বুধবার ২২ মে ২০২৪
Online Edition

মিনহাজ উদ্দীন শরীফ

বর্ষাকালে মানেই তো নদী নালা খাল বিলে পানির বিরাজ। চর্তুদিকে পাল তোলা নৌকার দেখা মিলে। ঘাটে - ঘাটে নৌকার মিলন মেলা। গাছের ডালে -ডালে সাদা কদম ফুল ফুটে। মনের আনন্দে পাখিরা মধুর কন্ঠ গান গেয়ে প্রকৃতিটাকে মাতিয়ে রাখে! এইসব মনোরম দৃশ্য তৃতীয় শ্রেণীর পড়ুয়া মেয়ে সুমী কখনও দেখেনি। কারণ সুমী বাবা - মায়ের সাথে শহরে বসবাস করে। সুমীর বয়স সবে মাত্র দশ রানিং। এখনও ততোটা বুঝে না কোন'টা ভালো কোন'টা মন্দ। যদিও থ্রিতে পড়ে। সুমী ক্লাসের ফার্স্ট গার্লস। এইজন্য বাবা - মা খুব আদর স্নেহ করে; যখন যেটা আবদার করে তখনই সেটা দিতে বাধ্য। সুমী দ্বিতীয় সাময়িকী পরীক্ষায় ৬০০ এর মধ্যে ৫৮৪ পেয়েছিল তাও হায়েস্ট নাম্বার। ঐ তখন সুমীর বাবা সুমীকে বলেছিল একটা সারপ্রাইজ দিবে। তাই গত রাতের খাবার শেষে করার পর বাবা ঐ সারপ্রাইজের কথা সুমীকে স্মরণ করিয়ে দিলো। সুমী তো খুশিতে আত্মহারা। কারণ বাবা হয়তো দামী কোনো কিছু গিফট করবে। প্রতিবারের মতো যেমনটা দিয়ে আসছে। কিন্তু এই প্রথম বারের মতো গিফটা একটু অন্যরকম হয়ে গেলো। বাবা সুমীকে বললো আগামীকাল তোমাকে আমার জন্মস্থান সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার, আজমিরিগঞ্জ উপজেলার, জলসুখা ইউনিয়নের, চৌধুরী হাটি গ্রামে নিয়ে যাবো। আমার বাবার বাড়িতে। সুমী আনন্দে লাফিয়ে বলতে লাগলো সত্যি বলছো বাবা। ''বাবা বলে মিছে বলবো কেন রে। বাবাকে জড়িয়ে সুমী গালে মুখে চুমু দিতে লাগলো। তারপর বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে সুমীকে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। এই ফাঁকে মা সবকিছু গুছিয়ে ব্যাগে ভরে। ঘুমাতে গেলো।

সকাল হতেই না হতে গাড়ির হর্ণে তাদের ঘুম ভেঙে গেলো। রোজকারের মতো। বাবা সুমীকে ডেকে তুলে দিলো। সুমী ব্রাশ করতে করতে ড্রেসিংরুমে গেল। সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেতে বসলো। মা বলছে সুমী তুমি কি কি সঙ্গে নিয়ে যাবে; নাস্তা সেড়ে গুছিয়ে নাও। সুমী তাড়াহুড়ো করে নাস্তা শেষে করে; ব্যাগ গুছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। বাবা এদিকে উচ্চকন্ঠে বলতে লাগলো সুমী তাড়াতাড়ি কর না মা। তা-নাহলে ট্রেন মিস হয়ে যাবে। আর ট্রেন মিস হলে বাসে করে যেতে হবে। তখন কাঁদলে কিন্তু কোনো লাভ হবে না। বাবার কথা শুনে মেকাপ না করেই চলে এলো। বাবা দরজায় তালা দিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে আনলো রেল ষ্টেশনে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ৮ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে স্টেশনে পৌঁছালো। বাবা টিকেট কাউন্টার থেকে ২টা টিকেট সংগ্রহ করলো। সুমী ছোট তাই তার টিকেট লাগবে না। সিটে কিছুক্ষণ বসার পর ট্রেন'টা গন্তব্যের দিকে দিব্যি ছুটছে। বাবা ট্রেনের জানালা খুলে দিলো। প্রকৃতির শীতল বাতাস উপভোগ করতে ও প্রকৃতিকে চোখে ধারণ করার জন্য। সুমী একটু বুদ্ধিমান ও বটে। এতসব কিছু মনে রাখতে পারবে না বলে ছবি আঁকতে আরম্ভ করলো মনোরম পটভূমি দেখে । সুমী ছবি আঁকতে পছন্দ করে। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছবি এঁকে অনেক পুরস্কার পেয়েছে। সুমীর দারুণ হাতের ছবি আঁকা দেখে পাশের সিটের যাত্রীরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই সুমীর খুব প্রশংসা করছে। কেউ বলছে মিষ্টি মেয়ে; কেউবা আবার বলছে লক্ষী মেয়ে। কেউ বলে তোমার মতো হিরার টুকরা মেয়ে যেনো বাংলার প্রত্যেকটা ঘরে ঘরে হয়। বাবা- মায়ের বুকটা গর্বে ভরে গেলো।

তিন ঘন্টা ট্রেনে জার্নি করার পর ট্রেন'টা শায়েস্তা গঞ্জ শহর এসে থামল। তারপর নব্বই টাকা দিয়ে সিএনজি ভাড়া করে হবিগঞ্জ সদরে আসল। সেখান থেকে আবারও সিএনজির মাধ্যমে নিজ গ্রামের দিকে এগোতে লাগল। বাবা হাত উঠিয়ে দেখাচ্ছেন বানিয়াচুং গ্রাম'টা। সুমী বাংলার মাঠ-ঘাট-নদীনালা আনমনে চেয়ে চেয়ে দেখছে। বাবাকে প্রশ্ন করে বাবা এতো সুন্দর মনোরম দৃশ্য কে সৃষ্টি করছে? বাবা বলে বোকা মেয়ে এইসব কি কোনো মানুষের ধারা সম্ভব রে মা! ধরার বুকে এই যে দেখছি গাছপালা ফুল, ফল, পাখি, এছাড়াও আরও অনেক কিছু এসব আমাদের স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষের কল্যাণে। সুমী কিছুটা হলেও বুঝেছে। ঐ দিকে তারা নিজেদের গ্রামেও চলে এসেছে। গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা আর গাছগাছালি দেখে সুমী মুগ্ধ। তাদেরদের বাসার সামনে গাড়িটা থামল। তারা গাড়ি থেকে নেমে দেখে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। দাদা- দিদাও সবাই সুমীকে এগিয়ে দেখতে এলো। কিন্তু সুমী কারো সাথে কথা বলেনি কারণ দাদা-দিদা ছাড়া কাউকে চেনে না। সুমীর কাছে প্রত্যেকে নিজ দায়িত্বে পরিচয় দিলো। যাতে সবাইকে সুমী সহজ চিনতে পারে। বারান্দা থেকে দাদি চিৎকার করে বলছে আগে সুমীকে ঘরে আইতে দাও তোমরা তারপর তোমাদের যা বলার বলিও। দাদির কথা মতো সুমী'কে ঘরে নিয়ে গেলো। নাতনি আসবে বলে; আগে থেকেই পুকুরে জাল ফেলে কাতলা মাছ ধরে দাদি হরেক রকম সুস্বাদু খাবার রান্না করে রেখেছে। দাদা এসে বাবাকে বলল সুমন হাত মুখ ধুয়ে বউমা আর সুমীকে নিয়ে খেতে আয়। সবাই এক টেবিলে খেতে বসল। সুমীকে তার দাদা কাতলা মাছের মাথা'টা দিলো। সুমী কাতলা মাছের মাথা খাবে কি! দেখেই তার পেট ভরে গেছে। না খাওয়ার জন্য কত বাহানা করলো কিন্তু কোনো লাভ হলো না সবার সামনে সম্পূর্ণ মাথাটা তার খেতেই হলো। পুকুর পাড়ের জারুল গাছে পাখির কলতান সুমী শুনে মুগ্ধ। তাই বাবাকে বলছে বাবা চলো আমরা পাখিদের দেখে আসি। বাবা বলে মা'রে আমি ক্লান্ত; তুমি তোমার দাদার সাথে গিয়ে দেখে আসো। সুমী বলে না তুমি ও আসো দাদাভাই তো যাবে এমনিতেই। মেয়ের বায়না তাই বাধ্য হয়ে যেতো হলো। দাদার হাত ধরে সুমী চলছে। দাদা এটা ওটা দেখাচ্ছে। খানিকটা পথ হাঁটার পর দেখতে পেলো নদীর ঘাটে ছেলেমেয়েরা দলে দলে সাঁতার কাটছে।

এখন পাখিদের না দেখে নদীতে সাঁতার কাটতে চায়। কিন্তু সুমী তো কোনো দিন নদীতে গোসল করে নি; তাই বাবার চিন্তা যদি আবার জ্বর টর বেঁধে যায়। এই ভেবে না করছে; কিন্তু সুমী নদীতে নামার জন্য দাদার কাছে ও রিকুয়েস্ট করছে। দাদা নিরুপায় হয়ে বাবাকে বলে সুমন এতো করে বলছে একটু নামতে দে না বাপ। তারপর বাবা অনুমতি দিলো। সুমী নদীর তীরে গিয়ে পানিতে নামতে ভয় পাচ্ছে। বাবা ও দাদার সাহায্য চাইছে; অবশেষে বাবা ও দাদা পানিতে নামলো। সুমী ডুব দিতে গিয়ে পানি গিলে ফেলে। শুরু হলো কাশি অবিরত। সুমীকে নিয়ে বাবা ও দাদা বাড়িতে চলে আসে। সুমীর দু'চোখ টকটকে লাল হয়ে গেছে। বাবা ভয়ে নাজেহাল অবস্থা। রাতে সুমী জন্য কারো ঘুম হয়নি। সর্দি কাশিতে সুমী হাঁপিয়ে গেছে। বেশ কয়েক দিন সুমী জ্বরের জন্য বিছানা থেকে উঠে বাহিরের সূর্য দেখেনি। গ্রাম্য ফার্মেসির ঔষধ খাওয়ানোর পর ও কোনো কাজ হয়নি; বাবা-মায়ের মনে বিপদ সংকেত দিচ্ছে। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলো ঢাকা চলে যাবে। সেখানে বড় ডাক্তার ধারা সুমীর চিকিৎসা করাবে। দাদা-দাদিও আর বাঁধা দিলো না কারণ আদরে নাতনির যদি কিছু হয়ে যায় সেই ভয়ে। তারপর তারা দিনে দিনেই ঢাকা চলে আসে। সেখানে ভালো ডাক্তার দিয়ে সুমীর চিকিৎসা করা হয়। কয়েকদিনের মধ্যেই সুমী সুস্থ হয়ে ওঠে। বাবা সুমীকে কিছু বলেনি, বলেছে শুধু বড়দের কথা না শুনলে এমনই হয়। তুমি যদি সেদিন আমার কথা মেনে নিতে তাইলে তোমার অযথা এতো কষ্ট পেতে হতো না। সত্যিই তো! সুমী বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলে বাবা আমি আর কখনো তোমাদের কথার অবাধ্য হবো না। ঐ ঘটনা থেকে সুমী সর্বদা বাবা-মায়ের কথা মতো চলে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ