নং আদেশের মাধ্যমে প্রোক্ত ৮৬ ধারায় ২ দফায় লিখিত পুনর্গঠন (পয়স্থি) সংক্রান্ত আইন বাতিল করে তৎস্থলে এক নতুন আদেশ জারী করেছেন। অত্র আইনের ৮৭ ধারায় পয়স্থি অথবা পরিবৃদ্ধি সংক্রান্ত আইন বর্ণিত আছে। সংশোধিত ৮৭ ধারা ১৯৭২ সনের ২৮ জুন তারিখের পূর্বে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জমির উপরও প্রযোজ্য হবে, তবে এই প্রকার বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জমি বিষয়ে যদি সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি দ্বারা তৎকালীন প্রচলিত আইন অনুযায়ী ইতিমধ্যে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে, তবে তা অপরিবর্তিত থাকবে। সংশোধিত ৮৭ ধারা ১৯৭২ সনের ২৮ জুন তারিখের পূর্বে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জমির উপর প্রযোজ্য হলেও প্রজাস্বত্ব আইন চালু হওয়ার অর্থাৎ পঞ্চম খন্ড আমলে আসার পূর্বে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জমির উপর সংশোধিত নতুন ৮৭ ধারার আইন প্রযোজ্য হবে না। নদী দখল, খাল দখল, জমি দখল, জায়গা দখল, রাস্তা দখল, হল দখল, প্রভৃতি কোথায় নেই দখলবাজি? জোর যার মুল্লুক তার। খাস জমি দখল নিয়ে গড়া হচ্ছে দোকানপাট, প্রতিষ্ঠান। হাঁটবেন ফুটপাত দিয়ে-বহু বছর আগে থেকে হয়ে আছে দখল। দখলদাররা সমানে করছে রাস্তা দখল। ঢাকা শহরে ফুটপাত আর রাস্তা দিয়ে জনগণ হাঁটবে? আর হবে কি সেই সুযোগ? রাস্তা দখল করে কোথায় না রাখা হয় ইট-বালি-রড-পাথর। হায়রে দখলদারি! দখলদারদের ঠেকাবে কে? কামরাঙ্গীরচরে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারী বুধবার ১২৪ টি স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (BIWTA)। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কৌসুলি মোশারফ হোসেন কাজলের শ্বশুরের তিনতলা বাড়িটিও ভাঙ্গা হয়। দুদকের ঐ আইনজীবী বলেন, ঝাউচরে ভেঙ্গে ফেলা তিনতলা বাড়িটি তাঁর শ্বশুরের। ওই বাড়ির জায়গা কেনা সম্পত্তি। জায়গাটি নদীর সীমানা থেকে ২০ ফুট বাইরে। জায়গার মালিকানা সংক্রান্ত সব বৈধ কাগজপত্রই তাঁদের কাছে আছে। কিন্তু BIWTA তা দেখে নি। এক সপ্তাহ সময় চাওয়া হলেও তা দেয়া হয় নি। বাড়ি উচ্ছেদের নোটিশও দেয় নি BIWTA. বুড়িগঙ্গা ও তুরাগে উচ্ছেদ অভিযান চলাকালেই দ্বিতীয় দিন ছাত্রলীগ নেতা আটক, মুচলেকায় মুক্ত। গত কয়েকদিন ধরে অভিযান স্বত:স্ফূর্তভাবে চললেও তুরাগ চ্যানেল উদ্ধারে গতকালের অভিযান বারবারই থেমে যাচ্ছিল বাধার মুখে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারী ৬৪ জেলায় একযোগে অবৈধ নদী দখলদারদের তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড: মুজিবুর রহমান জানিয়েছেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে নিয়ে শিগগিরই একটি যৌথসভা করে সকল জেলা প্রশাসক কে বিষয়টি অবগত করাবেন বলে জানান। বিশিষ্ট নদী গবেষক শেখ রোকনের মতে, ৯০ এর শতক থেকে নদ-নদীতে দখল ও দূষণ বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিহির চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, প্রায় প্রতি বছরই নদীতে দখল উচ্ছেদ অভিযান চলে। তার মতে এসব অভিযান অনেকটা লোক দেখানো। উচ্ছেদের পর আবার বেদখল হয় নদী। নদীরও একটা জীবন আছে। সেকাল থেকে একাল অবধি নদী শুধু বয়েই চলেছে। বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৭৭ সালে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট (RRI) প্রতিষ্ঠিত হয় যার প্রথম সদর দপ্তর ছিল ঢাকা, বর্তমান এর সদর দপ্তর হারকান্দি ফরিদপুর এবং এই প্রতিষ্ঠানটি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত সংস্থা। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় কৃষি খাস জমি বন্দোবস্ত প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হলেন জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসকের উপর ন্যস্ত রয়েছে ভূমিহীন কৃষক পরিবারকে কৃষি খাস জমি বন্দোবস্ত প্রদানের দায়িত্ব।
প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক পরিবারকে কৃষি খাস জমি বন্দোবস্ত দিতে গিয়ে নদ-নদী, খাল-বিল শ্রেণির জমি প্রাকৃতিক কারণে কৃষি জমিতে রূপান্তরিত হওয়ায় এ সকল শ্রেণির জমিও ভূমিহীন কৃষক পরিবারকে বন্দোবস্তু দেওয়া হয়। শ্রেণি পরিবর্তন না করে নদী ও খাল শ্রেণির জমি স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়াতে গ্রামের নিরীহ কৃষক বন্দোবস্ত গ্রহীতা আইনের মারপ্যাঁচে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং শেষ পর্যন্ত আদালতে ধারস্থ হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।
সুতরাং নদী দখল এবং উচ্ছেদ কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা নিরসন করা একান্ত প্রয়োজন। একজন ছড়াকারে একটি ছড়ার উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি, নয়-কে যারা ছয় করেছে/আট করেছে চার-কে/ তারাই করে জবর দখল/ খাস জমি আর নদী সকল/ তাদের শিকার বুড়িগঙ্গা/অন্য বিষয় নয় যে...........।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ